পরিসংখ্যান বিবেচনায়ও বাংলাদেশের ইতিহাসের সফলতম প্রধান নির্বাচক তিনি। তার হাত ধরেই আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়েছে বর্তমান দলের সেরা খেলোয়াড় সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, আব্দুর রাজ্জাকদের। কিন্তু এ দফায় শুরুটা অন্তত ভালো হল না তার। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে জাতীয় দলের টানা পরাজয়ই দেখছেন ফারুক আহমেদ। সেইসঙ্গে ইতিমধ্যে কিছু অভিযোগও উঠেছে তার বিপক্ষে। বলা হচ্ছে, প্রধান নির্বাচক হিসাবে জাতীয় দলে অপ্রত্যাশিত হস্তক্ষেপ করে মানসিকভাবে খেলোয়াড়দের দুর্বল করে দিচ্ছেন তিনি। দলের ব্যর্থতা, এর কারণ, নিজের বিপক্ষে অভিযোগ ও ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা নিয়ে প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ খোলামেলা কথা বলেছেন দৈনিক ইত্তেফাকের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাত্কারে।
সাক্ষাত্কার নিয়েছেন দেবব্রত মুখোপাধ্যায়—
এ দফা দায়িত্বের শুরুতেই দলের পারফরম্যান্সে কী খুব হতাশ?
আমি হারা-জেতার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, আমরা আমাদের সম্ভাবনা ও মান অনুযায়ী খেলতে পারিনি। ব্যাপারটা এই না যে, আমরা শুধু হারছি, হারছি আর হারছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, আমরা যা খেলতে পারতাম, তা পারিনি। আমাদের অবশ্যই সম্ভাবনা ছিল, বড় দলগুলোর বিপক্ষে এর চেয়ে আরেকটু বেশি রান করা বা আরেকটু ভালো ফিল্ডিং করা; এগুলো করতে না পারাটা হতাশাজনক। আমাকে এটাই বেশি আঘাত করেছে।
কাছ থেকেই তো দেখলেন খেলা। কী মনে হল, এই ব্যর্থতার কারণ কী?
কারণ তো একবাক্যে এভাবে বলা কঠিন। তবে প্রধান কারণ অবশ্যই বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়ের আউট অব ফর্ম হয়ে যাওয়া। এই বিশ্বকাপ শুরুর আগে থেকেই টপ অর্ডার ও লেট মিডল অর্ডারের বেশ কয়েকজন ব্যাটসম্যান আউট অব ফর্ম হয়ে গেছেন। এটা অবশ্যই একটা প্রভাব ফেলেছে।
কয়েকজন আউট অব ফর্ম থাকলেও অন্য দল বাকিদের ওপর ভর করে বেরিয়ে যায়। আমাদের সেটা হবে না কেন?
না, এখানে যেটা হয়, আমাদের তো ওরকম একা হাতে উদ্ধার করে দেবে এমন খেলোয়াড় খুব কম। ব্যাটিং দিয়েই যদি বলি, আমরা হয়তো টি-টোয়েন্টিতে ফিফটি করতে পারি; কিন্তু ওই সময়ে ৮০-৯০ রানের একটা ইনিংস খেলে ফেলা খেলোয়াড় আমাদের নেই। ফলে শীর্ষ খেলোয়াড় সবার ওপরই আমাদের ভরসা করতে হয়। তারা অনেকে ফর্মে না থাকলে একক কেউ যে বের করে আনবে খেলা, সে সম্ভাবনা খুব কম থাকে।
মানে, আমরা তাহলে টি-টোয়েন্টি খেলার মতো পাওয়ার ক্রিকেটে অভ্যস্তই না?
হ্যা, সেটা তো আছেই। টি-টোয়েন্টি খেলতে গেলে যেরকম পাওয়ার ক্রিকেট দরকার, তা খেলার মতো খেলোয়াড় এখনও আমাদের নেই। ধরুন, চোখের সামনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ গত দুটো ম্যাচ (অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানের বিপক্ষে) যেভাবে শুধু পাওয়া ক্রিকেট দিয়ে এগিয়ে গেল, এটা করার মতো কেউ তো নেই। ফলে এই ফরম্যাটটাতে আমরা এখনও ঠিক মানানসই কিনা…
তারপরও তো আমাদের এই ফরম্যাট খেলতে হবে।
হ্যা। এই যে লিমিটেড রিসোর্স আছে, তা কাজে লাগিয়েই কতোটা এগোনো যায়; সেটা দেখতে হবে। এসব নিয়ে ভেবেই আমাদের সামনে এগোতে হবে।
আউট অব ফর্ম বলে ব্যাটিং-বোলিংটা না হয় ব্যাখ্যা করলেন। কিন্তু আমরা খুবই ক্যাজুয়াল ফিল্ডিং দেখেছি এই টুর্নামেন্টে। এর কারণ কী? দলের মধ্যে জয়ের তাগিদ কী কম ছিল?
এটা আমি একটু অন্যভাবে দেখতে চাই। একটা টিম যখন হারতে থাকে, তখন সবকিছু ঠিকঠাক হয় না; এটাই বাস্তবতা। আপনি এরকম খুব একটা দেখবেন না যে, যেকোনো দল টানা হারছে, তারপরও তার সবকিছু ঠিক বলে মনে হচ্ছে। হারের একটা প্রভাব বডি ল্যাঙ্গুয়েজে পড়ে। ফলে ওই সিঙ্গেলকে ডাবল বানানো বা একটা অসাধারণ ফিল্ডিং করা; এসব তখন হয় না। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, একধরনের আত্মসমর্পণ করেছে হয়তো। কিন্তু ওইসময় মাথাও ঠিকমতো কাজ করে না। খেলায় এমনই হয়। বলা যায়, ইটস আ ব্যাড প্যাকেজ।
দলের এই খারাপ পারফরম্যান্সের জন্য নির্বাচক কমিটিকেও দায়ী করছেন অনেকে। বলছেন, নির্বাচকরা, বিশেষ করে আপনি দলে হস্তক্ষেপ করে তাদের মানসিক শক্তিটা কমিয়ে দিয়েছেন…
একটা লোকের পক্ষে হস্তক্ষেপ করে কী একটা দলকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলা সম্ভব? আমি কী একা দলকে ডিমোরাইলজ্ড করে ফেলতে পারি? আসলে সুনির্দিষ্ট করে অভিযোগটা বললে আমি জবাব দিতে পারতাম।
আপনি একাদশ নির্বাচনে প্রভাব রাখতে চেয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।
নাহ্। আমি কখনোই, কখনোই একাদশ নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলিনি।
কোনো এক ম্যাচের পর অধিনায়কের কাছে নাকি দলের ব্যর্থতা নিয়ে জবাব চেয়েছিলেন, ড্রেসিংরুমে বসেই?
নাহ্। আমি এরকম জবাব কখনোই চাইনি। আমার মনে হয় না, খেলোয়াড়রা এই অভিযোগ করেছেন। তবে কথাটা যারা তুলেছে, তারা কোনোকিছু পাশ কাটাতে চাইছেন বলে হয়তো এইসব বিষয় সামনে আনছেন। দেখুন, আমি জাতীয় দলে তো এই প্রথম প্রধান নির্বাচক হিসেবে কাজ করছি না। এক যুগেরও বেশি অধিনায়কত্ব করেছি। কখনো একটা ফিল্ডারকেও জিজ্ঞেস করিনি—এই ক্যাচটা কেন ফেললে? ভালোটার মতো খারাপটাও যে পার্ট অব ক্রিকেট; এটা ভালোই বুঝি আমি। ফলে এরকম কিছু নিয়ে আমি কেন চার্জ করবো!
