দুইদফা স্থগিত হওয়ার পর অবশেষে বদলির আদেশ হয়েছে শেরপুরের ‘বিতর্কিত’ চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট সেলিম মিয়ার। ‘বিতর্কিত’ বলা হচ্ছে এই কারণে যে, শেরপুর জেলা আইজীবী সমিতির ঐতিহ্য অনুযায়ী বিচারকদের বদলির ক্ষেত্রে বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজনের প্রথা থাকলেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন আইজীবীরো। এমনকি কোনো কারণে সেলিম মিয়ার বদলি উপলক্ষে বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করা হলে সেখানে কালো পতাকা উত্তোলনসহ আইজীবীদের একটি অংশ বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে এটি একই কর্মস্থল থেকে সেলিম মিয়ার তৃতীয় বদলির আদেশ। এর আগে একদফা ফরিদপুরে বদলি হলেও তার বদলির আদেশ জারি করেনি আইন মন্ত্রণালয়। এছাড়া ঢাকায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে উপ সচিব (আইন) পদে ডেপুটেশনের আদেশটি হওয়ার পর আবারো স্থগিত হয়ে যায়।
আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র সমূহ জানিয়েছেন, ২০১৩ সালের শেষ দিকে তাকে ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা জজ পদে পদায়নের জন্য মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে প্রস্তাব প্রেরণ করে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সেই প্রস্তাব বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের ‘জিএ’ (জেনারেল এডমিনিস্ট্রেশন ) কমিটি অনুমোদনও করে। কিন্তু হাইকোর্টের অনুমোদিত সেই বদলিটির প্রজ্ঞাপন জারী হয়নি। পরবর্তীতে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ ফরিদপুরে অতিরিক্ত জেলা জজ পদে অপর আরেকজনকে পদায়নের জন্য এবং সেলিম মিয়াকে বরিশালে মেট্রোপলিটন চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট হিসাবে পদায়নের জন্য হাইকোর্টে প্রস্তাব প্রেরণ করে । হাইকোর্টের জিএ কমিটি ফরিদপুরে অতিরিক্ত জেলা জজ পদে সেলিম মিয়ার জায়গায় অপর বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার পদায়নের প্রস্তাব অনুমোদন করলেও বরিশালের চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট পদে সেলিম মিয়ার পদায়নের প্রস্তাব অনুমোদন করেননি।
পরবর্তীতে সেলিম মিয়াকে ঢাকায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে উপ সচিব (আইন) পদে ডেপুটেশনে পদায়নের জন্য হাইকোর্টে প্রস্তাব প্রেরণ করে আইন মন্ত্রণালয়। সেই প্রস্তাবটি হাইকোর্টের জিএ কমিটি অনুমোদন করলে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের বিচার শাখা-৩-এর স্মারক নং- ১৯৯-বিচার-৩/১টি-০২/২০০৮(অংশ), তারিখ : ০৪.০৩.১৪ মোতাবেক অপরাপর কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে সেলিম মিয়ারও বদলির আদেশ হয়। সেলিম মিয়াকে ১৩ মার্চ, ২০১৪ ইং তারিখে দায়িত্বভার হস্তান্তর করে নতুন কর্মস্থলে যোগদানের জন্য মন্ত্রনালয়ের আদেশে বলা হয়। কিন্তু বিশেষ একটি সুবিধাভোগী মহল সেই আদেশটি স্থগিত করে বলে শেরপুরের বিচারাঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এ ধরনের অফিস আদেশ প্রকাশিত হলেও সেলিম মিয়ার বদলি স্থগিতের আদেশটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়নি।
সর্বশেষ বিগত ২১.০৪.২০১৪ তারিখে আইন , বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের বিচার শাখা-৩ -এর স্মারক নং- ২৯৪-বিচার-৩/১টি-০২/২০০৮ মোতাবেক সেলিম মিয়াকে আগামী ২৭ এপ্রিল তারিখে দায়িত্বভার হস্তান্তর করে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে উপ সচিব (আইন) পদে যোগদানের জন্য বলা হয়েছে। তবে আদেশটি হওয়ার পর শেরপুরের বিশেষ একটি সুবিধাভোগী মহল সেলিম মিয়ার বদলি স্থগিতের জন্য দৌড়ঝাপ শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে তার বদলির আদেশে আইনজীবীদের একটা অংশ উল্লাস প্রকাশ করেছে। শেরপুরের আইনজীবীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রথা অনুযায়ী শেরপুর থেকে কোনো বিচারিক কর্মকর্তা বদলি হলে তার দায়িত্বভার হস্তান্তরের দিনে জেলা আইজীবী সমিতি বিদায়ী সংবর্ধনার আয়োজন করে থাকে। কিন্তু সেলিম মিয়ার বিদায় সংবর্ধনা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে জেলা বার।
