একাত্তুরের যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ওরফে দেইল্লা রাজাকারের ফাঁসির রায় হয়েছে ২৮/০২/২০১৩ ইং তারিখ। এদেশের জনগণ এই রায়ে আনন্দিত, উদ্বেলিত। নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে তাদের আনন্দের বহি:প্রকাশ ঘটিয়েছে। গোটা জাতি এই রায়ের জন্য অপেক্ষা করেছিল। জাতি স্বস্থির নি:শ্বাস ফেলেছে। মুষ্টিমেয় কতিপয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস, পাকিস্তানী দালাল, জামাত শিবির তাদের বংশধরেরা এই সাথে বিএনপি নেত্রী ম্যাডাম খালেদা জিয়া ও তাঁর ঘনিষ্ঠজন মনে হয় এই রায়ে ক্ষুদ্ধ, স্তম্ভিত হয়েছেন। ম্যাডাম খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন। সেখানে তখন তার পুত্রের পাচারকৃত অর্থের বিচার চলছিল। সিঙ্গাপুর আদালত ৮ কোটি টাকা বাংলাদেশে ফেরৎ পাঠাতে নির্দেশ দিয়েছে। বিমান বন্দরে নেমেই তিনি ফুলেল শুভেচ্ছা উপেক্ষা করে নিজের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এদেশের জনগণের দাবী। দীর্ঘ ৪১ বছর পর এই বিচার শুরু হলো। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক কন্যা জননেত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা জনগণের এই আকাঙ্খার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। জাতি এজন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। নতুন প্রজন্ম ও এদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চায়। ট্রাইবুনাল ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে তিন জনের রায় হয়েছে। ইতোমধ্যে তিনজনের রায় হয়েছে। মৃত্যু দন্ডপ্রাপ্ত বাচ্চু রাজাকার এখন পলাতক। দেইল্লা রাজাকারের ফাঁসির রায়ে জামাত শিবির হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সারাদেশে হত্যা, সন্ত্রাস, অগ্নিকান্ড, লুটসহ নানাবিধ তান্ডব শুরু করে দিয়েছে। তাদের তান্ডব ৭১ এর বর্বরতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিএনপি নেত্রী সিঙ্গাপুর হতে দেশে ফিরে সরকারের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকে গণহত্যা বলে দাবী করেছেন। ১৯৭১ সনে তিনি কেন্টনমেন্টে পাকিস্তানী সেনাবাহিনরি তত্বাবধানে আয়েশে থেকে গণহত্যা কাকে বলে বুঝার উপায় নেই। তিনি এদেশের আবালবৃদ্ধবনিতার, সকল মানুষের সাথে রশিকতা করলেন। একদিকে নিজের ছেলেদের অবৈধ অর্থ, পাচারকৃত অর্থ বিদেশের আদালতে প্রমাণিত হওয়ায় ও নতুন প্রজন্মের নবজাগরণে দিশেহারা হয়ে তিনি এখন বেসামাল। তার চার পাশে কতিপয় ব্যারিষ্টারেরা, খন্দকারেরা, মীর্জারা, রায়েরা নানাবিধ প্রজাতির মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী রাজাকার, আলবদরেরা, তাদের সন্তানেরা, প্রধানের বাচ্চা, চখার বাচ্চারা, সাকার বাচ্চারা, যুদ্ধাপরাধী ৭১ এর গণহত্যাকারী চরিত্রেরা, তাদের ভাবশিষ্যরা এবং নব্য রাজকারেরা এখন প্রমাদ গুনছে ও আবোল তাবোল বকছে। বেপরোয়া জামাত-শিবির যেভাবে জনগণের উপর, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ছে এতে অবাক বিস্ময়ে ভাবতে হচ্ছে কোন শক্তি এদেরকে এই অপকর্মের মদদ দিচ্ছে। ৭১ এর পরাজয় জামাত ভুলেনি, সেই প্রতিশোধ নিচ্ছে। জাতির দূর্ভাগ্য বিএনপি তাদের সমর্থন দিচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশে পরাজিত শক্তির উত্থান অকল্পনীয়। সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে এই পরাজিত শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে।
