বিশেষ প্রতিনিধি ॥ দেশের যেসব কথিত ‘বিশিষ্ট নাগরিক’ সরকারকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁদের কঠোর সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এক-এগারোর কুশীলবরা আবার সক্রিয় ও সোচ্চার হয়েছেন। এদের ব্যাপারে সবার সজাগ থাকতে হবে। এক-এগারোর কুশীলবরা এখন অনেক কথা বলছেন! কিন্তু শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার সময় যখন হরতাল দেয়া হয়েছে, তখন কেন তাঁদের চেতনা জাগ্রত হয়নি?
৫ জানুয়ারি নির্বাচন স্থগিতের পরামর্শ দেয়া কথিত ‘বিশিষ্টজনরা’ দেশে ‘অসাংবিধানিক পন্থা’ চাইছেন কি না সে প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচন একটা পর্যায়ে চলে এসেছে। এখন নির্বাচন বন্ধ করতে হলে অসাংবিধানিক পন্থায় যেতে হবে। বিশিষ্টজনরা কী সেই পন্থায় চান? অবশ্য অসাংবিধানিক পন্থা থাকলেই ‘বিশিষ্টজনদের কদর বাড়ে।’ তাঁদের অবশিষ্ট কাজটুকু হয়ে যায়, গাড়িতে পতাকা লাগাতে পারে।
রবিবার সকালে গণভবনে জেএসসি ও জেডিসির পরীক্ষার ফল গ্রহণকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রসঙ্গত, গত শনিবার এক গোলটেবিল বৈঠকে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের একটি অংশ সঙ্কট এড়িয়ে রাজনৈতিক সমঝোতার পথ প্রশস্ত করতে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিতের পরামর্শ দেন। ‘সঙ্কটে বাংলাদেশ, নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক এ বৈঠকে চার ঘণ্টা ধরে আলোচনা করেন ৫৪ জন। এর আয়োজনে ছিল চার সংগঠন সিপিডি, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, সুজন ও টিআইবি।
এসব বুদ্ধিজীবীর পরামর্শ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, কিছু বিশিষ্টজন হঠাৎ করেই বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। এদের মধ্যে অনেককে আগেও দেখা গিয়েছিল এক-এগারোর সময়ও এরা সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। নাগরিক সমাজের এই প্রতিনিধিদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর জিজ্ঞাসা, ওনাদের এ চেতনা এত দেরিতে কেন এলো? যখন হরতাল-অবরোধে পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেল, বাসে আগুন দিয়ে জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মারল, তখন ওনাদের এ চেতনা কোথায় ছিল? হেফাজত যখন তা-ব করল, আমার আহ্বানের পরও বিরোধীদলীয় নেতা সংলাপে সাড়া দিলেন না, তখন কেন বিশিষ্টজনদের চেতনা জাগ্রত হলো না?
দেশে ‘অন্য কিছু হলে’ এ বিশিষ্টজনদের ডাক পড়ে ও কদর বাড়তে পারে এ আশাতেই তাঁরা বসে থাকেন মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, আন্দোলনের নামে যখন মানুষ খুন করছে, সন্ত্রাস করছে, গাছ কেটে ফেলছে তখন পরিবেশবাদীদের কেউ তো একটি বিবৃতি দিলেন না? সুশীল সমাজও এ নিয়ে একটা কথাও বলল না? তিনি বলেন, যারা অপরাধ করে তারাও অপরাধী। আর যারা অপরাধ ঠেকাতে যায় তারাও অপরাধী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে যখন গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব থাকে না এবং অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হয়, তখন এসব বিশিষ্ট নাগরিকরা সক্রিয় হন। ওই সময় এসব বিশিষ্ট ব্যক্তির কদর বাড়ে, এটাই তাঁদের বিবেচনা। আমি অন্য কিছু দেখছি না। তিনি বলেন, বিশিষ্ট নাগরিকরা এখন ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে সরকারকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু হেফাজতে ইসলাম যখন তা-ব চালিয়েছিল, পবিত্র কোরান শরীফের শত শত কপি পুড়িয়ে দিয়েছিল তখন তারা কেন নীরব ছিলেন? যখন আমরা সংলাপের প্রস্তাব বিরোধী দলের নেতা (খালেদা জিয়া) প্রত্যাখ্যান করলেন, তখন এসব বিশিষ্ট নাগরিকরা কিছুই বলেননি। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, তখন কেন তাঁদের চেতনা জাগ্রত হয়নি?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার দেশে সব ক্ষেত্রে অভূর্তপূর্ব উন্নয়ন অর্জন করেছে। জনগণের কাছে আমরা দায়বদ্ধ। কেননা আমরা তাদের জন্য রাজনীতি করি। দেশের মানুষ বিশেষ করে ২০০৭-০৮ সালে ‘বিশিষ্ট নাগরিকদের’ সরকারের শাসন দেখেছে। তাঁরা দেশ ও জনগণের জন্য কিছুই করেনি।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সকাল ১০টায় গণবভনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে জেএসসি ও জেডিসির ফলের অনুলিপি তুলে দেন। এ সময় শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে ৯টি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষা সচিব আবদুল নাসের চৌধুরী অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদসহ অন্যান্য কর্মকর্তা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
সারাদেশে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের এই সমাপনী পরীক্ষায় এবার পাস করেছে ৮৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ ছাত্রছাত্রী। গত বছর জেএসসি-জেডিসিতে পাসের হার ছিল ৮৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এ হিসাবে এবার পাসের হার বেড়েছে তিন শতাংশ পয়েন্টের মতো। প্রধানমন্ত্রী পাসের হার বৃদ্ধিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
বিরোধী দলের লাগাতার কর্মসূচীর পরেও ঘোষিত সময়ের মধ্যে জেএসসি-জেডিসির ফল প্রকাশ করার শিক্ষক-কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে পরীক্ষা নেয়ার পরিবেশ ছিল না উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, পরীক্ষার সময় হরতাল-অবরোধ দেয়ায় বাচ্চাদের মানসিক প্রস্তুতি নষ্ট হয়ে যায়, তারা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। আর অনিশ্চয়তার মধ্যে পরীক্ষা দেয়া কঠিন হয়ে যায়।
শিক্ষক-কর্মকর্তাদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে ফল দিয়ে আপনারা সবাই অসাধ্য সাধন করেছেন। আপনারা সবাই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগেই শিক্ষামন্ত্রী তাঁকে জানান, শিক্ষক-কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা দিনরাত পরিশ্রম করায় পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৩৫ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। হরতাল-অবরোধের মধ্যেও পরীক্ষা দিয়ে ফল ভাল হওয়ার সন্তোষ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশে শিক্ষায় সংখ্যার দিক দিয়ে মেয়েদের এগিয়ে থাকার প্রসঙ্গ তুলে হাসতে হাসতে শেখ হাসিনা বলেন, এখন জাতিসংঘকে বলতে হবে বাংলাদেশে শিক্ষায় ছেলেদের সংখ্যা বাড়িয়ে সমতা আনতে হবে। তিনি বলেন, যাতে করে সব ছাত্র উচ্চশিক্ষায় সমান সুযোগ পায় সে লক্ষ্যে তাঁর সরকার জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা প্রবর্তন করেছে। জেএসসি ও জেএসডি পরীক্ষা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে ছাত্রছাত্রীদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ছাড়া শিক্ষকরাও ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপারে আগের চেয়ে বেশি যতœ নিচ্ছেন। তিনি বলেন, শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি তাদের ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারে না এবং দেশকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করতে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই।