দেশের খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ আর নেই। তিনি সোমবার ভোরে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লা…রাজেউন)।
তিনি অসুস্থ বোধ করলে সোমবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে বারডেম হাসপাতালে নেওয়া হয়। এখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। তিনি ডায়াবেটিসসহ বাধর্ক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন।
ফয়েজ আহমদ ১৯২৮ সালের ২ মে বিক্রমপুরের বাসাইলডোগ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবার নাম গোলাম মোস্তফা চৌধুরী। দেশভাগ, ৪২ সালের ভারত ছাড় আন্দোলন এবং বাংলা ৪২-৪৩ সালের মহামন্বন্তর তার ভেতরে পরিবর্তন আনে। তিনি যেন একটি ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। এইসব পারিপার্শ্বিকতা ফয়েজ আহমদকে আছন্ন করে রেখেছিল। তিনি তার বাড়িতে ভাইদের মধ্যে ব্যতিক্রমী চরিত্র হয়ে ওঠেন।
ব্যতিক্রমী চরিত্রের অধিকারী ফয়েজ আহমদ সাহিত্যের প্রতি দুর্বার টানে ১৯৪৪ সালে ১৬ বছর বয়সে স্কুল ফাঁকি দিয়ে কলকাতার সওগাত অফিসে পৌঁছাবার পর প্রথমে তার পরিচয় হয় বিখ্যাত দুই কবি আহসান হাবীব ও হাবীবুর রহমানের সঙ্গে। হাবীবুর রহমান ও আহসান হাবীব তাকে আরও লেখার জন্য উৎসাহিত করেন। শিশু সওগাতে প্রকাশিত ফয়েজ আহমদের লেখাটি প্রকৃতপক্ষে প্রকাশিত হয়েছিল বড়দের লেখা হিসেবে। ফয়েজ আহমদের সঙ্গে সওগাত পত্রিকার সবার একটি সুসম্পর্ক তৈরি হয়।
১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের পর ‘সওগাত’ পত্রিকা ঢাকায় চলে আসে। ‘সওগাত’ অফিসেই নাসিরুদ্দিন সাহেবের সর্বাত্মক সহযোগিতায় প্রগতি ও মুক্তবুদ্ধির ধারক হিসেবে পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের জন্ম হয়। ফয়েজ আহমদ সেসময় এই সংসদের প্রথম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঢাকায় একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলার অনন্য প্রয়াস নিয়েছিলেন।
পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি তিনি ১৯৪৮ সাল থেকেই সাংবাদিকতার সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েন। যারা এই ভূখণ্ডের সংবাদমাধ্যমকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন, ফয়েজ আহমদ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ইত্তেফাক, সংবাদ, আজাদ ও পরবর্তীতে পূর্বদেশের চিফ রিপোর্টার ছিলেন। তিনি সাপ্তাহিক ইনসাফ ও ইনসান পত্রিকায় রিপোর্টিং করেছেন। ১৯৫০ সালে ‘হুল্লোড়’ এবং ১৯৭১ সালে ‘স্বরাজ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি জাতীয় সংবাদ সংস্থার প্রথম প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন। পরে দৈনিক বঙ্গবার্তার প্রধান সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বিশেষভাবে জড়িত হন।
১৯৪৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ গঠিত হয়, তখন ফয়েজ আহমদ মওলানা ভাসানীর সঙ্গে আওয়ামী লীগে যোগদান করার সুযোগ পেয়েও যাননি। তবে তখনকার মুসলিম লীগের স্বৈরাচারি শাসকের বিরুদ্ধে যে যুব সমাজ দাঁড়িয়েছিল, তাদের অন্যতম হিসেবে বিশেষভাবে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পৃথক সত্তা নিয়ে ফয়েজ আহমদ আত্মপ্রকাশ করেন। আওয়ামী লীগ গঠনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কারাগারে ছিলেন। ফয়েজ আহমদের রাজনৈতিক জীবনপ্রণালীতে ক্রমান্বয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অঘোষিতভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তিনি জানতেন, ফয়েজ আহমদ বাম দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁদের দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ছিল সুগভীর।
ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার সময় ঢাকার পত্রিকাসমূহ ও সাংবাদিকদের প্রায় সবাই ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে ও এই মামলার বিপক্ষে। এর মধ্যে আজাদ পত্রিকা ছিল সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও সোচ্চার। ফয়েজ আহমদ তখন এই পত্রিকার চিফ রিপোর্টার হিসেবে অফিস থেকে এই মামলা কভারেজ করার দায়িত্ব পান। কিন্তু মামলা শুরু হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত সেনাবাহিনী রাজি ছিল না ফয়েজ আহমদকে এই মামলার রির্পোট করার অনুমতি দিতে।
আজাদ কর্তৃপক্ষ সেনাবাহিনীকে জানিয়েছিল যে, যদি তারা আজাদ পত্রিকার মনোনীত সাংবাদিক হিসেবে ফয়েজ আহমদকে ট্রাইব্যুনাল কভার করার জন্য যেতে না দেয়। তবে আজাদ পত্রিকা ট্রাইব্যুনালের কোনো নিঊজ ছাপবে না বা তার বদলে অন্য কোনো সাংবাদিককেও পাঠাবে না। মামলা আরম্ভ হওয়ার পর প্রথমদিন ভোর বেলা ফয়েজ আহমদ কার্ড পান। প্রথমদিন তারা ৬ পত্রিকার ৬ জন রির্পোটার রির্পোটিং করতে যান। কক্ষের সামনেই ডিএফআইর লোকজন তাদেরকে কারো সঙ্গে কথা না বলার জন্য সতর্ক করে দেয়। জজের ডানপাশে এক চিলতে জায়গায় সাংবাদিকদের বসার জায়গা করা হয়েছিল। ফয়েজ আহমদ কক্ষে প্রবেশ করেই প্রথম চেয়ারটায় বসে পড়েন।
বিচার শুরু হওয়ার ৫ মিনিট আগে অভিযুক্ত ৩৫ জনকে কাঠের বেড়া দেওয়া তাঁদের পাশের জায়গায় নিয়ে আসা হয়। সিরিয়াল অনুযায়ী প্রত্যেকের আসন নির্দিষ্ট ছিল । যেহেতু বঙ্গবন্ধু প্রধান আসামি, সেহেতু তিনি এক নম্বরে। তার আসন থেকে ফয়েজ আহমদের আসনের দুরত্ব ছিল দেড় হাত মাত্র। বিচার পর্ব শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে ফয়েজ আহমদ তার ডান উরুতে একটা আঘাত অনুভব করেন। সেই সঙ্গে এক নম্র কন্ঠস্বর ভেসে এলো- এই ফয়েজ! ৬ রিপোর্টার প্রথমদিন ভয়ে ছিলেন কখন কী ভুল হয়ে যায় তাদের! সেজন্য তারা জজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন আর মাঝে মাঝে কৌঁসুলিদের বক্তব্য শোনার জন্য তাদের দিকে ঘাড় ফেরাতেন। একটু পরে আবার তার উরুতে বঙ্গবন্ধু তার খালি পাইপের ডগা দিয়ে কয়েকটি আঘাত করলেন। ফয়েজ আহমদ জজের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন : “মুজিব ভাই কথা বলা নিষিদ্ধ। পরে কথা হবে।” তিনি আবার ডাকলেন : “এই ফয়েজ” ! এবার একটু জোরে। তখন মাথা নিচু করে ফয়েজ আহমদ বললেন, “কথা বলা নিষিদ্ধ মুজিব ভাই” । সেসময় শেখ মুজিব আশ্চর্যজনকভাবে উচ্চকন্ঠে বলে উঠলেন, “ফয়েজ, বাংলাদেশে থাকতে হলে শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলতে হবে।” স্তম্ভিত বিচারকক্ষের বিচারকরা, সব আইনজীবী ও উপস্থিত দর্শক সবাই অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে একথা শুনলেন!
সাংবাদিকতা করার সময় থেকে ফয়েজ আহমদ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটেরও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামী ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিক কারণেই ১৯৮২-৮৩ সালে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের জন্ম। তাঁর নেতৃত্বেই সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যেমন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছিল তেমনি ১৯৮৮ সালের মহাপ্লাবন, ১৯৯০ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সাধারণ মানুষের পাশে গিয়ে স্বত:স্ফূর্তভাবে দাঁড়িয়েছিল। এছাড়াও সেসময় তাঁর নেতৃত্বে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিরপেক্ষ সরকারের আমলে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করার অভিযানে চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূল থেকে রংপুর পর্যন্ত গণতন্ত্রের অভিযাত্রা আয়োজন করেছিল। নির্বাচনের পর পরই সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট অন্তর্বর্তীকালীন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি শাহবুদ্দিন আহমদের কাছে ১১ দফা সংবলিত একটি সাংস্কৃতিক দাবিনামা পেশ করে। এই দাবিনামা পরে ১৯৯১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার কাছেও উপস্থাপন করা হয়। প্রগতিশীল অসাম্প্রাদায়িক সংগঠন হিসেবে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট তাঁর কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এভাবে দ্রুত পৌঁছে যায় সাধারণ মানুষের কাছে। ১৩ বছর দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার পর তিনি জোট থেকে পদত্যাগ করেন।
’৮০র দশকে ফয়েজ আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ বছর ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ বছর সিণ্ডিকেটের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি জাতীয় কবিতা উৎসবের প্রথম ৫ বছর আহ্বায়ক ছিলেন। এছাড়া ১৯৮২ তে বাংলা একাডেমীর কাউন্সিল সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু পরে এরশাদের সামরিক শাসনের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত ফয়েজ আহমদ বিয়ে করেননি। তারা ৪ ভাই, ৫ বোন। ৯ ভাইবোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। ভাইদের কেউই বেঁচে নেই। একজন ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত হন। বাকি দু’ভাইয়ের একজন হৃদরোগে, অন্যজন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
কিশোর বয়স থেকেই ফয়েজ আহমদ বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত হন। ১৯৬০ সালে জেলে থাকা অবস্থায় অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি তাকে সদস্যপদ দেয় এবং গুরুত্বপূর্ণ দুটি কাজে নিয়োজিত করে। পার্টির নির্দেশে ১৯৫৪ সালে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্টদের সহায়তায় বিনা পাসপোর্টে তিনি ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক যুব সম্মেলনে যোগ দেন। এ জন্য তাকে ‘হিরো’ বলা হতো। এই সম্মেলনে ইরান থেকে ১৮ জন ও মেক্সিকো থেকে ৬ জন তার মতো গুপ্তপথে ও পরিচয়ে সম্মেলনে যোগ দেন।
পাকিস্তানের সাবেক সামরিক শাসক আইয়ুব খানের আমলে তিনি ১৯৫৯ সাল থেকে ৪ বছর কারাবন্দি ছিলেন। হাইকোর্ট গঠিত বোর্ডের মাধ্যমে বিচারের পর তিনি মুক্তি পান। কিন্তু জেলগেটেই ১ বছরের জন্য তার ঢাকা শহরের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয় এবং রমনা থানা এলাকায় নজরবন্দি করে রাখা হয়। এভাবেই তার জীবনের ৫ বছর অতিবাহিত হয়। একইভাবে বাংলাদেশেও তিনি সামরিক শাসক এরশাদের আমলে আর একবার কারাগারে গিয়েছেন। রাজনৈতিক কারণে ৩ বার দীর্ঘ সময়ের জন্য তাকে আণ্ডারগ্রাইন্ডে থাকতে হয়েছে।
১৯৫৭ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত প্রথম এশীয় লেখক সম্মেলনে, ১৯৯৫ সালে কিউবার হাভানায় অনুষ্ঠিত মার্কিন ব্লকেড বিরোধী সম্মেলনে এবং একই বিষয়ের ওপর ভিয়েতনামের হ্যানয়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যোগদান করেন।
সর্বশেষে ১৯৯৮ সালে উত্তর আমেরিকার নিউইয়র্কে বাঙালিদের ‘ফোবানা’ মহাসম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন। তিনি ‘মাস্টার দা সূর্যসেন স্মৃতি কমিটির’ প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ শক্তি ও জামায়াতের বিরুদ্ধে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। এই কমিটি ১৯৯২ সালে গণ-আদালত তৈরি করে। তিনি সেই গণআদালতের ১১ জন বিচারকের মধ্যে অন্যতম একজন বিচারক ছিলেন। এই গণআদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে ২৪ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল, তিনিও তাঁদের মধ্যে একজন। এই মামলার আসামি হিসেবে তিনি ৫ বছর জামিনে ছিলেন।
তিনি ঢাকার প্রাচীন ও সুবৃহৎ আর্ট গ্যালারি ‘শিল্পাঙ্গণ’ এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৯২ সালে। তিনি প্রগতিশীল পাঠাগার ‘সমাজতান্ত্রিক আর্কাইভ’ এর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৬৬ সালে পিকিং রেডিওতে বাংলা ভাষার অনুষ্ঠান শুরু করার জন্যে ৩ বছর মেয়াদে নিযুক্ত হন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম আর নেতৃত্বের ফলে অল্প সময়েই পিকিং রেডিওতে বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। সে সময় চীনে কালচারাল রেভ্যুলিউশন শুরু হয়। এছাড়া তিনি ঢাকা রেডিওতে ১৯৫২-৫৪ সালে ‘সবুজ মেলা’ নামের ছোটদের বিভাগটি পরিচালনা করতেন।
মুক্তিযুদ্ধে ফয়েজ আহমদ-এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। পাকিস্তানের প্রথম যুগে যেসব তরুণরা নানা ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান শাসনের বিরুদ্ধে দেশের মানুষদের সংগঠিত করার জন্য কাজ করেছেন, তিনি তাঁদেরই একজন। এজন্য তাঁকে দীর্ঘকাল আত্মগোপন করতে হয়েছে। তিনি যুব সম্মেলন এবং শান্তি সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। দেশে তাঁর নামে হুলিয়া বেরিয়েছে। মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে বিলেতে, কলকাতায় কাটিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবাসী সরকারে যোগ দেননি, কিন্তু প্রবাসী সরকারের সংবাদ সারাবিশ্বে প্রচারের জন্য সরকারের নেতারা তাঁর ওপর অনেকখানি নির্ভর করতেন। ঢাকা মুক্ত হওয়ার সময় প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে ২২ ডিসেম্বর যে অগ্রবর্তী দলটিকে ঢাকায় পাঠানো হয়, তিনি সেই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তিনি প্রেসক্লাবে ছিলেন। ভোরে ট্যাঙ্ক দিয়ে পাকিবাহিনী প্রেসক্লাবের দোতালায় তাঁর আশ্রয় কক্ষে গোলাবর্ষণ করে। তিনি বাঁ পায়ের উরুতে আঘাত পেয়ে মেঝেতে পড়ে থাকেন। পরে জ্ঞান ফিরে পেয়ে তিনি সচিবালয়ে আশ্রয় নেন এবং ২৭ মার্চ সকালে চিকিৎসার জন্য বেরিয়ে যান। কেবিনেটের অনুরোধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান করেন এবং সেখানে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের ওপর পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে শেষ দিন পর্যন্ত লিখেছেন।
গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিশেষ বিশেষ সময়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৭ সালের দিকে যখন এরশাদের সামরিক শাসন বিরোধী গণআন্দোলন চলছে, তখন আন্দোলনকে বেগবান করার স্বার্থে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সামনাসামনি বৈঠকের প্রয়োজন তীব্রভাবে অনুভূত হলেও নানা কারণে তা সম্ভব হচ্ছিল না। একমাত্র ফয়েজ আহমদের উদ্যোগেই তা সম্ভব হয়েছিল। প্রথমবারের মতো দুই নেত্রী ১৯৮৮ সালের অক্টোবর মাসে মুখোমুখি বসে আলোচনা করেন। এই ঘটনাটি সে সময় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে।
কর্মজীবন এবং রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি ফয়েজ আহমদ প্রধানত শিশুকিশোরদের জন্য ছড়া ও কবিতা লিখেছেন। তাঁর বইয়ের সংখ্যা প্রায় একশ। এর মধ্যে শিশুকিশোরদের জন্য বই রয়েছে ৬০টি। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী শিশুদের জন্য রচিত তাঁর ৪টি বই ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। এর মধ্যে কবীর চৌধূরীর ইংরেজিতে অনূদিত ১০০টি ছড়ার একটি বই বাংলা একাডেমী ২০০৮ সালে প্রকাশ করেছে।
তার লেখা ছড়া নিয়ে একটি আবৃত্তি ও সঙ্গীতের ক্যাসেট বেরিয়েছে। ফয়েজ আহমদের বইগুলোর মধ্যে ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ সবচেয়ে বিখ্যাত। এটি তাঁর শ্রেষ্ঠগ্রন্থ বলে বিবেচিত। ছড়ার বইয়ের মধ্যে-’হে কিশোর’, ‘কামরুল হাসানের চিত্রশালায়’, ‘গুচ্ছু ছড়া’, ‘রিমঝিম’, ‘বোঁ বোঁ কাট্টা’, ‘পুতলি’ ‘টুং’, ‘জোনাকী’, ‘জুড়ি নেই’, ‘ত্রিয়ং’, ‘তুলির সাথে লড়াই’, ‘টিউটিউ’, ‘একালের ছড়া’, ‘ছড়ায় ছড়ায় ২০০’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তিনি চীনসহ বিভিন্ন দেশের ৫টি বই অনুবাদ করেছেন। এর মধ্যে হোচিমিনের জেলের কবিতা উল্লেখযোগ্য।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য ফয়েজ আহমদ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলা একাডেমী পুরস্কার, শিশু একাডেমী পুরস্কার, সাব্বির সাহিত্য পুরস্কার। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য ১৯৯১ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। শিশু সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে নুরুল কাদের শিশু সাহিত্য ও মোদাব্বের হোসেন আরা শিশু সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয়।