সকাল বিকাল কথা পরিবর্তন আর নানা রকম ডিগবাজিতে সেরা সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দেশের রাজনীতি নিয়ে নানা রঙ্গের খেলা খেলতে গিয়ে অবশেষে নিজের খেলায় নিজেই ধরা পড়ে গেলেন তিনি। জীবনের শেষ বয়সে এসে নির্বাসিত হতে চলেছেন রাজনীতি থেকে। আর এর নেপথ্যে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদসহ দলের কিছু শীর্ষ নেতা। এরই মধ্যে দলের কর্তৃত্ব তার থেকে ছিনিয়ে নিতে যা যা করা বলা যায় সিংহভাগই অতিক্রম করেছেন বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ। দলীয় পতাকা ছিনতাই, নির্বাচন কমিশনে এরশাদকে আউট করে চিঠি দেওয়াসহ নানা রকম প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছেন বেগম রওশন এরশাদ। এমনকি এরশাদকে বিদেশ পাঠাতে রওশন নতুন করে তৎপরতা চালাচ্ছেন বলেও দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
জাপা সূত্রের দাবি, এসকল প্রক্রিয়ায় রওশনের সঙ্গে রয়েছেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ. জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, তাজুল ইসলাম চৌধুরী, মুজিবল হক চুন্নু, মশিউর রহমান রাঙ্গাসহ দলের অধিকাংশ প্রেসিডিয়াম সদস্য। নতুন করে এ গ্রুপে যুক্ত হয়েছেন আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ। কার্যত এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাপা এখন দুই ভাগে বিভক্ত। এরমধ্যে সিংহভাগই রওশনের নেতৃত্বে।
তবে এরশাদপন্থি নেতাদের অভিযোগ, আগ থেকেই এরশাদকে রাজনৈতিকভাবে নির্বাসিত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়ে মাঠে নেমেছেন দলটির দুই শীর্ষ নেতা। আর এই পরিকল্পনার গুটি হিসাবে ব্যবহার করছেন রওশনকে। তারা চান রওশনকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে সব-ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে এবং দলের কর্তৃত্বও আনতে চান নিজেদের হাতে। রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেই এসব কার্যক্রম চালাতে চেয়েছিলেন এরা।
কিন্তু ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রওশন থাকলেও চেয়ারম্যানের পদে বহাল তবিয়তে থাকবেন এরশাদ। তিনি যে কোন সময় চাইলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দিতে পারেন রওশনকে। এই পদ্ধতিতে উদ্দেশ্য সফল হবে না বলেই তারা রওশনের হাতে তুলে দিয়েছেন নতুন ছক।
জাপা সূত্রে জানা গেছে, দলের আনুষঙ্গিক কার্যক্রম থেকে কৌশলে এরশাদকে দূরে রাখার পরামর্শ রওশনকে দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। সকল কার্যক্রম পরিচালনায় দলের অধিকাংশ প্রেসিডিয়াম সদস্যকে ভাগিয়ে আনতেও পরামর্শ দেওয়া হয় রওশনকে। যাতে যেকোন সময় ইচ্ছা করলেই চেয়ারম্যানের পদ থেকে এরশাদকে অপসারণ করা যায়। আর তা পরিপন্থী হবে না দলটির গঠনতন্ত্রের।
এ অনুযায়ী কাজও শুরু করেছেন বেগম রওশন এরশাদ। সংসদীয় দলের বৈঠক, সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন, স্মৃতিসৌধের কর্মসূচিসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে এরশাদকে। গত ৮ জানুয়ারি থেকে পরপর ৪টি সংসদীয় দলের বৈঠক করে জাতীয় পার্টি। এর কোনটিতেই উপস্থিত ছিলেন না চেয়ারম্যান এরশাদ। এ সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত উত্তর দিতে পারেন নি জাপার শীর্ষ নেতারা। সর্বশেষ, ২৮ জানুয়ারির এমপিদের বৈঠকে এরশাদের অনুপস্থিতি সম্পর্কে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তা কৌশলে এড়িয়ে যান দলটির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নব নির্বাচিত বিরোধী দলীয় চীফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। এর পরের দিন দশম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে যোগ দিলেও অনেকটা চুপচাপ ছিলেন এরশাদ। দলীয় নেতারা তো দূরের কথা স্বয়ং স্ত্রী রওশনের সঙ্গেও কথা বলতে দেখা যায়নি সাবেক এই রাষ্ট্রপতিকে।
এছাড়া গত ১২ জানুয়ারি সিএমএইচ থেকে এরশাদ বাসায় ফেরার পর দলটির মধ্যম সারির নেতারা প্রেসিডেন্ট পার্কে ভিড় জমালেও এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি উল্লেখযোগ্য শীর্ষ নেতাদের। এরা নিয়মিতই যাতায়াত করছেন রওশন এরশাদের বাসায়।
