সুলতানুল হিন্দ গরীবে নাওয়ায (রাহ.) এর জীবনদর্শন

সুলতানুল হিন্দ গরীবে নাওয়ায (রাহ.) এর জীবনদর্শন

সুলতানুল হিন্দ গরীবে নাওয়ায (রাহ.) এর জীবনদর্শন

Khwajababaডক্টর শাহ্ কাওসার মুস্তাফা চিশ্তী আবুলউলায়ী

আজ ৬ই রজব ১৪৩৫ হিজরী সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তী আজমেরী (রাহ:) এর ৮০২ তম উরস মুবারক উদযাপিত হচ্ছে। ৬৩৩ হিজরী ৬ই রজব/১৬ মার্চ ১২৩৬ খ্রী: তিনি ভারতের আজমীর শহরে ইন্তেকাল করেন। তিনি যে কত বড় উচ্চমার্গের অলি ছিলেন তার নিদর্শন প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর ওফাতের ঠিক পর মুহূর্তেই। উপমহাদেশের বিখ্যাত আলেমে দীন হযরত শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (রাহ:) তাঁর আখ্বারুল আখিয়ার নামক সু-প্রসিদ্ধ গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, হযরত খাজা সাহেবের ললাটে তাঁর ইন্তেকালের পরপরই “হাবীবুল্লাহ মাতা ফী হুব্বিল্লাহ”(অর্থাত্ আল্লাহর হাবীব(প্রিয়তম) আল্লাহর প্রেমেই ইহ্ধাম ত্যাগ করেছেন) শীর্ষক বাক্যটি ফুটে ওঠে। তিনি উপমহাদেশে এসেছিলেন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়াসাল্লামের নায়েব হিসেবে। একথা সত্য যে, তার আগমনের বহু আগেই ইসলাম ও মুসলমানদের ভারতবর্ষে আগমন ঘটে এবং অনেক সুফী সাধক ইসলাম প্রচারে নিজেদের নিয়োজিত করেন। কিন্তু হযরত খাজা সাহেবের আগমনে ইসলাম প্রচারে এক বিপ্লব ঘটে এবং তা একটি সামাজিক বিপ্লবেও রূপান্তরিত হয়। তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে বিশেষ করে খ্রিষ্টীয় একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ চরম পর্যায়ে উপনীত হয়। উঁচু বর্ণের হিন্দু সমাজ তাদের স্ব-ধর্মের নিচু বর্ণের লোকদেরকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখতে থাকেন। সাধারণ মানুষ উচ্চ বর্ণের লোকদের দ্বারা কীভাবে নিগৃহীত হচ্ছিলেন তার বিবরণ আবু রায়হান আল-বিরূনীর কিতাবুল হিন্দ নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে।

হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তী (রাহ:) সেই সময় এই সব জাতিভেদ এবং স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যতার বেড়াজাল ছিন্ন করে তাওহীদের দর্শন প্রচার করেন। তাঁর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে দলে দলে লোক ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেয়া শুরু করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তী (রাহ:) ইরানের সিজিস্তান নামক স্থানে ৫৩৬/৫৩৭ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খাজা গিয়াসুদ্দীন হাসান। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। খাজা সাহেব ১৫ বছর বয়সে পিতৃহীন হন। পৈতৃক সূত্রে তিনি একটি ফলের বাগান লাভ করেছিলেন। ইব্রাহিম কান্দুযী নামক একজন মজ্জুব বুজুর্গের সংস্পর্শে এসে তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। তিনি তাঁর ফলের বাগান অন্যদের দান করে দুনিয়াত্যাগী একজন সাধক হিসাবে নতুন জীবন শুরু করেন। আল্লাহর রাস্তায় সফরকালীন সময় নিশাপুরের নিকটে হারূন বা হারভান নামক স্থানে চিশিতয়া তরীকার প্রখ্যাত শায়খ হযরত খাজা উসমান হারূনীর (অনেকের মতে হারভানী) সাথে সাক্ষাত্ ঘটে এবং তাঁর কাছে বায়আত গ্রহণ করেন। আখবারুল আখিয়ার নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, হজরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তী (রাহ:) দীর্ঘ ২০ বছর ধরে আপন পীর ও মুর্শেদের খিদমতে থেকে উচ্চতর আধ্যাত্মিক মর্যাদা লাভ করেন। পীর ও মুর্শিদ খাজা ওসমান হারূনী (রাহ:) তাকে খেলাফত প্রদান করেন এবং রাসূলুল্লাহর (স.) রওজায় হাজির হয়ে নবীয়ে কারীম (সা:) তাঁর নির্দেশ মত হেদায়েতের কাজে নিয়োজিত হওয়ার আদেশ প্রদান করেন। এই সূত্রে তিনি ভারতের আজমীরে পৌঁছান। সেখানকার রাজা ছিলেন পৃথ্বীরাজ। দিল্লীও তখন তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পৃথ্বীরাজ ছিলেন মুসলিম বিদ্বেষী। নিচু বর্ণের হিন্দুরাও তাঁর দ্বারা অত্যাচারিত হতেন। আজমীরে খাজা সাহেবের আগমনের ফলে দলে দলে লোক তাঁর দরবারে আসা শুরু করেন। এতে পৃথ্বীরাজ খাজা সাহেবের প্রতি অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন এবং তাঁর মুরীদ ও ভক্তদের সাথে দুর্ব্যবহার শুরু করেন। খাজা সাহেব পৃথ্বীরাজের এই ব্যবহারে অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং তাঁর পবিত্র জবান থেকে নিম্নোক্ত উদ্বৃতি বেরিয়ে আসে- “পিথ্রা যিন্দাহ্ গেরেফতাম, ওয়া মুসালমানান দাদেম” অর্থাত্ পৃথ্বীরাজকে জীবিত বন্দী করলাম এবং মুসলমানদের দান করলাম। পরে আফগানিস্তানের অন্তর্গত ঘোর প্রদেশের সাধনকর্তা মঈযুদ্দীন মুহাম্মদ বিন সাম ওরফে শাহাবুদ্দীন মুহাম্মদ ঘোরীর সাথে দিল্লীর সন্নিকটে অনুষ্ঠিত এক যুদ্ধে দেড়শ’ ভারতীয় রাজন্যবর্গসহ পরাজিত ও অবশেষে নিহত হন পৃথ্বীরাজ।

হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তীর দরবারে গরীব, ধনী সবাই সমান ভাবে সমাদৃত হতেন। গরীব মিসকিনকে তিনি অত্যন্ত ভালবাসতেন। এই জন্য তাঁর অত্যন্ত বহুল প্রচলিত উপাধি হলো গরীবে নাওয়ায। হযরত গরীবে নাওয়ায-এর রূহানী ফায়েযে এতো বিপুল সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন যে, ইতিহাসে আর কোন মনীষির হাতে এত অধিক লোক ইসলাম গ্রহণ করেছেন বলে উল্লেখ নেই। হযরত গরীবে নাওয়াযের হাতে প্রায় এক কোটি লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। আর এভাবেই সারা ভারতবর্ষে ইসলামের ব্যাপক প্রচার শুরু হয়।

আজ এই উপমহাদেশে,পঞ্চাশ কোটির অধিক মুসলমানের বাস। এর মূল ভিত হযরত গরীবে নাওয়ায স্থাপন করে গেছেন। তাঁর শিক্ষার মূল বিষয় ছিল আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টির প্রতি প্রেম। তাঁর কাছে খোদা প্রেমই সবচেয়ে বড় শক্তি। যে আল্লাহকে ভালবাসে সে কোন অপশক্তির কাছে মাথানত করে না। আজ সমাজে যে অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ-বঞ্চনা, হিংসা-বিদ্বেষ বিরাজ করছে তা নিরসনে সকলের খাজা গরীবে নাওয়াযের প্রেমের দর্শন থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। আর তিনি শিক্ষা নিয়েছিলেন আল্লাহর হাবীব রাহমাতাল্লীল আল-আমিন হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়াসাল্লামের জীবন দর্শন থেকে। নায়েবে নবী সুলতানুল হিন্দ হযরত গরীবে নাওয়াযের ৮০২তম উরসের এই দিনে প্রার্থনা করি তাঁর জীবন দর্শন অনুসরণের মাধ্যমে এই উপমহাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক। দূর হউক সব ধরনের হিংসা বিদ্বেষ এবং সকলে মহান আল্লাহর প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকে ভালবাসুক।

লেখক :সাজ্জাদাহ্নাশীন, খানকাহ্ আবুলউলাইয়া, কিশোরগঞ্জ ও প্রফেসর, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অন্যান্য অর্থ বাণিজ্য আন্তর্জাতিক জেলা সংবাদ বাংলাদেশ বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিনোদন রাজনীতি শীর্ষ খবর