পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনকে ‘প্রহসন’, ‘প্রতারণা’ ও ‘জালিয়াতি’ বলে অ্যাখ্যায়িত করলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, এই ধরনের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার সম্পূর্ণ অবৈধ ও জনগণের অনুমোদনহীন। গায়ের জোরে তারা বেশিদিন ক্ষমতায় টিতে থাকতে পারবে না। গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার ফিরে পেতে জনগণের চলমান আন্দোলনের বিজয় অনিবার্য। এটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দশ দিন পর গতকাল বুধবার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
রাজধানীর গুলশানে ওয়েস্টিন হোটেলে আয়োজিত জনাকীর্ণ এই সংবাদ সম্মেলনে ‘অবৈধ’ আখ্যা দিলেও সরকারের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেছেন, ৫ জানুয়ারির কথিত নির্বাচনেই প্রমাণিত হয়েছে যে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। তাই বলবো-সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় আসুন। সমঝোতাই সংকট সমাধানের একমাত্র পথ। আমি সংলাপের আহ্বান জানাচ্ছি। সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি করতে ১৮ দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ সকল নেতা-কর্মীকে মুক্তি দিতে হবে, তাদের বিরুদ্ধে করা মিথ্যা মামলাসমূহ প্রত্যাহার করতে হবে, বিএনপির কেন্দ্রীয় সদর দপ্তরসহ সকল রাজনৈতিক কার্যালয় খুলে দিয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ করে দিতে হবে।’ পরে এ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকার থেকে সংলাপের কোনো প্রস্তাব আমরা এখনও পাইনি। আমরা মনে করি, সংলাপই সমাধানের পথ।’
লিখিত বক্তব্য শেষে সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর পর্বে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমরা কোনো কূলই হারাইনি। আওয়ামী লীগই সব কূল হারিয়েছে। তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। নির্বাচনে অংশ না নিয়ে খালেদা জিয়া এ-কূল ও-কূল দু’কূলই হারিয়েছেন’ নির্বাচনের পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই মন্তব্য সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি পাল্টা একথা বলেন।
জামায়াতের সহিংসতার দায় বিএনপির ওপর বর্তাচ্ছে কি-না এবং জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে সংলাপের জন্য সরকারের আহ্বান সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে ১৮ দলীয় জোট নেত্রী বলেন, ‘জামায়াত একটি রাজনৈতিক দল। ‘৮৬ সালের প্রহসনের নির্বাচনে না যাওয়ার জন্য আমরা চুক্তিবদ্ধ ছিলাম। সেই চুক্তি ভঙ্গ করে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত সেদিন নির্বাচনে গিয়েছিল। বিএনপি সেদিনও নির্বাচনে যায়নি। তাছাড়া ১৯৯৫-‘৯৬ সময়ে এই আওয়ামী লীগই তো জামায়াত ও জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করেছিল।’
নির্বাচনের আগে-পরে আন্দোলনে সহিংসতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘বিএনপি কোনো সহিংসতা করেনি। আমরা সংিহসতায় বিশ্বাসীও নই। আমাদের আন্দোলন সঠিক ছিল, এখনো আছে। আন্দোলন চলমান থাকবে।’
বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি রাষ্ট্রের ভূমিকাকে ইঙ্গিত করে একজন সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি প্রধান বলেন ‘আমরা সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চাই। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য কারও হস্তক্ষেপ আমরা চাই না। আমাদের সঙ্গে দেশের জনগণ রয়েছে, জনগণই আমাদের শক্তির উত্স।’
লিখিত বক্তব্যে খালেদা জিয়া বলেন, বাংলাদেশ এখন পুরোপুরি গণতন্ত্রহীন, এখানে এখন গণতন্ত্র মৃত। ৫ জানুয়ারির প্রহসন ও জালিয়াতির নির্বাচনের কারণে বাংলাদেশ আবার বহুদূর পিছিয়ে গেছে। নতুন করে এখন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম করতে হবে সবাইকে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে গড়ে ৫ শতাংশ ভোটও পড়েনি। সরকারের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন (ইসি) সেটিকে দেখিয়েছে ৪০ শতাংশ।
ভোটদান থেকে বিরত থাকার জন্য দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়ে আন্দোলনে নতুন কিছু কর্মসূচি ঘোষণা করেন ১৮ দলীয় জোট প্রধান। তিনি বলেন, আগামী ২০ জানুয়ারি আমরা দেশবাসীকে আনুষ্ঠানিকভাবে ধন্যবাদ জানাবো। ওইদিন ১৮ দল সারাদেশে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গণসমাবেশ এবং শোভাযাত্রা করবে। ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে এই সমাবেশ হবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ১৮ জানুয়ারি সারাদেশে জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকী পালন করা হবে, এদিন জাতীয় প্রেসক্লাবে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া আগামী ২৯ জানুয়ারি ঢাকাসহ সারাদেশে শান্তিপূর্ণ কালো পতাকা মিছিল হবে। এসব কর্মসূচির পাশাপাশি আমি নিজেও কয়েকটি অঞ্চল সফর করবো, বিএনপিসহ ১৮ দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও সফরে যাবেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, “ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত অবৈধ সরকার বলছে ‘কারও কাছে মাথা নত করবো না।’ এটা দম্ভোক্তি ও স্পর্ধা।”
দেশের বিভিন্ন স্থানে সংল্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা-নির্যাতনের নিন্দা জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, এখন সবার আগে আমাদেরকে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের ধরে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এখন করা না হলে ভবিষ্যতে শুধু বিচার বিভাগীয় তদন্তই নয়, প্রয়োজনে জাতিসংঘের মানবাধিকার ইউনিটের সহায়তা নিয়ে এসব ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলত শাস্তি দেয়া হবে। তিনি অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগই এসব হামলা চালাচ্ছে। অথচ একতরফা অপপ্রচার চালিয়ে দোষ চাপানো হচ্ছে বিরোধী দলের ওপর।
খালেদা জিয়া বলেন, ৫ জানুয়ারি এই সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ নীরব প্রতিবাদ জানিয়েছে। সমঝোতার জন্য আমরা তাদের বারবার আহ্বান জানিয়েছি। রাজনৈতিক বৈচিত্র্যের মধ্যদিয়েই জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার কথা বলেছি। কিন্তু তারা সে আহ্বানে সাড়া দেননি। তারা কারসাজির মাধ্যমে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। ৫ জানুয়ারির প্রহসন প্রমাণ করেছে, দলীয় সরকারের অধীনে ভোট সুষ্ঠু হতে পারে না। প্রমাণ হয়েছে, কারসাজির এই প্রহসনের নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের মানুষ প্রমাণ করেছে, তারা এই সরকার চায় না। তারা তাদের পছন্দের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করতে চায়। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, এ সরকার ১৫৩ আসনে কোনো নির্বাচনই করতে পারেনি। বাকি আসনগুলোতে জঘন্য কারসাজি ও জালিয়াতি করেছে। এটা গায়ের জোরে এক অবৈধ সরকার। এটাই আমাদের আন্দোলনের এক বিরাট সাফল্য। তিনি বলেন, নির্বাচনের নামে তামাশার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোয় ৫ জানুয়ারি ২২ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। গত পাঁচ বছরে প্রায় ২২ হাজার মানুষকে খুন করা হয়েছে। গুম করা হয়েছে কয়েকশ’ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে।
ভোটের আগে নিজের ‘অবরুদ্ধ’ থাকার প্রসঙ্গে বিএনপি প্রধান বলেন, অতীতে এই আওয়ামী লীগ মওলানা ভাসানীকেও গৃহবন্দী করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। এবার তারা কোনো ঘোষণা ছাড়াই এবং একটু ভিন্ন পন্থায় বিরোধী দলীয় নেতাকে গৃহবন্দী করেছে। আমি দেশবাসীকে আবারও কথা দিচ্ছি, আমরা আওয়ামী লীগের এসব অপকর্ম অনুসরণ করবো না। আগামীতে ক্ষমতায় যেতে পারলে কি কি করা হবে, সে বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা তুলে ধরে বেগম জিয়া বলেন, বিভেদ নয়, আমরা জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলবো। সবার অংশগ্রহণে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের স্থায়ী রূপরেখা প্রণয়ন করা হবে। এছাড়াও পদক্ষেপের মধ্যে থাকবে- সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা কঠোরভাবে দমন করা; মেধা ও যোগ্যতাই হবে মূল্যায়নের মাপকাঠি, বিরোধী দলকে যথাযথ মর্যাদা দেয়া; অখণ্ড জাতিসত্ত্বা গড়ে তোলা; সংঘাতের রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে সুস্থ রাজনীতি ফিরিয়ে আনা; সব দেশের সঙ্গে সহযোগিতা ও বন্ধুত্ব আরও জোরদার করা; বিচার বিভাগ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা; সুশাসন ও আইনের শাসন নিশ্চিত করা; নারী শিক্ষা, নারী অধিকার ও নারীর ক্ষমতায়নকে প্রসারিত করা; গ্রামীণ ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত রাখা এবং নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে যথাযথ মর্যাদা দেয়া। পাশাপাশি বিদ্যুত্, জ্বালানিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা নির্বাচনী ইশতেহারে বিশদভাবে তুলে ধরা হবে বলেও জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনের আগে ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচনের ভোটচিত্র নিয়ে নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র সাংবাদিকদের দেখানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে ১৮ দলীয় জোট নেতাদের মধ্যে- এলডিপি সভাপতি ড. কর্নেল অলি আহমদ (অব.), বিজেপি চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থ, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, ন্যাপ সভাপতি জেবেল রহমান গনি, এনডিপি চেয়ারম্যান গোলাম মোর্তুজা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বিএনপি নেতাদের মধ্যে ছিলেন বেগম সারোয়ারি রহমান, লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, ড. আব্দুল মঈন খান, ড. ওসমান ফারুক, রিয়াজ রহমান, ফজলুর রহমান পটল, জয়নুল আবদিন ফারুক, সাবিহউদ্দিন আহম্মেদ, শওকত মাহমুদ ও শ্যাম্যা ওবায়েদ প্রমুখ।