স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি করে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন রংপুর অঞ্চলের এক লাখ ৬৯ হাজার হতদরিদ্র গ্রামীন মানুষ। এতে তাদের আর্থ-সামজিক ও জীবনমানের উন্নতি ঘটেছে। এখন স্বচ্ছন্দে তারা জীবিকা নির্বাহ করছেন।
শাক-সব্জি চাষ, দুগ্ধ উৎপাদন, গরু মোটাতাজাকরণ, হাঁস-মুরগী পালন, ওষুধি বৃক্ষ ও মৎস্য চাষ, কটন ক্র্যাফ্টস-এর আওতায় মিনি গার্মেন্টস, হ্যান্ড এমব্রয়ডারিসহ কম খরচে বিভিন্ন গুনগত মানের পন্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সুবিধা নিশ্চিত হওয়ায় এ সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
সুইস এজেন্সী ফর ডেভলপমেন্ট এন্ড কোঅপারেশন (এসডিসি)-এর অর্থায়নে হেলভেটাস সুইস ইন্টারকোঅপারেশন-বাংলাদেশ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন সমৃদ্ধি প্রকল্পের সহযোগিতায় তাদের স্থায়ীত্বশীল আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। প্রকল্পের আওতায় প্রাইভেট সেক্টর এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে বিভিন্ন ভ্যাল্যু চেইন উন্নয়ন সফলতা বয়ে এনেছে।
ইতোমধ্যেই রংপুর, নীলফামারি, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, লালমনিরহাট এবং কুড়িগ্রাম জেলার ১৭টি উপজেলার গ্রামীন জনপদের প্রায় ৩৩ হাজার আটশ’ হতদরিদ্র পরিবারের আর্থ-সামাজিক ক্ষমতায়ন হয়েছে।
প্রকল্পটির ’কটন ক্র্যাফ্টস’ ভ্যালু চেইন উন্নয়নে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় স্থানীয় একজন উদ্যোক্তার প্রচেষ্ঠায় স্থাপিত মিনি গার্মেন্টস পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ’স্টুডেন্টস কেয়ার’ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এখানে নেয়া প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানটির সহযোগিতায় এলাকার নারী উদ্যোক্তারা নিজ এলাকায় ’গ্রামীণ উৎপাদন কেন্দ্র’ স্থাপন করেছেন। ফলে, হতদরিদ্র মহিলাদের আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাদের উৎপাদিত গার্মেন্টস পণ্য ’স্টুডেন্ট কেয়ার’-এর মাধ্যমে বিপনন হচ্ছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে কথা হয় নীলফামারির ডোমার উপজেলার সবুজপাড়া গ্রামের ’বসুন্ধরা মহিলা সমিতি’র সভানেত্রী রাফিয়া বেগমের সাথে। তার তত্ত্বাবধানে সেখানে একটি ’গ্রামীণ উৎপাদন কেন্দ্র’ পরিচালিত হচ্ছে।
তিনি বাসস’কে জানান, স্বামী শরিফুল ইসলাম (৪৫), কন্যা সম্পা (২২), বিনতি (১৯) ও পুত্র আসাদুজ্জামান (১৪)-কে সাথে নিয়ে ক’বছর আগেও তিনি অতিকষ্টে দিনাতিপাত করছিলেন। ’স্টুডেন্ট কেয়ার’-এর সহায়তায় প্রশিক্ষন নিয়ে তিনি এই উৎপাদন কেন্দ্রটি গড়ে তোলেন। এরপর বাছিরন (৪৫), রাশেদা (৩৫)-সহ ২১ জন হতদরিদ্র নারীকে নিয়ে দু’বছর ধরে মিনি গার্মেন্টস পণ্য উৎপাদনের কাজ করছেন।
একইভাবে পশ্চিম বোড়াগাড়ীর চান্দিনাপাড়া গ্রামের ’আশার আলো যুব উন্নয়ন মহিলা সমিতি’র লিপা বেগম (২১) বলেন, ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করার পর তার বিয়ে দেওয়া হয়। হতদরিদ্র লিপা যখন অতিকষ্টে জীবনযাপন করছিলেন, তখন তিনি এই সমিতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে মিনি গার্মেন্টস পণ্য উৎপাদনের কাজ শুরু করেন।
এসব মহিলা এখন নিজ বাড়ীতে থেকেই প্রত্যেকে দৈনিক ১২০ থেকে ২০০ টাকা করে রোজগার করছেন।
