ছাত্রলীগ নিয়ে শঙ্কিত সরকার। বিব্রত আওয়ামী লীগ। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে গঠিত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের জন্য ছাত্রলীগ এখন রীতিমতো উদ্বেগের বিষয়। সরকারের মাত্র এক মাস না যেতেই সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির দায়ে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ পুরনো চেহারায় জড়িয়ে পড়ছে সহিংসতায়। এরই মধ্যে ছাত্রলীগ যতগুলো কেলেঙ্কারি করেছে তাতে নতুন সরকারের ভাবমূর্তি অনেকটা ভূলুণ্ঠিত। সর্বমহলে প্রশ্ন উঠেছে, ছাত্রলীগ চালায় কে? কীসের জোরে সর্বোচ্চ হাইকমান্ডের নির্দেশ বারবার অমান্য করে সন্ত্রাসী আচরণে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগের পরিচয়ধারী সন্ত্রাসীরা? দলের সহযোগী এ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান আওয়ামী লীগের। যে কোনো মূল্যে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করা হবে। ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের কারণে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংসদ অধিবেশনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হয়েছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে র্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যেখানেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সেখানেই কঠোর ব্যবস্থা। ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী যে-ই অপকর্ম করবে তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বিগত মহাজোট সরকারের অনেক অর্জনেই ছাই ঢেলে দিয়েছিল। ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংঘর্ষ, শিক্ষক পেটানোর ঘটনায় তীব্র সমালোচিত হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার। এবার এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে, সে জন্য শুরুতেই ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ছাত্রলীগের নেতারা বলছেন, অতীতের চেয়ে সতর্ক হয়ে চলবেন তারা। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বর্তমান সরকারের অবস্থান সন্ত্রাসী, নাশকতা, চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে। সন্ত্রাসী যে-ই হোক তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, ছাত্রলীগের লাগাম এখন থেকেই টেনে ধরা হবে। কোনো ধরনের নৈরাজ্য করলেই কঠোর ব্যবস্থা। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম বলেন, যেখানেই ছাত্রলীগ কোনো ধরনের অপকর্ম করেছে সেখানেই তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অতীতেও ছাত্রলীগ কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রশ্রয় দেয়নি, আগামীতেও দেবে না। গতকাল (রবিবার) টাঙ্গাইলে পূর্বশত্রুতার জের ধরে মাটি ব্যবসায়ী আমির হামজার (৪৫) দুই হাতের কব্জি কেটে ফেলেছে সদর উপজেলার ছিলিমপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগ সভাপতি রোমান মিয়া। ইউনিয়নের চরপাকুল্লা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় লোকজন গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। শনিবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি না পাওয়ায় অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শ্রেণীকক্ষে তালা লাগিয়েছেন ওই বিভাগের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য রাজু মুন্সী। শনিবার ছিল দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা। এতে অংশ নিতে চেয়েছিলেন রাজু। অথচ তিনি প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিলেন। গত শুক্রবার সিলেটে জায়গা দখল করতে গিয়ে এলাকাবাসীর হাতে আটক ছাত্রলীগের ১২ নেতা-কর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। নগরের ইলেকট্রিক সাপ্লাই এলাকার একটি বাড়ি থেকে পুলিশ এই নেতা-কর্মীদের আটক করে। এ সময় দুই পক্ষে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। গত সপ্তাহের রবিবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের সশস্ত্র হামলায় সাংবাদিকসহ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন কমপক্ষে ৪০ জন। পরিস্থিতি সামাল দিতে সংগঠন থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয় একজনকে। গত ২৫ জানুয়ারি কবি জসীমউদদীন হল ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান রনি বাণিজ্য মেলায় গিয়ে প্যাকেটজাত দুধ হাতে একটি ছবি তুলে ফেসবুকে দেন। ছবিতে একজন মেয়ে বিক্রেতাকেও দেখা যাচ্ছিল পেছন দিকে। ফেসবুকে এ নিয়ে মন্তব্য করা হলে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আফরিন নুসরাত প্রতিবাদ জানান। এর পর মেহেদীর অনুসারীরা নুসরাতকে নিয়ে নানা অশ্লীল মন্তব্য করে। ওই ঘটনার বিচার চেয়ে শামসুন নাহার হলের ছাত্রীরা রাজু ভাস্কর্যে মানববন্ধন করে।
শনিবার রাতে চা পান করাকে কেন্দ্র করে রাজশাহীর ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজিতে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়েছে। গত বুধবার রাজধানীর শাহবাগের একটি বারে বিল পরিশোধ করাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ ও বার কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার এক সভায় এস এম হলের সভাপতি মেহেদী হাসানকে সাময়িক বহিষ্কার, সাধারণ সম্পাদক নিজামুল হক দিদার ও জিয়া হল সভাপতি আবু সালমান প্রধান শাওনকে সতর্ক করা হয়।
গত মঙ্গলবার বাঙলা কলেজে দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পিন্সিপাল আবুল কাসেম ছাত্রাবাসে অস্ত্র মজুদ করে ছাত্রলীগ। পুলিশ হল শাখা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদকসহ ১০ জনকে অস্ত্রসহ আটক করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩ জানুয়ারি নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গোলাম মঈনুদ্দীনকে সমাজবিজ্ঞান ভবনের নিচতলায় লাঞ্ছিত করেন ছাত্রলীগ নেতা মামুন। গত শুক্রবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শরিফুল ইসলাম ও উপ-পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম নাভিদের মধ্যে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে পাল্টাপাল্টি চপেটাঘাতের ঘটনা ঘটে।
হল দখল, টেন্ডারবাজির পাশাপাশি এবার রাস্তার সরকারি গাছও কাটতে শুরু করেছে ছাত্রলীগের নেতারা। গতকাল বগুড়ার শাহজাহানপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালামের নেতৃত্বে উপজেলার বনভেটি গ্রামের সড়ক থেকে সরকারি গাছ কেটে ফেলা হয়। গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম ও সিলেট সার্কিট হাউসে মন্ত্রী-এমপিদের চোখের সামনেই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। সিলেটের বিশ্বনাথে থানা ভাঙচুর করেছে ছাত্রলীগ। ২০০৯ সালে সরকার দায়িত্ব নেওয়ার তিন মাসের মাথায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিজেদের মধ্যে মারামারিতে নিহত হন কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ ওরফে রাজীব। মহাজোট সরকারের প্রায় শেষ দিকে এসে ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে নির্মমভাবে বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলের শিক্ষার্থী আবু বকর সিদ্দিক হত্যা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ হত্যার বিচার হয়নি এখনো। নিজেদের মধ্যে অসংখ্য মারামারির ঘটনা, প্রতিপক্ষের ওপর হামলার সময় অস্ত্র প্রদর্শন, টেন্ডারবাজি, শিক্ষকদের ওপর হামলার বিচার কেউ চাইছেই না।