সকাল ৯টার পরের ঘটনা একাধিক পোশাক কারখানা ও অন্যান্য দোকানের চার হাজারের বেশী শ্রমিক, কর্মচারী-কর্মকর্তা এবং মালিকরা কর্মব্যস্ততায় মুখর- এরই মাঝে হঠাৎ ধসে পড়ে বহুতল ভবনটি। মুহুর্তেই কান্না আর আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছিলো গোটা দেশ। লাশের মিছিল আর শোকে স্তব্ধ হয়েছিলো চারদিক।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধস ট্রাজেডীর সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার এক বছর পার হলেও দায়ীদের শাস্তি হয়নি। এ ঘটনায় দায়েরকৃত সবগুলো মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তবে তদন্ত শেষ পর্যায়ে বলে জানিয়েছে তারা। শিগগিরই চার্জশিট দাখিল করা হবে বলে আশাবাদ সিআইডির।
সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, চার্জশিটে মামলার ধারায় পরিবর্তন আসতে পারে। একটি মামলা দন্ডবিধির ৩০৪/ক ধারায় দায়ের করা হলেও, আদালতে চার্জশিট ৩০২/৩৪ ধারায় চার্জশিট দেয়া হতে পারে। এই ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
এদিকে ঘটনার মূল অভিযুক্ত রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ মোট একুশ জনকে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হলেও এদের মধ্যে আটজনই জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। আর ওই ভবনে থাকা গার্মেন্টসের মালিক এক বিদেশী নাগরিক ঘটনার পর বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। এ পর্যন্ত তিনি ফেরেননি।
এছাড়া রানা প্লাজা ধসের বছর পেরিয়েও সেই দুঃসহ যন্ত্রণা আর ভয়াবহ স্মৃতি পিছু ছাড়ছে না উদ্ধারকাজে অংশ নেয়া মানুষগুলোকে। কেউ কেউ এখন মানসিক রোগী, এখনো ছুটে বেড়ান সেই ধ্বংসস্তূপের আশেপাশে।
অন্যদিকে নিহতদের মধ্যে যাদের মৃতদেহ বা দেহের অংশ পাওয়া গেছে- এর ৮৭ জনের পরিচয় এখনও মেলেনি। আর আহতদের মধ্যে ৭৪ শতাংশ বেকারত্বের দু:সহ অভিশাপ নিয়ে বেঁচে আছেন। এ ঘটনায় ১৭ দিন পর ধংসস্তূপের ভেতর থেকে জীবিত উদ্ধার হওয়া রেশমার জীবন গতি পেলেও, সেই স্মৃতি আজও তাকে তাড়া করে ফেরে। সম্প্রতি রেশমা তার কর্মস্থল হোটেল ওয়েস্টিন থেকে এক মাসের ছুটি নিয়ে রানা প্লাজার খুব কাছাকাছি অবস্থিত তার বোনের বাসায় বেড়াতে গিয়েছেন। সেখানে সাংবাদিকদের তিনি জানান, এ ঘটনা তিনি আর মনে করতে চান না।
অন্যদিকে এ ট্রাজেডির এক বছর পূর্ণ হওয়া উপলক্ষ্যে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এক বছর আগে রানা প্লাজা ভবন ধসে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকরা আজও তাদের আঘাত ও আয়ের সংস্থানহীনতায় ভুগছে। আন্তর্জাতিক পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও আর্থিক সহযোগিতায় যথাযথ অবদান রাখেনি।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তত্ত্বাবধানে গঠিত ‘রানা প্লাজা ট্রাস্ট ফান্ডে’র লক্ষ্য হচ্ছে ৪ কোটি ডলার সংগ্রহ করা। কিন্তু, এ পর্যন্ত মাত্র দেড় কোটি ডলারের তহবিল সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে পড়ে। ঢাকা জেলা প্রশাসক অফিসে রক্ষিত হিসাব অনুযায়ী, রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপ থেকে দুই হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত এবং এক হাজার ১১৭ জনকে মৃত উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরো ১৯ জন মারা যান। মৃত উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ৮৪৪ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা রেখে ২৯১ জনের অসনাক্তকৃত লাশ জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। জীবিত উদ্ধারকৃতদের মধ্যে এক হাজার পাঁচশ’ ২৪ জন আহত হন। তদের মধ্যে গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন ৭৮ জন।
মামলাগুলো যে পর্যায়ে: রানা প্লাজা ট্রাজেডির ঘটনায় মোট তিনটি মামলা দায়ের হয়। তিনটি মামলার মধ্যে একটির বাদি পুলিশ। ওই মামলায় ভবন ত্রুটিপূর্ণ জেনেও শ্রমিকদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। আর সরাসরি হত্যার অভিযোগ এনে আরেকটি মামলা দায়ের করেন নিহত শ্রমিক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী শিউলী আক্তার। অপর মামলাটি বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করার অভিযোগে এনে দায়ের করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। তিনটি মামলাই তদন্ত করছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর।
