প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আন্তর্জাতিক চোরাচালানের রুট কিংবা অসামাজিক, সন্ত্রাসী ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। বাংলাদেশ হবে অন্যতম নিরাপদ আবাসভূমি। বিমান বন্দরে নিরাপত্তা জোরদার করার কারণেই ঘনঘন চোরাকারবারিরা ধরা পড়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। আমরা আর কারো কাছে হাত পাততে চাই না। আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। পরমুখাপেক্ষী না হয়ে দেশকে কিভাবে উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া যায় সে চিন্তা সবাইকে করার আহ্বান জানান তিনি।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে সচিবালয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় পরিদর্শন ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রতি সমন্বিত প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভৌগলিক অবস্থান ও আল্লাহ প্রদত্ত প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে বাংলাদেশের প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতু বন্ধনের দেশ হওয়ার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ভিত্তি করে পর্যটন খাতের মাধ্যমে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে তিনি নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, বিশ্বের দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্র সৈকত ছাড়াও বাংলাদেশে গভীর অরণ্য, ছোট-বড় পাহাড়, সমুদ্র ও ধর্মীয় উপাশনালয়ের এক অনন্য সমন্বয় ঘটেছে। যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে থাকে। পাহাড়, সমুদ্র, নদ-নদী, ম্যানগ্রোভ বনভূমি আর সবুজেঘেরা সমতলের এমন সমারোহ বিশ্বের খুব কম দেশেই রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতীয় পতাকাবাহী বাংলাদেশ বিমানের সেবার মান আরো উন্নত ও নিরাপত্তা নিশ্চিত, দেশের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন সেবা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ বিমানের নিরাপত্তার বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে এ বিমানকে এখন বিবেচনা করা হয়।
‘ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত থাকে না’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই লাইনটি উদ্ধৃত করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ভিক্ষুক জাতি না। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। আমাদের মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি থাকার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থনৈতিকভাবে আমরা মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার প্রধান হিসাবে আমার কিছু দায়িত্ব থাকে। আর সবাই থাকলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারি। শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ বিমানের প্রতি এতই আন্তরিক ছিলেন যে, এর লোগো তৈরি এবং চূড়ান্তকরণ তিনি নিজে তদারকি করেন। তিনি বলেন, মাঝখানে ব্যত্যয় ঘটেছিল, দেখলাম ভালো লাগে না। তাই পুরনো লোগোতেই ফিরে গেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার বিমানবন্দরগুলোর মান উন্নীতকরণ, নিরাপদ বিমান অবতরণ এবং আন্তর্জাতিকমানের যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বর্তমান অবস্থা থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আরো উন্নয়নের জন্য ৫৩১ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ট্যাক্সিওয়ে লাইটিং সিস্টেম বসানো এবং বিমানবন্দরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হচ্ছে। এছাড়াও ১৮৮ কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রানওয়ের ওভারলে’র প্রকল্প জুন মাসে শেষ হবে। সরকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দ্বিতীয় রানওয়ে স্থাপনের কাজ হাতে নিয়েছে। এছাড়া যাত্রীদের যাতায়াত সুবিধার জন্য ঢাকার বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন ও হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মধ্যে একটি সুড়ঙ্গ পথ তৈরির লক্ষ্যে গবেষণা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, পাশ্চাত্যের পর্যটকদের জন্য অনন্য পর্যটন জোন হিসেবে কক্সবাজারকে গড়ে তুলতে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট অপারেটিং সুবিধাসহ কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দরে উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করতে ৫৪৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। আমরা এমন ব্যবস্থা নিচ্ছি, যাতে এই পর্যটন কেন্দ্রে আন্তর্জাতিক বিমান নামতে পারে। সিলেট বিমান বন্দরে রি-ফুয়েলিং ব্যবস্থা দ্রুত চালু করার জন্যও নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিমানের কোন কোন রুট লাভজনক হতে পারে তা খুঁজে বের করতে হবে। যেখানে বেশি সংখ্যায় প্রবাসী বাঙালিরা থাকে সেখানেও বিমানের কার্যক্রম বাড়ানো দরকার।
কক্সবাজারের দীর্ঘতম প্রকৃতিক সমুদ্র সৈকতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আরো বিশদ পরিকল্পনা নেয়ার কথা তুলে ধরে মহেশখালীতে পর্যটকদের জন্য আবাসস্থান গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কিছু কিছু জায়গা বিদেশি পর্যটকদের জন্য সুনির্দিষ্ট করে দিতে পারি। সমুদ্রে সাঁতার কাটার সময়ে পর্যটকদের দুর্ঘটনা রোধে আরো সজাগ থাকতে হবে। কে কোথায় নামতে পারবে তা স্পষ্ট হওয়া উচিত। কোরাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের সৌন্দর্য রক্ষায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে আরো পরিকল্পিত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, এক সময় বাংলাদেশ বললেই বিদেশীরা একে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও দুর্নীতির দেশ হিসেবে মনে করত। ফলে বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ সংকট দেখা দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ওই বিরূপ পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ দেশের উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করায় বর্হিবিশ্বের আমাদের দেশ নিয়ে যে নেতিবাচক মনোভাবটি ছিল, সেটি আর এখন নেই। এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা তাঁর সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের বর্ণনা দিয়ে বলেন, দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার ফলে শিশু ও মাতৃ মৃত্যু হার অনেক কমে এসেছে। বিদ্যুত্ উত্পাদনেও আমাদের সক্ষমতা ১১ হাজার ৭ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। তিনি বলেন, বিশ্ব মন্দা সত্ত্বেও তাঁর সরকার প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের উপরে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। মাথা পিছু আয় বেড়ে ১ হাজার ৪৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) অর্জনেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সাফল্য ইর্ষণীয়। তিনি বলেন, আগে দেশে মাত্র ১টি টিভি চ্যানেল ছিল, এখন ২৭টি টিভি চ্যানেল হয়েছে। তাঁর সরকার তথ্য প্রবাহের অবাধ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বলেই এটি সম্ভব হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বেসামরিক বিমান পরিবহন এবং পর্যটন ক্ষেত্রে উন্নয়নের মাধ্যমে আমাদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির আরও সুযোগ রয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমরা ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন মন্ত্রণালয়ে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এর আগে কোনো সরকার প্রধান এই মন্ত্রণালয়ে আসেননি। বেসামরিক বিমান পরিবহন এবং পর্যটন খাতের সম্ভাবনা বিকাশে কিছু বাধা রয়েছে জানিয়ে তা কাটিয়ে ওঠার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবদুস সোবহান সিকদার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব আবুল কালাম আজাদ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন সচিব খোরশেদ আলম চৌধুরী, বাংলাদেশ বিমানের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) জামাল উদ্দিনসহ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সংস্থার প্রধানগণ ও সিনিয়র কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।