অনেক ঘটন-অঘটন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, চড়াই-উৎরাই, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আনন্দ-বেদনার সাক্ষী হয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে আরও একটি বছর। বিদায় ২০১৩।
রাত পোহালেই মানুষ মাতবে নতুন বছরের নতুন সূর্য, নতুন স্বপ্নে। এ স্রোতে এগিয়ে যেতে যেতেও পেছন ফিরে বিষণ্ন বেদনায় মানুষ স্মরণ করে চলে যাওয়া দিনগুলোকে।
বিচারপতি খায়রুল হকের একটি সংক্ষিপ্ত আদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এ কথাটি ছিল। তবে ওই আদেশে তিনি বলেছিলেন, সংসদ চাইলে আগামী দুটি জাতীয় সংসদের নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। তবে শেখ হাসিনার সরকার সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে সংবিধান পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে দেয়। এই ইস্যুটি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এখনও চলছে টানাহেঁচড়া।
কাদের মোল্লার মানবতা বিরোধী অপরাধে যাবজ্জীবন কারা দন্ডের রায় আসে ৫ ফেব্রুয়ারি। ঐ দিন সন্ধ্যায় কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবীতে সামাজিক যোগাযোগা মাধ্যমের কিছু মানুষ মিলিত হয় শাহবাগে। কিছু মানুষের সেই আন্দোলন পরবর্তীতে লাখো মানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়।
শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ যখন তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল তখন আন্দোলনকারীদের অনেকের বিরুদ্ধে ধর্ম বিরোধী কর্মকান্ড চালানোর অভিযোগে মতিঝিলে পাল্টা আলোচনায় চলে আসে হেফাজতে ইসলাম। আলোচনা সভা শেষ না করে মতিঝিলে টানা সমাবেশের ঘোষণা দিলে সেখানে শুরু হয় ব্যাপক নাশকতা। সরকারের পক্ষ হতে মতিঝিলকে হেফাজত মুক্ত করার অভিযান চালানো হয়।
বছর জুড়ে জামায়াত ছিল আলোচনার শীর্ষে। এক দিকে দলটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মানবতা বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ও রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করার রায় এবং অন্যদিকে এসব রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া। এসব কিছু বছর জুড়ে জামায়াতকে রেখেছে আলোচনা ও সমালোচনার কেন্দ্রে। তবে বছরের শেষ ভাগে এসে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার বিষয়টি ছিল দেশে ও বিদেশে আলোচনার বিষয় বস্তু।
গণজাগরণ মঞ্চ, হেফাজত ও জামায়ত ইস্যুতে দেশের প্রধান বিরোধী দলটি যখন তাদের তত্ত্বাবধায় সরকার প্রতিষ্টার দাবী খুব একটা আলোচনায় আনতে পারছিল না তখন দলটির জন্য বছরের মাঝামাঝি আসে দারুন সুযোগ। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সিলেটে, রাজশাহী, খুলনা , বরিশাল এবং গাজিপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সব কটিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পরাজিত করে জয় ছিনিয়ে আনে বিএনপি সমর্থীত প্রার্থীরা।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বও ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। পীরগঞ্জে পিতৃভূমিতে জনসভায় যোগ দেয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। ফেসবুকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে নিজের বক্তব্য দিয়ে বছরের শেষ দিকে তিনি বেশ আলোচনায় ছিলেন।