তিনি জানান, আগামী মাসে চার্জশিট দাখিল করা সম্ভব হবে। মামলার তদন্তের কাজ প্রায় শেষ। ভবন ধসের ঘটনায় ভবনের মালিক সোহেল রানা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে আদালতে মে মাসে চার্জশিট দেওয়া হবে। এই মুহূর্তে আমরা আমাদের কাজে কোথাও কোনো ফাঁকফোকর আছে কি না তা খুটিয়ে দেখছি। তদন্ত শেষে মামলার ধারার পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু তার যাতে সর্বোচ্চ সাজা হয়, সেটার ব্যবস্থা আমরা করব। প্রথম মামলাটি দণ্ডবিধির ৩০৪/ক ধারায় দেওয়া হলেও, আমরা আদালতে চার্জশিট ৩০২/৩৪ ধারায় চার্জশিট দেব। এই ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
এক বছর তদন্ত করে কি ধরনের অগ্রগতি পেয়েছেন, এ প্রশ্নের জবাবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, সোহেল রানার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। প্রায় আটশ মানুষের সাক্ষ্য নিয়েছি আমরা। যেসব সাক্ষ্য প্রমাণ পেয়েছি, তার ভিত্তিতেই চার্জশিট দেব।
সোহেল রানার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ব্যাখ্যা করে এই তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, একাধারে সে জমি ও ভবনের মালিক। জমিতে তার বাবা, মা ও তার অংশীদারিত্ব আছে। ফাটল ধরার পরও শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সে কোনো সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। দুর্ঘটনার দিন সে শ্রমিকদের কাজে যেতে বাধ্য করেছে। ভবন নির্মাণের সময় সে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করেছে এবং ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত আইন লঙ্ঘন করেছে। একই সাথে রানা প্লাজায় যে সমস্ত গার্মেন্টস ছিল, সেসব গার্মেন্টস মালিকদেরও মামলায় আসামি করা হয়েছে।
কারণ হিসেবে বিনয় কৃষ্ণ বলেন, রানা প্লাজা তৈরী হয়েছিল বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে। কিন্তু এর ফ্লোরগুলো ভাড়া নেওয়া হয়েছে কারখানা হিসেবে। তারা জেনে বুঝে প্রত্যেকটা ফ্লোরে জেনারেটরসহ ভারি মেশিন ব্যবহার করেছে যা বাণিজ্যিক ফ্লোরে ব্যবহার করার কথা নয়। এসব গার্মেন্টস মালিকরা দুর্ঘটনার দিন শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেছিল বলে আমরা সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেয়েছি।
রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা ও রানার বাবা ছাড়াও রানা প্লাজার পাঁচটি পোশাক কারখানার মালিক-কর্মকর্তা এবং স্প্যানিশ নাগরিক ডেভিড মেয়রসহ ৮ জনকে প্রাথমিকভাবে এই মামলার আসামি করা হয়েছিল। তবে ডেভিড মেয়র রানা প্লাজা ধসের পর আর বাংলাদেশে ফিরে আসেননি। প্রাণহানির দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনার এ মামলায় গ্রেফতার হওয়া আসামিদের মধ্যে রানা প্লাজার মালিক যুবলীগ নেতা সোহেল রানার বাবা আবদুল খালেকসহ আট জন জামিনে রয়েছেন।
গ্রেফতারকৃত ২১ জনের মধ্যে ওই আট জন গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে হাইকোট থেকে জামিন পান। আর রানা প্লাজা ট্রাজেডির মূল হোতা সোহেল রানাকে জামিন দেয়া হলেও পরে তা স্থগিত করা হয়। বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি নাজমুল হক ও বিচারপতি মোশরেফা হোসেন, বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কাশেফা হাসান ও বিচারপতি নাজমুল হকের বেঞ্চ বিভিন্ন সময় তাদের জামিন মঞ্জুর করেছেন।
জামিনে মুক্ত হওয়া অপর সাত আসামি হলেন-সাভার পৌরসভার বরখাস্ত হওয়া মেয়র ও পৌর বিএনপির সভাপতি রেফাতউল্লাহ, সোহেল রানাকে যশোরে আত্মগোপনে থাকতে সহায়তাকারী অনিল দাস, শাহ আলম ও আবুল হাসান, রানা প্লাজার অনুমোদন ও নির্মাণ-প্রক্রিয়া তদারকির দায়িত্বে থাকা পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী এমতেশাম হোসেন, রানা প্লাজার নকশা অনুমোদনের জন্য সুপারিশকারী সাভার পৌরসভার সাত নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার ও পৌরসভা যুবদলের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খান ও সাভার পৌরসভার উপসহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটির মালিক সোহেল রানার একশ’ ৭৫ শতক জমি বাজেয়াপ্ত করে ঢাকা জেলা প্রশাসন।