এরশাদকে মাইনাস করার পরিকল্পনার অংশ হিসাবে গত ১৫ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে বিরোধী দলীয় নেতার প্যাডে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে একটি চিঠি পাঠান রওশন। চিঠিতে রওশন এরশাদ বলেন, আমি বর্তমানে বিরোধী দলীয় নেতা। দশম সংসদ নির্বাচনে আমার নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি অংশগ্রহণ করে। অতএব জাতীয় পার্টির নামে এখন থেকে যত চিঠি কমিশন থেকে ইস্যু করা হবে তা যেন আমার নামে করা হয়। এজন্য কমিশনকে অনুরোধ করা হলো।
এর আগে দলীয় প্রধানের পতাকা এরশাদের বারিধারাস্থ বাসভবন প্রেসিডেন্ট পার্ক থেকে নিয়ে আনার জন্য একজন কর্মচারী পাঠান রওশন। যদিও এরশাদের শক্ত হস্তক্ষেপে তা আর সম্ভব হয়ে উঠেনি।
এছাড়া গত ১৯ জানুয়ারি এরশাদকে ছাড়াই স্মৃতিসৌধে যায় রওশনের নেতৃত্বে জাপার সংসদীয় দল। সেখানে জড়ো হওয়া স্থানীয় নেতাকর্মীদের এরশাদের নামে শ্লোগান দিতে দেয়নি উপস্থিত শীর্ষ নেতারা। স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে এরশাদের অনুপস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে হালকা রেগে গিয়ে রওশন বলেন, তিনি ব্যস্ত তাই আসেননি।
এর কয়েকঘন্টা আগ থেকেই স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে সেখানে অবস্থান করছিলেন জাপা প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ। নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে প্রকাশ্যে এরশাদের নামে তীব্র সমালোচনা করতে দেখা যায় ফিরোজ রশিদকে।
গত কয়েকদিন ধরে চলা এসব কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কথা বলতে চাইলে মুখ খুলতে রাজি হননি জাপার কোনো শীর্ষ নেতা। তবে এ ব্যাপারে এরশাদ সমর্থক একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী জাতীয় পার্টিতে পরিণত করা ও এরশাদকে নির্বাসনে পাঠানোর জন্য রওশনকে ব্যবহার করছে জাপার কিছু শীর্ষ নেতা। রওশন এরশাদের সহজ সরলতার সুযোগ নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে অপতৎপরতা চালাচ্ছেন তারা।
তিনি বলেন, ক্ষমতার বাইরে থাকা গত ২২ বছরে যতবারই এ দলটির সংকট এসেছে ততবারই এসব নেতা তাদের লোভ লালসা চরিতার্থ করতে এরশাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই জাপার জন্য ক্ষতিকর। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে আওয়ামী লীগ। এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যতবার ক্ষমতায় এসেছে লাঙ্গল প্রতীক ও মন্ত্রীত্ব দিয়ে জাপাকে ভাঙ্গার চেষ্টা করেছে। আর এতে সহযোগিতা করেছে এমন কিছু নেতা যাদেরকে বিভিন্ন পর্যায় থেকে তুলে এনে খ্যাত করেছেন এরশাদ।
প্রসঙ্গত, নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে নানা রকম বিভ্রান্তি ছড়ানোর পর গত বছরের ৩ ডিসেম্বর চূড়ান্তভাবে নির্বাচন থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন জাপা চেয়ারম্যান। এরপর থেকে জাপা নেতারা বিভিন্ন নাটকের আশ্রয় নিলেও বরাবরই নির্বাচন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্তে অটল থাকার কথা জানিয়েছেন এরশাদ। গত ১২ ডিসেম্বর অসুস্থতার কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয় সিএমএইচে। সেখানে এরশাদকে সাইড লাইনে বসিয়ে রেখে নির্বাচনে থেকে যায় রওশন এরশাদ অনুসারী জাতীয় পার্টি। এরশাদকে ছাড়াই শপথ নেন দলের এমপিরা। ওই দিনই জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের বৈঠকে এরশাদকে তুলোধুনো করেন এসব এমপি।
তাদের অভিযোগ, বারবার সিদ্ধান্ত বদল করে এরশাদ তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস করছেন, হেয় করছেন দেশের মানুষের সামনে। তাই তারা আর এরশাদের নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি নন। এরপর এরশাদকে আড়ালে রেখে মন্ত্রিসভায় যোগ দেন জাপার তিন এমপি। অবশ্য এরশাদের ভাগ্যে জুটে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ।