শহর থেকে তিন মাইল দূরের দুর্গম গ্রাম ইকরর। শীতের সময় গম আর বর্ষার সময় ধান ক্ষেতে বেষ্টিত থাকে গ্রামটি। আসলে ভারতের ছয় লাখ গ্রাম থেকে এ গ্রামের পার্থক্য বেশি নয়। তবে পার্থক্য একটি তা হলো গ্রামটি আমেথি আসনের মধ্যে পড়েছে। উত্তর প্রদেশের উত্তরাঞ্চলীয় এ জেলাটি গত কয়েক দশক ধরে ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের শক্ত ঘাঁটি। দুর্গ বললে ভুল হবে না। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও আধুনিক ভারতের রূপকার জওহরলাল নেহেরুর উত্তরাধিকারীদের হাতেই এই ইকররের ৪০০ পরিবারসহ স্বদেশী ১২০ কোটি ভারতীয়র ভাগ্য নির্ভরশীল ছিলো কয়েক দশক ধরে। সেই পারিবারিক আধিপত্য এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমনকি শাসনাঞ্চলের কেন্দ স্থলেও। দল এবং ভোটাররা এখন নতুন এক যুগের সূচনা করতে প্রস্তুত।
এবারের পরিস্থিতি সত্যিই অন্য যেকোনো বারের চেয়ে ভিন্ন। বিশেষ করে কংগ্রেসের জন্য। ২০০৪ সাল থেকে ইকরর গ্রামের সংসদ সদস্য হিসেবে পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করছেন কংগ্রেসের সহ-সভাপতি ও নেহেরুর দৌহিত্র রাহুল গান্ধী। ইকররের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি মাকসুদ আহমেদ, ভারত যখন ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন হয়েছিলো তখন তার বয়স ছিলো আট বছর। তার মতে, গান্ধীরা ও কংগ্রেস হলো এক মুদ্রার এপিট-ওপিট। স্বাধীনতার পর থেকে নেহেরু-গান্ধী পরিবার ও কংগ্রেস এদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনকে শাসন করে এসেছে। তবে এবারের নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেস শোচনীয়ভাবে পরাজিত হতে যাচ্ছে! আপাতদৃষ্টে কেউ মনে করছে না যে, রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গান্ধী পরিবার শেষ হয়ে যাবে। তবে দেশটিতে এবার বড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে তার আভাস মিলেছে। আর বিশ্বের অন্যতম সফল রাজনৈতিক পরিবারটি দীর্ঘ মেয়াদের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছে।
ভারতের উত্তর প্রদেশে জনসংখ্যা প্রায় ২০ কোটি। এখানকার আর্থ-সামাজিক সূচকগুলো সাব-সাহারান আফ্রিকার সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়। স্থানীয় এক হোটেল ব্যবসায়ীর মতে, উত্তর প্রদেশ হলো ভারতের একটি বুনো অঞ্চল। এই উত্তর প্রদেশের আমেথি ও পার্শ্ববর্তী রায়বেরেলি আসনে ইন্দিরা গান্ধীর স্বামী ফিরোজ গান্ধীর পর থেকে গান্ধী পরিবার বিরতিহীনভাবে প্রতিনিধিত্ব করে এসেছে। আমেথির ছোট শিল্প শহর জগদিশপুর। এর ভেতর দিয়ে সরু রাস্তা দিয়ে ইকরর পৌঁছাতে হয়। এখানে পুরো গ্রামীণ দৃশ্যপট। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহকারী জেলে, কালো কালো গবাদি পশু ও সাইকেলে চড়ে স্কুল শিক্ষার্থীদের যাতায়াত দেখে বোঝা যায় কোনো কিছুই বদলায়নি। এখানের তথা ভারতের জীবন যাপন সত্যিই অনেক কঠিন এবং বৈশ্বিক গতিবিধির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই গ্রামের অর্ধেকই মুসলিম এবং বেশিরভাগ পরিবারের কমপক্ষে একজন ছেলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশে কাজ করছে। ভারতের অভিবাসী শ্রমিকেরা গত বছর প্রায় ৭১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশে পাঠিয়েছিলো। ইকররের তুলনামূলক যে উন্নয়ন হয়েছে তা এই বিদেশি ডলারেই।
ভারতে এতোদিন মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার আসনগুলো কংগ্রেসের সবচেয়ে আস্থাশীল ছিলো। কিন্তু এখন আর তা নেই। ঐ গ্রামের আহমদুল্লাহ খান বলেন, গত কয়েক দশক ধরে আমরা গান্ধী পরিবারের সমর্থক ছিলাম। কিন্তু এখন আমাদের দুই বার ভাবতে হবে তাদেরকে ভোট দিতে। ইকররের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ লোকের বয়স ৩০ বছরের নিচে। যারা বলা চলে, বিভিন্ন সময় বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন ও বুমিং, শাইনিং ইন্ডিয়ার মতো স্লোগান দেখে বেড়ে উঠেছে। ১৯৮১ সালে যখন রাজীব গান্ধী প্রথম এই আসনে জিতেছিলেন তখন উত্তর প্রদেশে শিক্ষিতের হার ছিলো মাত্র ৩৩ শতাংশ। এখন সেখানে ৬৮ শতাংশ লোক শিক্ষিত। এসব গ্রামের মানুষেরাও টিভি সিরিজ ও লাইফ স্টাইল দেখে। যে কারণে তাদের প্রতিনিধিত্বকারী জনপ্রতিনিধিদের প্রতি অসন্তোষের ঢেউ প্রবল হয়েছে। ইকররের জেলে কৈলাশ বলেন, রাহুল গান্ধী যদি দলিতদের বন্ধু হন তাহলে তাকে বলুন এসে দেখতে আমরা কীভাবে বেঁচে আছি। রাজনীতিকরা শুধু নির্বাচনের আগে আসেন। প্রতিশ্রুতি দেন এরপর গায়েব হয়ে যান।
লক্ষৌভিত্তিক বর্ষীয়ান সাংবাদিক শরত্ প্রধান আমেথিতে রাজীব গান্ধীর প্রথম প্রচারণার সময় থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে চলেছেন। তিনি বলেন, এখনের মতো আগে কেউই গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেনি। ২০০৯ সালের নির্বাচনের আগে কিছু সমালোচনা হতো তবে এতটা তীব্র ছিলো না। তাদের মধ্যে ক্ষমতায়নের চেতনা সৃষ্টি হয়েছে। এটা সত্যিই আশ্চর্যের বিষয়। এই উপলব্ধি দিন দিন বাড়ছে। অনেকের মতে, রাহুল গান্ধীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ভারতের ৩৫ বছরের নিচের ৬৪ শতাংশ মানুষের জন্য অপমানের কারণ তাদের কোনো বিখ্যাত পিতা নেই। আমেথির জনগণ মনে করে যে, মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি রাহুল গান্ধীকে বড় আঘাত করতে পারবে। যদিও ভারতীয়দের মধ্যে বিজয়ী দলকেই ভোট দেয়ার প্রবণতা সব সময়ই বেশি। রাহুল গান্ধী আবার এমপি হবেন বা স্থানীয় উন্নয়নের অভাব এসব নিয়ে আক্ষেপ নেই ইকররবাসীর। তাদের অভিযোগ হলো রাহুল গান্ধীর কাছে যেতে না পারা। এ অভিযোগ অনেকটা মুঘল সম্রাটদের সঙ্গে মিলে যায়। যাদের কাছে সাধারণ মানুষ খুব কমই যেতে পারতো।