গণতন্ত্র বেচাকেনা: কাঠগড়ায় মার্কিন রাজনীতি

গণতন্ত্র বেচাকেনা: কাঠগড়ায় মার্কিন রাজনীতি

বিশ্বে সবচে খাঁটি গণতন্ত্রের দেশ মনে করা হয় যুক্তরাষ্ট্রকে। কিন্তু সেখানে করপোরেশন, ইউনিয়ন এবং তথাকথিক রাজনৈতিক জোটগুলো (সুপার প্যাক) কীভাবে প্রার্থী বাছাই পর্বের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে তা জানলে ‘নিখাদ গণতন্ত্রের দেশ’ যুক্তরাষ্ট্রের সুনাম প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলেই মনে করেন ওয়কিবহাল মহল।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে চলছে আসন্ন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বাছাই পর্বের প্রাথমিক নির্বাচন। কিন্তু এই মুহূর্তে একটা প্রশ্ন বারবার সামনে আসছে- অর্থের প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকে (গণতন্ত্রকে!) যেভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলেছে সেখান থেকে উদ্ধার কি সম্ভব?

সুপ্রিমকোর্টে বহুল আলোচিত সিটিজেন ইউনাইটেড বনাম ফেডারেল ইলেকশন কমিশন মামলার রায় হলো- করপোরেশন, ইউনিয়ন অথবা স্বাধীন রাজনৈতিক কমিটির কেউ চাইলে নির্বাচনে ইচ্ছে মতো ভূমিকা রাখতে পারে। আর তাতে কোনো সীমা নির্ধারিত নেই। সুতরাং এখন প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী প্রচারণার জন্য ধনী আমেরিকানদের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। যদিও তাদের অনেকেরই তৃণমূল পর্যায়ে শক্ত সমর্থন নেই।

গত ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনী প্রচারণায় প্রার্থীদের তহবিল সরবরাহকারী তথাকথিত সুপারপ্যাক ২০১১ সালের শেষ নাগাদ পর্যন্ত সংগৃহিত অর্থের পরিমাণ এবং তাদের পরিচয় তুলে ধরে। তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মিট রমনির সমর্থক সুপার প্যাক ‘রেস্টোর আওয়ার ফিউচার’ সবচে বেশি অর্থের জোগান দিয়েছে। রমনির জন্য তাদের দেওয়া অর্থের পরিমাণ ৩ কোটি ২ লাখ ডলার। তার প্রতিদ্বন্দ্বী নিউট গিংরিচের সমর্থক সুপার প্যাক ‘উইনিং আওয়ার ফিউচার’ একই সময় তহবিল সংগ্রহ করেছে ২১ লাখ ডলার।

অবশ্য এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরেই গিংরিচের সুপারপ্যাক বিলিয়নেয়ার ক্যাসিনো মুঘল শেলডন অ্যাডেলসনের কাছ থেকে এক কোটি ডলার অর্থ অনুদান নেয়।

এদিকে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের উপ-চিফ অব স্টাফ এবং জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা কার্ল রোভের পক্ষেও একটি সুপার প্যাক রয়েছে। আমেরিকান ক্রসরোডস নামের এই গ্রুপটি ২০১১ সালে এক কোটি ৮৪ লাখ ডলার সংগ্রহ করে।

কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের নথিপত্রের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই সুপার প্যাকে ১০ জন বিলিয়নেয়ার রয়েছে। অপর সুপারপ্যাক জোট আমেরিকান ক্রসরোডসের ক্রসরোডস জিপিএস নামে একটি সহযোগী সংগঠন রয়েছে। কিন্তু তারা তাদের দাতাদের নাম কখনো জানায় না।

