দ্বি-স্তর বিশিষ্ট টেস্ট চালুর সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেছে। কিন্তু আসলেই কি শেষ পর্যন্ত পরাজয় হয়েছে ‘তিন মোড়লে’র? নাকি নতুন মোড়কে তাদের বাকি সব গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলোই পাস করিয়ে নেওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে তারা? যে প্রস্তাবগুলোর ব্যাপারে ‘সর্বসম্মতভাবে’ সবাই একমত হয়েছে বলেই জানিয়েছিল আইসিসি।
অবশ্য এ নিয়েও বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সভা শেষে সংবাদ বিবৃতিতে আইসিসি জানিয়েছিল, আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো চুক্তি স্বাক্ষর বা প্রস্তাব পাস না হলেও বেশ কিছু ব্যাপারে ‘সর্বসম্মতভাবে একমত’ হয়েছে আইসিসি বোর্ড। তবে আইসিসির এই দাবি নাকচ করে দিয়েছে দুটো বোর্ড। সভায় উত্থাপিত কোনো প্রস্তাবে ‘সর্বসম্মতভাবে একমত’ হয়নি বলে জানিয়েছে ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকা (সিএসএ) ও পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি)।
আইসিসির প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত ‘সর্বসম্মতভাবে একমত’ হওয়ার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে এরই মধ্যে বিবৃতি দিয়েছে পিসিবি ও সিএসএ। পিসিবি নিজেদের ওয়েবসাইটে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছে, ‘পিসিবি পরিষ্কার জানাচ্ছে, পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন সাপেক্ষে আইসিসি সভার নীতিমালার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পিসিবির পরিচালনা পর্ষদে বিষয়টি তোলা হবে। এরপর সে অনুযায়ী আইসিসির পরবর্তী সভায় অবস্থান নেবে পিসিবি।’
অন্যদিকে সিএসএও তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে, ‘সব সদস্য দেশের স্ব-স্ব বোর্ডের অনুমোদনের পর ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখে অনুষ্ঠিত আইসিসির পরবর্তী সভায় সমর্থনের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।’ সিএসএ সভাপতি ক্রিস নেনজানি জানিয়েছেন, ‘উল্লিখিত নীতি বা ধারার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সিএসএ বোর্ড ও এর মূল অংশীদাররা শিগগিরই বসবে। সিএসএ বোর্ড সভার আগে কোনো মন্তব্য করা যাচ্ছে না।’
কূটনৈতিক উত্তর দিলেও শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের (এসএলসি) সভাপতি জয়ন্থা ধর্মদাসাও জানিয়েছেন, তাঁরাও এ ব্যাপারে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে আসেননি, ‘আইসিসির পজিশন পেপারের ব্যাপারে এসএলসি নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আরও আলোচনা প্রয়োজন।’ তিন বোর্ডের প্রস্তাবিত ‘পজিশন পেপারে’র বিরুদ্ধে এই পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিল বাংলাদেশও। তবে এ ব্যাপারে এখনো কিছু জানায়নি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)।আগামীকাল সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানানো হবে বলে জানিয়েছে বিসিবির একটি সূত্র।
গতকাল প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে ‘ভোট হওয়া’ এড়ানো গেলেও ‘সর্বসম্মতভাবে’ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির কিছু উপায় তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছিল আইসিসি। সংস্থাটি এ-ও জানিয়েছিল, আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সমাধান হতে পারে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠেয় সভায়। পূর্ণ সদস্য দেশগুলোর টেস্ট মর্যাদা নিয়ে কোনো সমস্যা না হলেও বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছিল, ‘আইসিসিতে শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রয়োজন। যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র হবে বিসিসিআই।’
দ্বি-স্তরবিশিষ্ট টেস্ট প্রবর্তনের প্রস্তাব থেকে সরে এলেও বাকি প্রস্তাবগুলো থেকে খুব বেশি সরে আসেনি ‘তিন মোড়ল’। প্রস্তাবের ধারায় কিছু কিছুপরিবর্তন এনে এ নিয়েই দিনভর দরকষাকষি হয়েছে। এখন আইসিসির আয়ের একটা নির্দিষ্ট অংশ ১০ দেশের মধ্যে সমান ভাগ হয়। পজিশন পেপারের প্রস্তাবে ছিল, তিন মোড়লের জন্য সিংহভাগ আয়ের বরাদ্দ রেখে ছয়টি বোর্ডের জন্য টেস্ট ক্রিকেট ফান্ড গঠন করা হবে। বাদ পড়েছিল কেবল দক্ষিণ আফ্রিকা। সংশোধনী এনে সেই তালিকায় দক্ষিণ আফ্রিকাকেও যুক্ত করা হয়েছে। এই ফান্ডের ফলে সাত টেস্ট খেলুড়ে দেশের আয় আগের তুলনায় বাড়বে সত্যি। কিন্তু তুলনামূলকভাবে বেশিগুণ আয় বাড়বে তিন মোড়লের। আরও স্পষ্ট করে বললে ভারতের।
এ ছাড়া সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এক্সকো (নির্বাহী কমিটি) এবং এফঅ্যান্ডসিএ (অর্থ ও বাণিজ্য সম্পর্কিত কমিটি) গঠনের প্রস্তাব থেকেও সরে আসা হয়নি। আগের প্রস্তাবে ছিল এই কমিটি হবে চার সদস্য বিশিষ্ট, যার তিনটিতেই স্থায়ী পদ থাকবে ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের। সঙ্গে চতুর্থ আরেকটি দেশ। প্রস্তাবটি সংস্কার করে বলা হয়, চারটির বদলে পদ থাকবে পাঁচটি। তবে ওই তিনটি দেশের সদস্য নিশ্চিত থাকবে। এই কমিটির প্রধান হিসেবে ভারতের শ্রীনিবাসনের দায়িত্ব পাওয়াও মোটামুটি নিশ্চিত।
এই প্রস্তাবের পক্ষে এরই মধ্যে বেশ জোরেশোরে বলতে শুরু করেছে প্রস্তাবিত ক্ষমতার ভর কেন্দ্রের বাইরে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তাদের বক্তব্য, প্রস্তাবিত নীতিমালা অনুমোদন হলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের আয় ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে।
টেস্ট স্ট্যাটাস বাতিলের ধুয়া তুলে প্রথমে চাপে ফেলে দেওয়া, এরপর সেই প্রস্তাব বাতিল করলেও অন্য প্রস্তাবগুলো কিছুটা এদিক-ওদিক করে টোপ ফেলে বিরুদ্ধ মতকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসা—তিন মোড়ল অনেকাংশেই সফল বলেই মনে হচ্ছে। এখন সবগুলো বোর্ড নিজ নিজ দেশে ফিরে গিয়ে তাদের নির্বাহী কমিটিতে আলোচনা করবে। সেই আলোচনায় নিজেদের লাভ-ক্ষতি বিবেচনা করার পরই ৮ ফেব্রুয়ারির সভায় দেবে রায়। সূত্র: পিসিবি, সিএসএ, পিটিআই ও ক্রিকইনফো।
ক্যাপ: সভা চলাকালে (বাঁ-থেকে) আইসিসির সহ-সভাপতি মুস্তফা কামাল, সভাপতি অ্যালান আইজ্যাক ও প্রধান নির্বাহী ডেভ রিচার্ডসন