অন্যদিকে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান আগেই রাজনীতিতে যোগ দিলেও নানা মামলায় জড়িয়ে এখন দেশের বাইরে। তার দেশে ফিরে আসা, না আসা আর অর্থ পাচার মামলায় সাজা হওয়া, না হওয়া নিয়ে আলোচনা ছিল সারা বছর। যদিও শেষ পর্যন্ত অর্থ পাচার মামলায় তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াস আল মামুনের সাজা হলেও তারেক বেকসুর খালাস পেয়ে নতুন আলোচনার জন্ম দেন।
বছরের আরও একটি আলোচিত তারিখ ২৬ অক্টোবর। এই দিন প্রধান দুই নেত্রীর মধ্যে সাঁয়ত্রিশ মিনিট ফোনালাপ হয়। তবে নির্বাচন নিয়ে সব দলের অংশ গ্রহণের ব্যাপারে আলোচনার এই ৩৭ মিনিটের কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি।
বছরের শেষ দুটি মাসে টানা হরতাল অবরোধ কর্মসূচি আলোচিত সমালোচিত হয়ে উঠার পেছনে ছিল একের পর এক নাশকতার ঘটনা এবং বিএপি কেন্দ্রীয় পর্যায় নেতাদের গ্রেফতার করার বিষয়টি। বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলন বছরের শেষ ভাগে এমন পর্যায়ে আসে যে তফসিল ঘোষনার পর ২৯ দিনের মধ্যে ২২ দিনই ছিল অবরোধ কর্মসূচি।
নির্দিষ্ট সময় হিসেবে যদি ধরা হয় ২৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষনার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়কে বলা যায় বছরের সবচেয়ে আলোচিত সময়। তফসিল ঘোষনার এক সপ্তাহ আগেই জাতীয় পার্টি এবং মহাজোটকে নিয়ে গঠন করা হয় নির্বাচন কালীন সর্বদলীয় সরকার। যদিও সেখানে ছিল না বিএনপি। তফছিল ঘোষনার পরবর্তী সময় দেখা যায় নির্বাচনের আগেই বিনা প্রতিদন্দিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন ৩০০ জনের মধ্যে ১৫৪ জন সংসদ নির্বাচিত হয়ে যাওয়া।
তফসিলের পরবর্তী আলোচিত বিষয় ছিল জাতীয় পার্টির এইচ এম এরশাদের নির্বাচনে অংশ গ্রহন নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মন্তব্য। এরশাদকে আটক করে হাসপাতালে রাখা এবং পরবর্তীতে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে একাংশের নির্বাচনে অংশগ্রহন।
নির্বাচন নিয়ে দেশের সংকটময় অবস্থা উত্তরনে জাতি সংঘের সহকারি মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর বাংলাদেশ সফর। তার সফরের আলোচিত দিক ছিল প্রধান দুই দলকে ৩ দফায় সংলাপে বসাতে পারা। যদিও তিনি চলে যাওয়ার সংলাপের ফলাফল ছিল শূণ্য।
দুই দলের সংলাপ যখন ব্যর্থ তখন বছরের শেষ ভাগে এসে দুই দলের নেত্রীদের সমঝোতা নিয়ে বক্তব্য ছিল বছরের সর্বশেষ আলেচিত বিষয়।
রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার বিশ্বজিৎ দাসের বিচার সম্পন্ন হয় চলতি বছর। এ মামলার আসামির তালিকায় সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর নাম থাকলেও সবারই সাজা হয়েছে। কারও মৃত্যুদ-, কারও যাবজ্জীবন। বিচারে প্রভাব বিস্তার না করায় সরকার বিশ্বজিৎ ইস্যুতে শেষ পর্যন্ত প্রশংসিতই হয়।
একইভাবে, নির্বাচন ইস্যু নিয়ে ভারত ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কও ছিল আলোচনার শীর্ষে। বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত কার্যত দৃশ্যমান বিবাদে জড়িয়ে পড়ে ২০১৩ সালে, যার রেশ হয়তো ২০১৪ সালেও দেখতে হবে দেশের জনগণকে।
রাজনৈতিক ঘটনার প্রবাহ এখন এমন পর্যায়ে যে ২০১৩ সাল না যাওয়া পর্যাপ্ত বলা যাচ্ছে না আরও কিছু আলোচিত ঘটনা আছে কিনা। তবে বাংলাদেশের মানুষের আপাতত একটাই অপেক্ষা তা হল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদকে ঘিরে দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যায়।