একাদশ নিয়ে তাহলে কখনোই প্রশ্ন তোলেননি?
একাদশ তো তৈরি করেন কোচ-অধিনায়ক। হ্যা, কখনো কখনো তো একাদশ নিয়ে আমি প্রশ্ন করেছি, এটা তো আমার ডিউটি। যেমন একটা ম্যাচে গেম প্লান ছিল তিন পেসার খেলানোর; সেরকমই আলোচনা হলো টিম মিটিংয়ে; ফোনে আলাপ হয়েছিল। পরে একজন পেসার ইনজ্যুরড হলে একজন স্পিনিং অলরাউন্ডার নেয়া হল। আমি জানতে চেয়েছিলাম, গেম প্লান কী বদলে গেছে? এখন প্রধান নির্বাচক হিসেবে তো বটেই, টিমের আশেপাশে যারা থাকেন, তারা নিশ্চয়ই এরকম প্রশ্ন করতে পারেন। আমি মনে করি না, এগুলো কোনো ইস্যু। খেলোয়াড়রাও মনে করে না।
আরেকটা বড় অভিযোগ অধিনায়ক নিজেই করেছিলেন—এশিয়া কাপের দল নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা না করা।
এটা তো আমি আগেও বলেছি। অধিনায়কের সঙ্গে আলাপ করতেই হবে, এমন কিন্তু কোনো নিয়ম নেই। তবে আমাদের এখানে রেওয়াজটা হল, আলোচনা করা; এটা একটা মধুর ভদ্রতা। সেদিন খেলোয়াড়রা মাঠে ছিলেন। ওইদিনই দল জমা দিতে হত। আমি কোচের সঙ্গে আলাপ করে নিয়েছিলাম।
বাইরে একটা গুঞ্জন হল, এশিয়া কাপের ওই দলটা আসলে ‘সেরা দল’ ছিল না!
দেখুন, আমার কাছে কখনোই নাম গুরুত্বপূর্ণ না। আমি আমার আদর্শ এবং নীতিমালার পক্ষে থাকি; কোনো খেলোয়াড়ের নামের প্রতি নয়। মুশফিকের কথা নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে। মুশফিককে যখন দলে নিয়েছিলাম, পুরো বাংলাদেশ আমার বিপক্ষে ছিল। এমন কোনো কথা নেই, লেখা হয়নি। মুশফিক আমার কাছে বড় ব্যাপার ছিল না; বড় ব্যাপার ছিল প্রিন্সিপাল। সেই প্রিন্সিপালটা হল, সম্ভাব্য সেরা দল বানানো। সেটাই চেষ্টা করেছি সবসময়।
মুশফিক ছাড়াও সাকিব-তামিমকেও দলে নেয়ার জন্য আপনার লড়াইয়ের কিছু ইতিহাস ছিল।
হ্যা, অনেকের বেলায়ই এমন হয়েছে। সাকিবকে দলে নেয়ায় সবাই অবাক হয়েছিল। তামিম যখন দলে এলো, অনেকেই জিজ্ঞেস করেছে, কে এই তামিম? তখনও সে অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ের খেলোয়াড়। এখন কথা হল, ওদের সম্ভাবনা ছিল, যোগ্যতা ছিল বলে সমর্থন দিয়েছি, লড়াই করেছি। সেটা যার মধ্যে দেখবো, তার জন্য করবো।
অধিনায়ক তার শেষ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বাইরের ফিডব্যাক নিতে চান। এটা কীভাবে দেখছেন?
এটাই তো হওয়া উচিত। খুব ভালো বলেছে সে। বাইরের ফিডব্যাক তো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। দলের আশেপাশেই বেশ কয়েকজন সাবেক অধিনায়ক আছে। তারা প্রত্যেকেই বিভিন্ন মত দিতে পারেন, সেগুলো কাজেও লাগবে।
সৌজন্যেঃ দৈনিক ইত্তেফাক