নিউইয়র্ক টাইমসের নিচের তথ্যচিত্র থেকে পরিস্কার বোঝা যাবে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনী তহবিলের অর্থ কীভাবে সংগ্রহ করা হয়, গ্রহণ করা হয় এবং তা খরচ করা হয়-
DONATE
তবে আমেরিকায় এভাবে অর্থ সংগ্রহ এবং খরচের ব্যাপারে কোনো সীমা নির্ধারিত তো নেই-ই বরং তা আইন দ্বারা সংরক্ষিত। আর এইসব তথাকথিত সুপারপ্যাকগুলো নির্বাচনে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। আর যেসব নেতাদের পেছনে টাকার জোর আছে তারাই নির্বাচনী ময়দান দাপিয়ে বেড়ান। তারাই বিভিন্ন টেলিভিশন, পত্রিকায় ঘনঘন আমন্ত্রিত হন। তাদের প্রতাপে ভিন্ন মতাবলম্বি বা সংস্কারবাদীরা হালে পানি পান না।

তেমনি এক নেতা লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর বাডি রোয়েমার। রিপাবলিকানদের টেলিভিশন বিতর্কে তিনি আমন্ত্রিত হননি কারণ ন্যূনতম ২ শতাংশ ভোট পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবুও রিপাবলিকান পার্টির পাশের আসনে বসে লড়ে যেতে চান তিনি। তার প্রচারণার অন্যতম অংশ হলো নির্বাচনী প্রচারণার তহবিল সংগ্রহ ও খরচের নীতিতে সংস্কার আনা। তিনি প্যাক বা সুপার প্যাক অথবা করপোরেট দাতাদের দ্বারস্থ হননি। সমর্থকদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ১০০ ডলার নিয়েছেন মাত্র।

এমএসএনবিসি টেলিভিশনের একটি বিশেষ শো’র আয়োজক ডিলান র‌্যাটিগান যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে সরকার ও করপোরেশনের মধ্যকার সম্পর্কের সমালোচনা করে যাচ্ছেন ক্লান্তিহীনভাবে। তার মতে, ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ঠিকভাবে মোকাবেলা করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ব্যাংক ব্যবস্থা, বাণিজ্য, কর নীতির কঠোর সমালোচক র‌্যাটিগান। তিনি ওয়ালস্ট্রিট দখল করো আন্দোলনের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন।

বহিরাগত অর্থ এবং রাজনীতির মধ্যকার সম্পর্ককে ‘অপবিত্র’ বলে অভিহিত করেছেন এই জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক। প্রাথমিক বাছাই পর্বের নির্বাচন এবং নির্বাচনে কূট কৌশল অবলম্বন নিষিদ্ধসহ বেশকিছু বিষয়ে সংস্কার আনা দরকার বলে মনে করেন র‌্যাটিগান।

তিনি সংবিধান সংশোধন করে রাজনীতিতে বহিরাগত অর্থ অনুপ্রবেশ বন্ধ করার প্রস্তাব করেছেন। এছাড়া, এই সংশোধনীর আগে পর্যন্ত নির্বাচনী তহবিলের ওপর শতভাগ কর ধার্য করার পরামর্শ দিয়েছেন র‌্যাটিগান।

র‌্যাটিগান এই তহবিল সংগ্রহের রাজনীতির বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ‘গেট মানি আউট’ স্লোগানে প্রচারণাও শুরু করেছেন। এর বিরুদ্ধে ওয়েবসাইটে গণস্বাক্ষরের আয়োজনও করেছেন তিনি। এই আবেদনে গত ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২ লাখ ৫০ হাজারেও বেশি আমেরিকান সই করেছে।

কোনো জবাবদিহিতা না থাকায় নির্বাচনী প্রচারণায় নানা উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ এবং বেপরোয়াভাবে খরচের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। যেমন রিপাবলিকান প্রাইমারিতে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের পেছনে ২০০৮ সালের তুলনায় এবার ১৬০০ শতাংশ বেশি খরচ হয়েছে। আর এসব ব্যয়ের প্রায় অর্ধেকই বহন করেছে সুপারপ্যাকগুলো।

অ্যানিমেটেড বিজ্ঞাপনগুলোতে অর্থায়ন করছে গিংরিচপন্থী সুপারপ্যাক উইনিং আওয়ার ফিউচার। এরা ব্লাড মানি নামে রমনি বিরোধী একটি তথ্যচিত্রও বানিয়েছে।