এইচআরডব্লিউ যা বলছে: রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্তরা এখন দুর্গতি ও চরম দারিদ্রের ভয়াবহ ঝুঁকিতে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) ওয়েবসাইটে ‘বাংলাদেশ: রানা প্লাজা ভিকটিমস আর্জেন্টলি নিড অ্যাসিস্ট্যান্স’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এক বছর পরও বহু আন্তর্জাতিক পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতার হাত না বাড়ানোর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। এইচআরডব্লিউ’র এশিয়া অঞ্চলের ডেপুটি পরিচালক ফিল রবার্টসন বলছেন, বিদেশী রিটেইল প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত আহতদের এবং নিহত পোশাক শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোকে সহযোগিতা করা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এক বছর আগে রানা প্লাজা ভবন ধসে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকরা আজও তাদের আঘাত ও আয়ের সংস্থানহীনতায় ভুগছে। আন্তর্জাতিক পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও আর্থিক সহযোগিতায় যথাযথ অবদান রাখেনি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তত্ত্বাবধানে গঠিত ‘রানা প্লাজা ট্রাস্ট ফান্ডে’র লক্ষ্য হচ্ছে ৪ কোটি ডলার সংগ্রহ করা। কিন্তু, এ পর্যন্ত মাত্র দেড় কোটি ডলারের তহবিল সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।
বুধবার সরকারের এক ঘোষণায় বলা হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্তদের প্রত্যেকে তহবিল থেকে আর্থিক সহযোগিতার প্রথম ধাপে ৬৪৫ ডলার করে পাবেন। এইচআরডব্লিউ’র কাছে জানানো আবেদনে রানা প্লাজা ধসে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন তারা জীবনের মোড় পরিবর্তনকারী শারীরিক ও মানসিক আঘাতে এবং আয়ের সংস্থানহীনতায় ভুগছেন। কেউ কেউ বলেছেন, তারা তাদের পরিবারের সদস্যদের খাবারের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন ও সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারছেন না। ধসের আগে রানা প্লাজার কাজের পরিবেশের নিম্নমানের কথাও এইচআরডব্লিউ’কে জানান তারা।
প্রতীকী ফান্ড: রানা প্লাজা ধসের এক বছর পার হওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপুরণ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর তত্বাবধানে বিদেশী ক্রেতাদের দেওয়া অর্থে ‘রানা প্লাজা ডোনার ট্রাস্ট ফান্ড’ নামে যে তহবিল হয়েছে, সেখানে থেকে দুজনকে প্রতীকী ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। প্রাথমিকভাবে তাদেরকে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। বাকিদের প্রত্যেককেই মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা করে দেয়া হবে বলে জানা গেছে।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন ইন্ডাস্ট্রিয়ালের বাংলাদেশ শাখার কর্মকর্তা রায় রমেশ চন্দ্র বলেন, মার্চ মাস থেকে শ্রমিকদের নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং তা আরো দু মাস ধরে চলবে।
বিশেষ ট্রাইব্যুনাল দাবি: রানা প্লাজা ধসে দায়ীদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার করার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন। গার্মেন্টস শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ইসমাইল বলেন, রানা প্লাজা ধসের শিরোমণি রানাকে বাঁচানোর জন্য একটি গ্রুপ এখনো সক্রিয়। তার বড় প্রমাণ তিনি একটি মামলায় ইতোমধেই জামিন পেয়েছেন।
তিনি জানান, রানা প্লাজা ধসের মধ্যমনি রানাসহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার করতে হবে, যাতে করে এই কালো অধ্যায় বাংলার মাটিতে পুনরাবৃত্তি যেন না হয়। ভবনের মালিকসহ, নকশাকারী ও গার্মেন্টস মালিককেও এই বিচারের আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, ২৪ এপ্রিলকে স্মরণীয় করে রাখতে শোকদিবসের ঘোষণা করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ৪৮ লাখ টাকা, আহতের পুনর্বাসন ও আহতের উন্নত চিকিৎসা দিতে হবে।
৭৪ ভাগ বেকার: রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের বেশিরভাগের জীবন কাটছে আর্থিক কষ্টে। এদের ৬৭ শতাংশের দৈনন্দিন জীবন কাটছে অতি কষ্টে। এর মধ্যে প্রায় ৩ শতাংশ কোনোভাবেই এই ব্যয় মেটাতে পারছে না। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে এখনও ৭৪ শতাংশ শ্রমিক বেকার। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি নিয়ে উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইড পরিচালিত এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির হতাহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ তহবিলের ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা এবং সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আইনগত বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা হয়নি। এ কারণে কেউ একাধিক বার ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। আবার অনেকে একবারও পাননি।
