মাহবুব-উল-আলম খান
সরকারের সামগ্রিক কর্মকান্ড, সফলতা কম নয়। কিন্তু কেমন যেন একটি নেতিবাচক ধারণা সর্বত্র বিরাজমান। মাননীয় মন্ত্রীগণ, উপদেষ্টাগণ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চারপাশের লোকজন তা আাঁচ করতে পারছেন কি-না জানিনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে কি সঠিক ধারণা দেয়া হচ্ছে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি প্রকৃত ঘটনা বুঝতে পারছেন, জানতে পারছেন? সব কিছুই কেমন এলোমেলো হযবরল মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কোথায় একটি সুক্ষ্ম ক্রিয়াকলাপ সুষ্ঠু গতিধারাকে ব্যাহত করছে। রাজনীতি, প্রশাসন, রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেমন একটি নিষ্ক্রিয় ভাবধারা। বিরোধী দল অবাধে বলগাহীন, লাগামহীন বক্তব্যে মানুষের কান ঝালাপালা করছেন। কিন্তু কিছুরই উত্তর নেই। যথার্থ উত্তর থাকলেও কেউ দিতে পারছেনা। সবকিছু প্রধানমন্ত্রীকেই বলতে হচ্ছে। মন্ত্রীগণ কি মন্ত্রণা দিচ্ছেন বুঝা মুস্কিল। এত বড় উপদেষ্টা পরিষদ কি উপদেশ দিচ্ছেন বোধগম্য নয়। কেউ কেউ রুলস অব বিজনেস এর বাইরে বিচরণ করছেন। নিয়ম-কানুন, বিধি বিধান সব অবজ্ঞা হচ্ছে। কেন এমন অগোছালো, অনিয়ম হবে? ২০০১-২০০৬ এর বিভিষিকাময় দিনের তুলনায় বর্তমানে এত সুন্দর অবস্থায়ও কেন সব থমকে থাকবে। মানুষ কেমন যেন আস্থা হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছে। ক্ষমতার কাছাকাছির লোকজন কি কিছু বুঝতে পারছেন না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সব কিছু তুলে ধরার কেউ কি কোথাও নেই? প্রধানমন্ত্রীর চারপাশে অনেকেই আছেন, কিন্তু কে কোন কাননের পাখি বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। মুখে কোকিল কন্ঠ অন্তরে বিষ নিয়ে যদি কেউ ঘাপটি মেরে থাকে তা হলে কি হবে? চারপাশে যদি দক্ষ কমিটেড আমলা না থাকে পরীক্ষিত, সৎ, আদর্শবান রাজনীতিবিদ না থাকেন, উপদেষ্টা না থাকেন তাহলে সুশাসন কায়েম কঠিন বৈকি।
ইতোমধ্যে বিরোধীদলীয় নেত্রী সারাদেশ সরগরম করে চলেছেন। অদ্ভুত উদ্ভট নানাবিধ বক্তব্যে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। তিনি ২০০১-২০০৬ এর বিভিষিকাময় দিনগুলির অত্যাচার, অবিচার, অনাচার, নির্যাতন, হত্যা, সন্ত্রাস, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অরাজকতা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে ইয়াজউদ্দিনের দুষ্কর্ম, তার আমলের নির্বাচন কমিশন, দুদক ও নানাবিধ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম মানুষ এখন ভুলতে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে খালেদা-নিজামী-ইয়াজউদ্দিন এই ত্রিরতেœর দুষ্কর্মের ফল হলো ১/১১ এর ঘটনা। ঘটনার নায়ক ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিন-ইয়াজউদ্দিন। ফখরুউদ্দিন সৌভাগ্যক্রমে খালেদা জিয়ার ঘরানারই লোক। তার লোক বলেই খালেদা জিয়া কৌশলে রক্ষা পেয়েছেন। এখন নির্বিঘেœ রাজনীতি করছেন এবং সুযোগ বুঝে কৌশলে মইনউদ্দিন, ফখরুদ্দিনের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছেন। সত্যি বিচিত্র এদেশ। ইয়াজউদ্দিন, ফখরুদ্দিনের জন্যই তাঁর ছেলে, ভাই, আত্মীয়স্বজন, দলীয় লুটেরাগণ আজ ফুরফুরে আমেজে ভাসছেন। এরা তাদেরকে পুনর্বাসন করে গেছেন। না হলে এত অপকর্ম, এত হিংস্রতা এত নোংরামির বিচার হলো না কেন? যে নেতা নেত্রী মিথ্যার বেসাতি করেন, জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করেন তাদের কাছে জনগণ কি আশা করতে পারে? উল্লেখ্য খালেদা জিয়া তিনটি জন্মদিনের অধিকারী, অপ্রদর্শিত আয়ের মানে লুণ্ঠনের বা অবৈধ আয়ের টাকার জন্য কর দিয়েছেন। কালো টাকা শুধু তিনিই সাদা করেননি; তার সরকারের অনেক মন্ত্রী, নেতা-নেত্রী এ কাজ করেছেন। সৌদি আরব ভ্রমনের সময় শতশত বাক্সভর্তি সম্পদ অর্থ ইত্যাদি পাচার করেছেন। লুণ্ঠিত টাকা দিয়েই তার ছেলেদ্বয় সপরিবারে এখন বিদেশে রাজার হালে কালাতিপাত করছেন। তারা মানিলন্ডারিং এর জন্য, দুর্নীতির জন্য বিদেশি আদালতে সাজাপ্রাপ্ত এজন্য ঐ দলের নেতানেত্রীদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। একেই বলে বাংলাদেশ নটরিয়াস পার্টি। গাড়ি মার্চ করে, বিভিন্ন সভায় তারা এখন উচ্চস্বরে নর্দন কুর্দন করছেন। মীর্জা ফখরুলরা, নজরুলরা, মওদুদরা, আনোয়ারেরা, গয়েশ্বরেরা, জয়নুলেরা ও অনেক নেতা -পাতি নেতারা এখন বেপরোয়া লাগামহীন বক্তব্য দিয়ে কান ঝালাপালা করে ফেলছেন। চোরের মার এত বড় গলা মানুষ বুঝতে পারছে। সরকার পতনের সময়ও তারা নির্ধারণ করে যাচ্ছেন। ভিতরে ভিতরে চলছে ষড়যন্ত্রের মহড়া। ৭১ এর ঘাতক বাহিনী, ৭৫ এর হত্যাকারী বাহিনী, ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলা বাহিনী জামাত শিবিরের জঙ্গী বাহিনী এদের সংস্পর্শে এসে এখন আরো গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বিদেশে বসে তারেক, ডালিম ষড়যন্ত্রের কলকাঠি নাড়ছেন বলে নানাবিধ খবর প্রকাশিত হচ্ছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর হতেই এই তৎপরতা শুরু হয়েছে। কিছুদিন আগে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের সংশ্লেষ এর প্রমান করে। আমাদের দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনী সাম্প্রতিক এই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়েছেন। তাদেরকে লালগোলাপ শুভেচ্ছা। কিন্তু ঘাপটি মেরে থাকা এই কুচক্রীদের সমূলে ধ্বংস করতে হবে। নইলে দেশ ও জাতি রক্ষা পাবে না। ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে ফখরুলরা ও মওদুদরা যেভাবে গলাবাজি করছেন তাতে হাসি পাচ্ছে। ধরা পড়ে এখন আবোল তাবোল বকছেন। ঠাকুর ঘরে কেরে আমি কলা খাইনা ভাব। ৭৫ সনের জনক হত্যার সফল ষড়যন্ত্রের ধারা এখনো চলছে। ২১ আগষ্ট ২০০৪ এর ঘটনা ঐ হত্যারই আর এক অধ্যায়। জাতির জনকের বেঁচে থাকা কন্যা হত্যাই ছিল তাদের মূল টার্গেট। ঐ প্রচেষ্টা চলছে। চিরতরে স্তব্ধ করা না গেলে এই প্রক্রিয়া ও ষড়যন্ত্র চলবেই। ২৫ ফেব্র“য়ারী ২০০৯ বিডিআর হত্যা, ঐ হত্যা ষড়যন্ত্রেরই ধারাবাহিকতা। ডিসেম্বর ২০১১ ও জানুয়ারী ২০১২ এর সেনা অভ্যুত্থান ষড়যন্ত্র আর একটি হত্যা পরিকল্পনা। যেভাবে তারা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫। তখন তারা সফল হয়েছিল। আবার একই ধারাবাহিকতায় এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা। ষড়যন্ত্রের আসল হোতারা এখন থমকে আছে। নিত্য নতুন কায়দা-কানুনের অপেক্ষায় তারা।
সকল ষড়যন্ত্র, চক্রান্তকে ধুলিস্যাৎ করে দিতে হবে। নইলে দেশ ও জাতির সুষ্ঠু গতিধারা সম্ভব নয়। কুচক্রীরা, কালো নাটকের ইবলিসেরা এখন বেপরোয়া; নিত্য নতুন কৌশলের অপেক্ষায়। অতএব সরকারকে অত্যন্ত সাবধান হতে হবে। নির্বাচনী অঙ্গীকার দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। ত্যাগী ও ঝানু রাজনীতিবিদ, দক্ষ কমিটেড আমলা ছাড়া দিন বদলের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ভিশন ২০২১ বাস্তবায়ন করতে হলে সে চিন্তা চেতনায় এগুতে হবে। সরকারের হাতে এখন মাত্র পৌনে দু’বছর সময় আছে। এই সময়ের মধ্যে মানুষের মৌলিক চাহিদার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। দ্রব্য মূল্যের মূল্য সহনশীল রাখতে হবে। বিদ্যুৎ সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে হবে। শেয়ার বাজার কেলেংকারীর হোতাদের কাঠোর শাস্তি দিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা সঠিক রাখতে হবে। সর্বোপরি মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হতে হবে। অনাহুত কথা বলে ইস্যু সৃষ্টি করতে দেয়া হবে চরম বোকামী। কথাবার্তা, আচার-আচরণ হবে রাষ্ট্রনায়কোচিত। জনকল্যাণে হতে হবে নিবেদিত প্রাণ। রাজনীতিতে প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীরা অত্যন্ত কৌশলী। সরকারের বারটা বাজানোর জন্য তারা অত্যন্ত সন্তর্পনে কাজ করে যাচ্ছে। ঘাপটি মেরে থাকা আমলারা মন্ত্রী, উপদেষ্টাদের ভুল বুঝিয়ে বিপথগামী করছে। কিছুদিন আগে এক ভদ্রলোক বলছিলেন, কতিপয় সরকারি কোম্পানি গঠনের পূর্বে মেমোরেন্ডাম এন্ড আর্টিকেলস অব এসোসিয়েশন ও কোম্পানির বোর্ড গঠনের যে সিদ্ধান্ত ছিল তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মাননীয় উপদেষ্টা ও মন্ত্রীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে নিজেদের কুট-কৌশল ও স্বার্থ হাসিলের জন্য মূল বিধি বিধান গাইড লাইন সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়ে নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে সিদ্ধান্ত জারী করেছে। নিজের দাপ্তরিক কাজ নিয়েই যেখানে ব্যস্ত থাকার কথা, সেখানে একটি সুষ্ঠু ধারা ও স্বত্ত্বাকে ধ্বংস করা ব্যাক্তি স্বার্থ হাসিলের চিন্তা ছাড়া আর কিছুই নয়। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় যে আলোচনাই হয়নি সিদ্ধান্ত লিখতে গিয়ে তেমন এক সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। অসৎ উদ্দেশ্যে আলোচনা বিহীন মিথ্যা সিদ্ধান্ত কিভাবে মাননীয় মন্ত্রী অনুমোদন করলেন বোধগোম্য নয়। তাঁর সরলতাকে দুষ্ট চক্র ব্যবহার করেছে সুকৌশলে। এভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চলছে এক গভীর ষড়যন্ত্র। সকল অপতৎপরতাকে শক্ত হাতে দমন করতে না পারলে সরকার ব্যর্থ হতে বাধ্য। সরকারের এ খেয়াল আছে কি-না জানিনা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকান্ডকে আরো গভীরভাবে মনিটরিং করতে হবে। কতিপয় দুষ্টু চক্রের জন্য সরকারের সামগ্রিক প্রয়াস ব্যর্থ হতে পারে না। দিন বদলের অঙ্গীকার নিয়ে সরকার ক্ষমতায় এসেছে। একে বাধাগ্রস্থ করার জন্য লোকের অভাব সরকারে নেই। তারা সেই প্রেসক্রিপশন অনুসারে কাজ করছে। ঘাপটি মেরে আছে সাধু সেজে অত্যন্ত কাছের লোক হিসেবে। জানিনা মাননীয় মন্ত্রীগণ, উপদেষ্টাগণ এ ব্যাপারে সজাগ কি-না। সজাগ থাকলে সকল ভুলভ্রান্তি শোধরিয়ে প্রশাসনকে গতিশীল করতে হবে। ময়ূর পুচ্ছ পরে দাঁড়কাকদের চিহ্নিত করে এদের অপতৎপরতা হতে প্রশাসনকে রক্ষা করতে হবে এবং সরকারের সকল শুভ প্রয়াসকে বাস্তবায়ন করতে হবে। দিন বদলের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য দিন বদলের কারিগর প্রয়োজন। সময় চলে গেলে তখন পস্তাতে হবে। তখন এইসব কুচক্রীরা বিরোধীদের শিবিরে গিয়ে উচ্চস্বরে বলবে আমরাই আপনাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছি নানা কুটচাল দিয়ে। আমাদের আরো সুখ দিন। এখনো সময় আছে মন্ত্রীসভাকে অবিলম্বে পরিবর্তন অপরিহার্য্য হয়ে গেছে। কতিপয়কে অবশ্যই বাদ দিতে হবে এবং কতিপয় অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভূক্ত করা এখন সময়ের দাবী। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত কর্মকর্তাদের প্রয়োজনে চুক্তিভিত্তিতে অবিলম্বে গুরুত্বপূর্ণ উপযুক্ত পদে পদায়ন করা প্রয়োজন। দেশ ও জাতির উন্নয়নের জন্য, নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য, জাতির জনকের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য এবং দিন বদলের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য এর বিকল্প আর কিছু আছে কি? অতএব সকল ভুলভ্রান্তি শোধরিয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে এখনই। জনগণকে হতাশার দিকে ঠেলে দেবেননা। জাতিকে উদ্ভাসিত হতে দিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, আগামী এক সুন্দর ভবিষ্যতের প্রত্যাশায়। যাতে এদেশের মানুষ মনের মাধুরী দিয়ে গাইতে পারে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।
(লেখক সাবেক সচিব)