সাগর-রুনির খুনিরা দুই বছরেও অধরা

সাগর-রুনির খুনিরা দুই বছরেও অধরা

সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনির খুনিরা অধরাই থেকে যাচ্ছে। সময়ের ব্যবধানে অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে বহুল আলোচিত এই হত্যা মামলার তদন্ত কার্যক্রম। প্রায় দুই বছর ধরে কেবল ডিএনএ প্রতিবেদনের কথা বলেই সময় পার করছে এলিট ফোর্স র‌্যাব (র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন) কর্মকর্তারা। আদৌ সাগর-রুনি দম্পতি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন হবে কিনা এ নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন নিহতদের স্বজন ও তাদের ঘনিষ্ঠজনরা। সাংবাদিক সাগর সরোয়ারের মা সালেহা মনির বলেন, আমরা হতাশ হয়ে গেছি। এত দিন আশায় বুক বেঁধেছিলাম। আমার মানিকের খুনিরা কি এতই শক্তিশালী?
তবে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান দাবি করেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাগারে পাঠানো হত্যার আলামত থেকে ডিএনএ (বংশগতির ধারক) প্রতিবেদনের দিকে তাকিয়ে আছেন। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডটি সব সময়ই র‌্যাব গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছে। এদিকে দেশের ডিএনএ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে পেশাদার অপরাধীদের কোনো ডিএনএ তথ্য ভাণ্ডার না থাকার কারণে খুনি চিহ্নিত করা কঠিন হবে। তবে পর্যায়ক্রমিকভাবে সন্দেহভাজন অপরাধীদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ অব্যাহত রাখতে হবে। তারা আরও বলেন, সাধারণত ঘটনাস্থল থেকে অবিকৃত বা তাজা অবস্থায় রক্ত বা অন্যান্য উপাদান সংগ্রহ করা গেলে এগুলো থেকে ডিএনএ নমুনা বের করা সহজ হয়। কিন্তু সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের প্রায় ৭০ দিন পরে র্যাব ওই ঘটনাস্থল থেকে ফরেনসিক আলামত সংগ্রহ করে। তত দিনে ওই ঘরে আরও বহু মানুষের পা পড়েছে। ঘটনার এত দিন পরে এবং অপরাধস্থলে এর পরে আরও বহু মানুষের উপস্থিতি আলামতগুলোকে নষ্ট করেছে। তাই ওই ফরেনসিক আলামতের ব্যবহারযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা। দেশে ডিএনএ পরীক্ষার ভিত্তিতে কোনো অপরাধীকে শনাক্ত করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্থাপিত বাংলাদেশের একমাত্র ডিএনএ (আইনি কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে) গবেষণাগার ‘ন্যাশনাল ফরেনসিক ও ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাব’-এর প্রধান শরীফ আক্তারুজ্জামান বলেন, গত সাত বছরে এ গবেষণাগারে অনেক পরীক্ষা হয়েছে। তবে অপরাধী শনাক্তকরণের বিষয়টি তদন্তকারীরা বলতে পারবেন। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল ডিএনএ’র প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর না করে মামলা তদন্ত করা ঠিক হচ্ছে না। তদন্তকারী সংস্থা র্যাবের বাইরে অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডে ছায়া তদন্ত করলে এতদিনে হয়তো রহস্য উদঘাটন হয়ে যেত। বাংলাদেশের বাস্তবতায় শুধু ডিএনএ পরীক্ষার সূত্র ধরে অপরাধী শনাক্ত আদৌ সম্ভব কি না, সে বিষয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তারা। র‌্যাব সূত্র জানায়, ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা সাগর-রুনির রক্তমাখা জামাকাপড়, বঁটি, মোজা ইত্যাদি কিছু আলামত পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণাগারে পাঠানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞ ফরেনসিক আলামত সংগ্রহকারীরা ওই ঘর থেকে আরও কিছু আলামত সংগ্রহ করেছিলেন। যদিও পাঠানোর সময়ই এ আলামতগুলোতে লেগে থাকা রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে গিয়েছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক র‌্যাব কর্মকর্তা দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওই গবেষণাগারটি এ ধরনের আলামত থেকে ডিএনএ নমুনা বের করতে পারে বলেই অনেক অর্থ ব্যয় করে তাদের এ কাজটি করতে দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা ওই সব নমুনা থেকে দুজনের পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ-বৃত্তান্ত উদ্ধার করেছে। যেগুলো সন্দেহভাজন হত্যাকারীর বলে সন্দেহ র‌্যাবের। ওই দুই ব্যক্তির ডিএনএ-বৃত্তান্তের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার জন্য ওই হত্যা মামলায় গ্রেফতার আটজনের ডিএনএ নমুনা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো মেলেনি। পরে আরও কিছু আলামত পাঠানো হয়েছিল। সেগুলো পরীক্ষা করতে অনেক সময় নিচ্ছে গবেষণাগারটি। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া ফ্ল্যাট থেকে সাগর-রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রথমে মামলা তদন্ত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ৬২ দিনের মাথায় হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এর পর আদালতের নির্দেশে তদন্তভার নেয় র্যাব। তারা ভিসেরা পরীক্ষার জন্য সাগর-রুনির লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে। ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী নিহত দম্পতির শিশুপুত্র মাহীর সরোয়ার মেঘের সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলে। জিজ্ঞাসাবাদ করে শতাধিক ব্যক্তিকে। গত বছরের মাঝামাঝি থেকে র‌্যাব বলে আসছিল নিরাপত্তাকর্মী এনামুলকে গ্রেফতার করা গেলেই সব রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে। তবে এনামুল গ্রেফতার হলেও রহস্যের কোনো কিনারা হয়নি। বিনা অপরাধে কারাবাস : সাগর-রুনি হত্যা মামলায় সর্বশেষ মোট আটজন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মো. সাইদ, মিন্টু, কামরুল হাসান ওরফে অরুণ, সাগর-রুনির ভাড়া বাসার নিরাপত্তা প্রহরী এনামুল, পলাশ রুদ্র পাল এবং নিহত দম্পতির বন্ধু তানভীর রহমান। এদের মধ্যে প্রথম পাঁচজনই গত বছরের আগস্টে মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র হত্যার ঘটনায় র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে গ্রেফতার হন। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গ্রেফতারকৃতদের কেউই এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত নন। কারও কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পাওয়া যায়নি। গ্রেফতার তানভীরের বাবা প্রকৌশলী মাহাবুবুর রহমান বলেন, ছেলের জন্যে আমার স্ত্রী প্রায়ই অসুস্থ থাকে।
আমার নিজের অবস্থাও ভালো যাচ্ছে না। বিনা অপরাধে আমাদের ছেলেটা কারা যন্ত্রণা ভোগ করছে। বাবা হিসেবে প্রতিটি মুহূর্ত আমি অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগছি। ছয় মাসের বেশি সময় পার হলেও সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আনতে পারেনি র‌্যাব।

জেলা সংবাদ বাংলাদেশ