সহযোগী একটি অনলাইন টাইমস এসব বিষয় নিয়ে ‘শেরপুরে আইনজীবীদের বিভক্তি’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ করেছে। ওই খবরে বলা হয়েছে, শেরপুরের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট সেলিম মিয়ার বিদায় সংবর্ধনাকে কেন্দ্র করে জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্যরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। আদালত অঙ্গনে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে আইনজীবী সমিতির সদস্যদের একাংশ চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটকে বিদায় সংবর্ধনা না দেয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। আর আইনজীবী সমিতির সভাপতিসহ আরেক অংশের সদস্যরা তাকে সংবর্ধনা দেবেন এমন সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন।
বিদায় সংবর্ধনা নিয়ে দুই মেরুতে অবস্থানকারী আইনজীবীদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। যে কোন মুহূর্তে এ নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার সম্ভাবনার আশংকা করছেন অনেকেই।
আইনজীবী সমিতির একাধিক সূত্র জানায়, শেরপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল আইনজীবী বৃহস্পতিবার বিকেলে বর্তমান সভাপতি অ্যাডভোকেট একেএম মোছাদ্দেক ফেরদৌসী এবং সাধারণ সম্পাদক অ্যডভোকেট মোঃ রফিকুল ইসলাম আধারের সঙ্গে দেখা করে বিচারকের মন মানসিকতা নিয়ে বিচারকাজ পরিচালনা না করায় এবং জামিন বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত বিতর্কিত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট সেলিম মিয়াকে সংবর্ধনা না দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এ সময় বিষয়টি বিবেচনা করে দেখবেন বলেও আইনজীবী সমিতির সভাপতি ওই আইনজীবীদের কথা দেন। কিন্তু সমিতির কার্যকরী পরিষদের সভায় বৃহস্পতিবার বিকেলেই এই বিতর্কিত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অফিস কক্ষে ক্ষুদ্র পরিসরে সংবর্ধনা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় । এ খবর জানার পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে সংবর্ধনা বিরোধী আইনজীবীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
এ ব্যাপারে জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম আধার বৃহস্পতিবার রাতে বলেন, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কার্যকরী পরিষদের সভায় বার ও বেঞ্চের সম্মান রক্ষার্থে পুরনো রীতি অনুযায়ী আগামী রোববার সকাল ১০টায় জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অফিস কক্ষে চা পানের মাধ্যমে চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট সেলিম মিয়াকে বিদায় সংবর্ধনা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
এদিকে সংবর্ধনা না দেয়ার পক্ষের আইনজীবী নেতা জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বৃহস্পতিবার রাতে বলেন, সাধারণ আইনজীবীদের অনুরোধকে পাশ কাটিয়ে একতরফাভাবে সংবর্ধনার সিদ্ধান্ত একটি অন্যায় কাজ। আমরা এমন কাজ নীতিগতভাবেই কিছুতেই হতে দিতে পারি না। এ কাজকে আমরা আইনজীবী সমিতিকে বিভক্তি করার সামিল বলে মনে করি।
সংবর্ধনা বিরোধী আইনজীবীদের এক সভা বৃহস্পতিবার রাতে অ্যাডভোকেট রৌশনারা বেগমের বটতলার চেম্বারে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় আগামী রোববার সকাল সাড়ে ৯টায় শেরপুর জেলা আইনজীবী সমিতির ২নং ভবনের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ এবং ওই বিতর্কিত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটকে কালো পতাকা প্রদর্শনের কর্মসূচী গ্রহন করা হয়েছে। ওই সভায় উপস্থিত অ্যাডভোকেট তৌহিদুর রহমান, অ্যাডভোকেট শাহীন হাসান খান ও অ্যাডভোকেট এমকে মুরাদুজ্জামান বলেন, সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে কোনো অবস্থাতেই ঘুষখোর ও দুর্ণীতিবাজ চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট মোঃ সেলিম মিয়ার বিদায় সংবর্ধনা দিতে দেয়া হবে না। সাধারণ আইনজীবীরা যেকোনো মুল্যে তা প্রতিহত করবে।