ডিমলা উপজেলার বাবুরহাটে উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ’স্টুডেন্টস কেয়ার’-এ গিয়ে দেখা যায়, সেখানে দু’শতাধিক হতদরিদ্র নারী-পুরুষ স্কুল পোষাক বিশেষত: টাই, ব্যাচ, ব্যাগ, প্যান্ট ও শার্ট তৈরী করছেন। এখানকার শ্রমিকরা প্রতি মাসে গড়ে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা আয় করেন। এটি ছাড়াও ’স্টুডেন্টস কেয়ার’ ডিমলা ও ডোমার উপজেলায় আরো ৮টি গ্রামীণ উৎপাদন কেন্দ্রে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
এসব উৎপাদন কেন্দ্রে কাজ করে ইতোমধ্যেই রাফিয়া (৩৮), আম্বিয়া (৩৫), ছামিনা (৩২), মিনাকী (২৯)’র মত অনেক অনাথ, এতিম, ঝড়ে পরা শিক্ষার্থী, স্বামী পরিত্যক্তা নারী, কর্মহীন মহিলা এবং অস্বচ্ছল গৃহবধূর ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে।
’স্টুডেন্টস কেয়ার’-এর প্রোপ্রাইটর আলহাজ্ব আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, তিনি দেশের ১৩টি জেলার ২৭টি উপজেলার প্রায় দেড় হাজার স্কুলে শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন ধরনের স্কুল ড্রেস সরবরাহের পাশাপাশি অন্যান্য উৎপাদিত পন্য বাজারজাত করছেন।
অন্যদিকে প্রকল্পটির সব্জি ভ্যালু চেইনের আওতায় ডিমলা উপজেলার আকাশকুড়ী ঘাটেরপাড় এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে সব্জি ক্রয়-বিক্রয় কেন্দ্র। সেখান থেকে তিন শতাধিক চাষীর উৎপাদিত সব্জি একত্রিকরণ করে দূর-দূরান্তের বাজারে বিপনন করা হচ্ছে। গত মৌসুমে এই কেন্দ্রের মাধ্যমে অর্ধ কোটি টাকার উর্ধ্বে দেশী জাতের বেগুন ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে বলে সব্জি চাষি আব্দুল মালেক (৩৭), জব্বার (৩৯) এবং মনসের আলী (৫২) জানান।
কথা হয় উন্নত পদ্ধতিতে মুরগী চাষ করে সফলতা অর্জনকারী নীলফামারির সদর উপজেলার মোল¬াপাড়া গ্রামের রবিউল (৩২), শামিম (২৮), এমদাদুল (৪১), স্বপ্না (৩৭) এবং আসমা বেগম (৫২)-এর সাথে। সমৃদ্ধি-প্রকল্পের সহযোগিতায় স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা সেবা প্রদানকারী সমিতি, সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নিয়ে তারা বাড়ীতে উন্নত ’স্ক্যভেনজিং পদ্ধতি’-তে তারা দেশীয় জাতের মুরগী পালন করছেন।
আসমা বেগম জানান, স্থানীয় সেবা প্রদানকারী সমিতির কাছ থেকে তিনি নিয়মিত সহযোগিতা, জ্ঞান এবং দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষন, উন্নত মানের ভ্যাকসিন, ওষুধ, মুরগীর খাবারসহ যাবতীয় সমস্যা সমাধানের পরামর্শ পাচ্ছেন। ফলে, তার স্বাস্থ্যবান মুরগী ও অধিক উর্বর ডিমের উৎপাদন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গতবছর তার মুরগীর খামারটি থেকে নিজের পরিবাররের মুরগী ও ডিমের চাহিদা মেটানোর পরেও তিনি ২১ হাজার টাকা আয় করেছেন বলে জানান।
প্রকল্পের দুগ্ধ ভ্যালু চেইনের আওতায় রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার ছিট লক্ষনপুর গ্রামে গাভী পালন করে সফলতা অর্জন করেছেন হতদরিদ্র শহিদুল ইসলাম (৩৩) এবং আকতারা বেগম (৩৬)। দু’বছর আগে তারা একটি করে দুগ্ধদানকারী গাভী পালন শুরু করেন। স্থানীয় সেবা প্রদানকারী সমিতির সার্বিক সহযোগিতায় তাদের এখন বাছুর ছাড়াও তিনটি করে দুগ্ধদানকারী গাভী হয়েছে।
আকতারা বেগম জানান, গাভী পালনের যাবতীয় ব্যয় সংকুলানের পর তিনি চার সন্তানের দুধ ও পুষ্টির চাহিদা মিটিয়ে প্রতিদিন আট লিটার দুধ বিক্রি করে ২৫০ টাকা পর্যন্ত আয় করছেন।
সমৃদ্ধি প্রকল্পের রংপুর অঞ্চলের ভ্যাল্যু চেইন স্পেশালিষ্ট তাহমিদুর রহমান রতন বাসস’কে জানান, এই অঞ্চলে ভ্যাল্যু চেইন উন্নয়ন কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট হয়ে অনেক হতদরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান ও আয়ের স্থায়ী সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।