১৯৭৫ সনে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার পর এই অপশক্তি সারা জাতির উপর যেভাবে জাকিয়ে বসেছে এদেরকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করা এখন সরকারের ফরজ কাজ। ১৯৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর বাঙালী জাতি তার ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ সব মুছে ফেলার প্রক্রিয়ায় পড়ে যায়। বেঈমান মোশতাক ও জিয়া মীরজাফর চরিত্রের এই দুই প্রেতাত্মা জনক হত্যার, বাঙালীর ইতিহাসে হত্যার আসল নায়ক। জাতির জনক হত্যার পর তিনমাস মোশতাক ক্ষমতায় ছিলেন। তারপর জনক হত্যার আসল সুবিধাভোগী ইতিহাসের দ্বিতীয় মীরজাফর মেজর জিয়া নিজেকে আলোর সামনে নিয়ে আসেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি জনগণের পয়সায় রাজনৈতিক দল গঠন করলেন। তিনি স্বগর্বে উচ্চারণ করলেন “গড়হবু রং হড় ঢ়ৎড়নষবস. ও রিষষ সধশব ঢ়ড়ষরঃরপং ফরভভরপঁষঃ ভড়ৎ ঃযব ঢ়ড়ষরঃরপরধহ.” সেদিন হতেই রাজনীতি কলুষিত হলো। পৃথিবীতে কোন সামরিক শাসকই এহেন ধ্বংসাত্মক চিন্তা চেতনা প্রকাশ করেনি। রাজনীতিবিদদের কলুষিত করার জন্য সামগ্রিক প্রক্রিয়া তিনি করেছেন তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত। একজন চেতনার মুক্তিযুদ্ধার পক্ষে এহেন অশুভ কর্মকান্ড সম্ভব নয়। ভাগ্য তাকে ১৯৭১ সনের ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠকরণের বিরল সুযোগ এনে দিয়েছিল। তিনি যাচ্ছিলেন সোয়াত জাহাজ হতে পাকিস্তানী অস্ত্র খালাসের জন্য। পথে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সৈনিক, রাজনীতিবিদদের হস্তক্ষেপে তিনি বিদ্রোহ করতে বাধ্য হন। তিনি নানাবিধ কলাকৌশলে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করলেন। ৭১এর দালাল, রাজাকারদের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী করলেন। বাংলাদেশ বেতার হলো রেডিও বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান ‘জয়বাংলা’ নির্বাসিত হলো। শুরু হলো পাকিস্তানী জিন্দাবাদ ধারার শ্লোগান। দালাল আইন বাতিল করে সকল দালাল রাজাকারদের মুক্ত করে দিলেন। যেসব মার্কামারা দালালদের নাগরিকত্ব বাতিল হয়েছিল তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হলো। সকল পলাতক আসামীগণ ফিরে এল। সাধারণ ক্ষমার বাইরে আটক এগার হাজার যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে দেয়া হলো। তাদের চলমান বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়া হলো। অর্থাৎ একটি সম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী ধারা প্রবর্তন করা হলো। হিজবুল বহরে ছাত্রদের প্রমোদ বিহারে নিয়ে ছাত্র রাজনীতি কলুষিত করা হলো। টেন্ডার বাজি, চাঁদাবাজি ও দলের লেজুড়বৃত্তি তখন হতেই শুরু হলো। আরও সর্বনাশ করলেন ছাত্র সংগঠনকে দলের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে গণ্য করে। এই হতেই ছাত্ররা রাজনৈতিক দল সমূহের লেজুড় হিসেবে কাজ করতে লাগল। দেশ ও জাতির ভবিষ্যত কান্ডারেিদর এহেন চরিত্র হননের ব্যবস্থা পৃথিবীতে আর কেউ করেনি। ছাত্র রাজনীতি হলো দেশের ভবিষ্যত রাজনৈতিক নেতৃত্ব সৃষ্টির কারখানা। ছাত্র সংগঠনকে রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন গণ্য করায় কোমলমতি ছাত্রগণ তাদের নিজস্ব গতিধারা, স্বকীয়তা হারায়। স্বাধীন বাংলাদেশের শিশু বয়সে ভবিষ্যত সুষ্ঠু রাজনীতির গতিধারাকে বিপথগামী করায় জাতি দীর্ঘ ৩৭ বছর যাবৎ খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। আমি এজন্য জিয়াউর রহমানকে ইতিহাসের খলনায়ক হিসেবে ঘৃণা জানাই। ভবিষ্যত আদর্শ রাজনীতিবিদ গঠনের প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করার জন্য তাকে ধিক্কার জানাই। গত ০৪/০২/২০১৩ তারিখে “আমাদের অর্থনীতি” পত্রিকায় একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। তথ্যটি হলো ১৯৭১ এর ২৯ মে মেজর জিয়াকে লিখিত পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা কর্ণেল বেগের একটি চিঠি। তিনি লিখিছেন-
গধলড়ৎ তরধ ঁৎ জধযসধহ, চধশ অৎসু, উধপপধ.
ডব ধষষ যধঢ়ঢ়ু রিঃয ুড়ঁৎ লড়ন. ডব সঁংঃ ংধু মড়ড়ফ লড়ন! ুড়ঁ রিষষ মবঃ হবি লড়ন ংড়ড়হ. উড়হ’ঃ ড়িৎৎু ধনড়ঁঃ ুড়ঁৎ ভধসরষু. ণড়ঁৎ রিভব ধহফ শরফং ধৎব ভরহব. ণড়ঁ যধাব ঃড় নব সড়ৎব পধৎবভঁষ ধনড়ঁঃ গধলড়ৎ ঔধষরষ. ঈড়ষ. নধম, চধশ ধৎসু
গধু ২৯, ১৯৭১.
এই পত্র কিসের ইঙ্গিত দেয় দেশবাসীর নিশ্চয়ই বুঝতে অসুবিধা হবেনা। ষড়যন্ত্র ১৯৭১ সন হতেই শুরু হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় বিএনপি জামাত সমগ্র কর্মকান্ড পরিচালনা করছেন। অতএব যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তাদের অনীহা থাকবেই। যে ট্রাইবুনাল গঠিত হয়েছে এর চেয়ে স্বচ্ছ আর হতে পারেনা। দুনিয়ার আর কোথাও এহেন ট্রাইবুনালে আপীলের বিধান নেই। বাংলাদেশে আপীলের সুযোগ রাখা হয়েছে। এর চেয়ে আর কি স্বচ্ছ হতে পারে? বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের মতো জঘন্য অপরাধ পৃথিবরি অন্য কোথাও কেউ করেছে কি-না সন্দেহ আছে। অথচ এরা সুযোগ সুবিধাও পাচ্ছে প্রচুর। পৃথিবরি অন্য কোথাও এমন নজির নেই। এইসব জামাত মুসলিমলীগ ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীরা একেকটা ইবলিসের চেয়েও শয়তান। এইসব জঘন্য শয়তানদের অকল্পনীয় সেবা দেয়া হচ্ছে। এরা মানুষের কাধে চড়ে আদালতে যাচ্ছে। একজন শয়তান কিভাবে মানুষের কাঁধে চড়ে বোধগম্য নয়। থাকা খাওয়া, চিকিৎসা ইত্যাদি নানাবিধ সুবিধা এরা যা পাচ্ছে এহেন সুবিধা তাদের পাপ্য কিনা কর্তৃপক্ষকে চিন্তা করে দেখতে অনুরোধ জানাচ্ছি। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে নতুন প্রজন্ম জাতিকে ৭১ এর ধারায় ফিরিযে নিয়ে এল। সপরিবারে জাতির জনক হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগানকে নির্বাসনে দেয়া হয়েছিল। ৩৭ বছর পর জাতি তার অস্তিত্ব ফিরে পেল। জয়বাংলার অমর শ্লোগান বাংলার আকাশ বাতাস এখন মুখরিত। এই চেতনা প্রজ্জ্বলিত হবে প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে। সকল দল ও মতের মানুষকে সবিনয় অনুরোধ জানাব অন্তত:পক্ষে এই চেতনায় একমত পোষণ করুন এবং যুদ্ধাপরাধী জামাত-শিবির ’৭১ এর দালালদের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত করুন ও তাদের রাজনীতি বন্ধ করুন। তাদেরকে তাদের স্বদেশ পাকিস্তানে প্রেরণ করুন। এই পাকিস্তানী প্রেতাত্মারা যতদিন এদেশে থাকবে ততদিন এদেশের উন্নয়ন ব্যাহত হবে। এরা ধর্মের নামে জাতিকে বিভ্রান্ত করে সকল প্রগতিকে স্তব্দ করে দেবে। এরাতো বাংলাদেশ চায়নি, অতএব এদেশে থাকারও তাদের কোন অধিকার নেই। এরা কেয়ামত পর্যন্ত এদেশকে কুড়ে কুড়ে খাবে। বিএনপির সকল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষদের আবেদন জানাই আপনারা স্বাধীনতা বিরোধী জামাত মুক্ত হয়ে বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলুন জয়বাংলা জয়বাংলা।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করত: সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান আপামর জনতার দাবী। এই শাস্তি বাস্তবায়ন করে লক্ষ শহীদের রক্তের ঋণ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের ঋণ শোধ করতে হবে। এদের সাথে এদের বর্তমান সহায়তাকারীদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। কেননা অশুভ শক্তি কোনদিন দেশ ও জাতির মঙ্গল বয়ে আনতে পারেনা। দেশ ও জাতিকে চরম সর্বনাশ হতে রক্ষা করার জন্য জাতি ধর্ম বর্ণ নিবিশেষে সকল বাঙালীর সোচ্চার হওয়ার সময় এসেছে। নবজাগরণ মঞ্চ এই আহ্বানই দিয়ে যাচ্ছে অবিরত। ৭১ এর চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের অগ্রসর হতে হবে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে। সকল দালাল, যুদ্ধাপরাধী, তাদের বাচ্চা, পাকিস্তানী প্রেতাত্মা ও তাদের দোসরদের খতম করে রচনা করতে হবে আধুনিক ডিজিটাল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। নতুন প্রজন্মের এই উপলব্ধি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অগ্নিশিখা আজ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলায় টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া। আসুন আমরা সবাই নতুন প্রজন্মের সুরের প্রতিধ্বনি তুলি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে তাদের সাথে এই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ি। ৪১ বছর পর দেশ ও জাতি কলংকমুক্ত হোক। নতুন প্রজন্মের এই যুদ্ধের, এই চেতনার জয় হোক। মানুষ মনের মাধুরী দিয়ে গেয়ে উঠুক “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।” “শোন একটি মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে আকাশে বাতাসে উঠে রনি। বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।” “একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে আমরা যুদ্ধ করি” জয়বাংলা বাংলার জয়।
(লেখক সাবেক সচিব)