জরিপে আরও বলা হয়, ওই দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ১ হাজার ৪৩৬ জনের মধ্যে ৭৪ শতাংশই এখনও কাজে ফিরতে পারেনি। কারণ হিসেবে জরিপে ৬৪ শতাংশের ক্ষেত্রে শারীরিক সমসা, ২৪ শতাংশের ক্ষেত্রে মানসিক সমস্যা রয়েছে। এ ছাড়া ৭ শতাংশ শ্রমিককে নিয়োগ দিতে রাজি হয়নি কারখানা মালিকরা। রানা প্লাজা ধসে নিহত পরিবারগুলোর ৭৮৬ জন এবং বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে ১ হাজার ৪৩৪ জনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে এ জরিপ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
অজ্ঞাত ৮৭: ভয়বাহ এই ট্র্যাজেডিতে নিহতদের অজ্ঞাত ২৯৪ জনের মধ্যে এ পর্যন্ত ডিএনও পরীক্ষায় ২০৭ জনের মৃতদেহ শনাক্ত করা হয়েছে৷ বাকি ৮৭ জনের মৃতদেহের পরিচয় এখনো জানা যায়নি৷ এদিকে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের নাম ও পরিচয় নিশ্চিত করতে তাদের আত্মীয়স্বজনের নতুন করে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের জন্য সরকার গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷
জাতীয় ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির প্রধান অধ্যাপক ড. শরীফ আখতারুজ্জামান জানিয়েছেন, রানা প্লাজা ধসে নিহত অজ্ঞাত মৃতদেহের ডিএনএ প্রোফাইল তৈরির পর লাশ শনাক্ত করতে ৫৪১টি পরিবার থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়৷ তাদের সঙ্গে মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ২০৭টি লাশ শনাক্ত করা গেছে৷
তিনি জানান, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় নিহত ১,১৩৪ জনের মধ্যে ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়াই ৮শ’র বেশি লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়৷ এ সব পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অশনাক্ত লাশগুলোর ডিএনএ মিলে যেতে পারে৷
কেমন আছেন উদ্ধারকর্মীরা: রানা প্লাজা ধসের বছর পেরিয়েও সেই দুঃসহ যন্ত্রণা আর ভয়াবহ স্মৃতি পিছু ছাড়ছে না উদ্ধারকাজে অংশ নেয়া মানুষগুলোকে। কেউ কেউ এখন মানসিক রোগী, এখনো ছুটে বেড়ান সেই ধ্বংসস্তূপের আশেপাশে। তাদেরই একজন রফিকুল ইসলাম। ধসের শুরুর দিন থেকে টানা ২১ দিন উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। উদ্ধারকাজে টানা অংশ নিয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন রাজমিস্ত্রী রফিকুল। পরে তার স্থান হয় শেরেবাংলা নগরের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে। রফিকুল দীর্ঘ এক বছরেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেননি। এখনো নিয়ম করে স্যালাইন বানিয়ে ছুটে যান রানা প্লাজায় ‘আটকে পড়াদের’ খাওয়াবেন বলে! বাবার অসুস্থতায় বন্ধ হয়ে গেছে দুই মেয়ে ও এক ছেলের পড়াশোনা। ধার-দেনা করে কোনোমতে হাসপাতালের দেয়া ব্যবস্থাপত্রের ওষুধ জোগাড় করলেও ঢাকায় এসে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারছেন না রফিকুল। গতবছর ২৪ এপ্রিল রফিকুল যখন রানা প্লাজায় ছুটে আসেন তার স্ত্রী তখন অন্তঃসত্ত্বা। ফলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ২১ দিন চিকিৎসা নেয়ার পর সাভারে ফিরে যেতে হয় তাদের। ঢাকায় চিকিৎসা নেয়ার কথাও স্মরণ করতে পারছিলেন না রফিকুল। উদ্ধারকাজে অংশ নেয়া মানবতার টানে ছুটে আসা এই মানুষগুলোর নির্দিষ্ট কোনো তথ্য না থাকলেও সে সংখ্যা হাজারের কম হবে না বলেই নানা সূত্রে জানা গেছে।
এর সঙ্গে যোগ দেন কয়েকশ’ ফায়ার সার্ভিসকর্মী। এই ধরনের উদ্ধারকাজে অংশ নেয়ার পরে প্রশিক্ষিত ফায়ার সার্ভিসকর্মীদের তেমন কোনো মানসিক সমস্যা হয়নি বলেই জানালেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান।
অন্যদিকে এনআইএমএইচে দেড় মাস চিকিৎসার পরে এখন অনেকটা সুস্থ রাজীব নামের এক উদ্ধারকর্মী। তিনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গাড়ি চালক। সুস্থ হয়ে কাজে ফিরেছেন তিনি। এছাড়া আরেক উদ্ধারকর্মী চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আত্মহত্যা করেন।