তবে মিট রমনির সঙ্গে গিংরিচ খুব একটা পেরে উঠছে বলে মনে হয় না। তার অর্থদাতারা অনেক বড় মাপের সব বিলিয়নেয়ার। একদিনে এক কোটি ২৫ হাজার ডলার তহবিল সংগ্রহ করেছে রমনির সুপারপ্যাক। নববর্ষের প্রথম দিনে তিনি পেয়েছেন নগদ ২০ লাখ ডলার।

রমনিপন্থী সুপারপ্যাক রেস্টোর আওয়ার ফিউচার গিংগ্রিচের সমালোচনা করে একটি বিজ্ঞাপন তৈরি করেছে। তবে এটি কোনো নির্দিষ্ট সুপারপ্যাকের সরাসরি অর্থায়নে নয়।

অরাজনৈতিক এবং অলাভজনক প্রতিষ্ঠান দ্য সান লাইট ফাউন্ডেশন সরকারের মধ্যে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আন্দোলন করে যাচ্ছে। এরা সিটিজেন ইউনাইটেড রায়ের সমালোচনা করে সমগ্র বিষয়টিকে ব্যঙ্গ করে একটি স্যাটায়ার ভিডিও তৈরি করেছে। তারা দেখানোর চেষ্টা করেছে, এই রায় ২০১২ সালের নির্বাচনী ফলাফলকে কীভাবে প্রভাবিত করবে।

তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো- মাত্র অর্ধেক আমেরিকান নাগরিক এই সিটিজেন ইউনাইটেড রায় সম্পর্কে সচেতন, যে রায় সুপার প্যাকগুলোকে অর্থ সংগ্রহ এবং খরচের অবাধ সুযোগ করে দিয়েছে। যারাই এই রায় সম্পর্কে একটু সচেতন তাদের বেশিরভাগই এর নেতিবাচক দিকটিই উল্লেখ করছেন। প্রিন্সটন সার্ভে রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন ইন্টারন্যাশনালের এক জরিপে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।

সব রাজনৈতিক দলের বেশিরভাগ ভোটারই মনে করেন, সিটিজেন ইউনাইটেড রায় অনুযায়ী সুপার প্যাকের এই যে অবাধ অর্থ খরচের সুযোগ করে দেওয়া এতে রাজনৈতিক প্রচারণায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

তবে মার্কিন রাজনীতিতে শুধু যে টাকার খেলাই আছে, তা কিন্তু নয়। ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সাম্প্রদায়িক অনেক স্পর্শকাতর বিষয় নিয়েও সেখানে রাজনীতি হয়। রাজনীতিতে রয়েছে ইহুদি লবির ভয়াবহ প্রভাব। এর একটা উদাহরণ: ফিলিস্তিনিরা অনাহুত এরা এই ভূখণ্ডের নয় বলে মন্তব্য করেছিলেন গিংরিচ। যা ছিল সরাসরি ইতিহাস বিকৃতি এবং সে সময় বিশ্বব্যাপী বিতর্কের ঝড় তোলে।

আরো আছে চাঁদে বসতবাড়ি করে দেওয়ার মতো হাস্যকর প্রতিশ্রুতি। তবে অনেকে আবার বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন।

তবে বিষয়টা নিয়ে অন্য ধরনের প্রতিক্রিয়াও আছে। কারণ, এই প্রতিশ্রুতিটা এমন- যেনো চাঁদের মাটি আমেরিকানদের পৈত্রিক সম্পত্তি। চাইলেই ভাগবাটোয়ারা করে নিতে পারবে তারা। দুনিয়ার বাদবাকি মানুষ আর প্রাণীর কথা না ভাবলেও চলবে।

মার্কিনিদের এই বিশ্ব অভিভাবকসূলভ মানসিকতাকে ভালভাবে নিতে পারেননি যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের অনেকে। এ কথাকে কেন্দ্র করে মার্কিনিদের দোষারোপ করা হচ্ছে- কারণ এই প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর একজন মার্কিনিও এর প্রতিবাদ বা সমালোচনা করেনি।

আন্তর্জাতিক