গতকাল শনিবার ‘সংকটে বাংলাদেশ: নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ীরা এই আহ্বান জানান। বক্তারা এ সময় বলেছেন, ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত জাতীয় সংসদের মেয়াদ এখনো রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে দুই প্রধান দল নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনা করে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে। জাতীয় সংসদ ভেঙে দিলে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নির্ধারণের জন্য আরও তিন মাস সময় পাওয়া যাবে। এর মধ্যেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এই সুযোগ সংবিধানের মধ্যেই রয়েছে।
আগামী ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন পিছিয়ে দিতে হবে। এর আগে সংবিধানের বিভিন্ন ধারার সুযোগ নিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে অবরোধ, সহিংসতা ও নাশকতা বন্ধ, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ‘প্যাকেজ ডিল’ বা গুচ্ছ সমঝোতা হতে হবে।বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ও আইন ও সালিশ কেন্দ্র যৌথভাবে এই আলোচনার আয়োজন করে। গুলশানের লেকশোর হোটেলে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। এতে আসন্ন নির্বাচন, চলমান রাজনৈতিক সংকট, হরতাল-অবরোধে অর্থনৈতিক ক্ষতি, সহিংসতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।
আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের কোনো নেতা উপস্থিত হননি। তবে বর্তমান মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন অংশ নিলেও তিনি মন্ত্রী হিসেবে নন, রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে এসেছেন।
নির্বাচন ও সমঝোতা: অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে চলমান সমস্যার কোনো গঠনমূলক সমাধান হবে না। সংবিধানের আওতায় এই সমস্যা সমাধানের সুযোগ রয়েছে। আগামী ২৪ জানুয়ারির মধ্যে জাতীয় সংসদে আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান করা যেতে পারে। এ জন্য প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে ঐকমত্যে আসতে হবে। তিনি বলেন, সরকারের সমঝোতা করার এখনই সময়। কেননা, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর তাদের আর বর্তমানের মতো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেন(সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা), আলোচনায় বেশির ভাগ বক্তাই নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। এই সংকট উত্তরণে দুই বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে গুচ্ছ সমঝোতা করতে হবে। আবার সমঝোতা হলেও ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন না হলে কী হবে—সেটাও চিন্তার বিষয়। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতারা ব্যর্থ হলে ধর্মীয় জঙ্গি নেতৃত্ব রাজনীতির মাঠে সামনে চলে আসবে। তাহলে একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য অন্য পথে চলবে বাংলাদেশ। আমরা কি এটা চাই?’
আরেক সাবেক উপদেষ্টা ও মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি রোকেয়া আফজাল রহমান বলেন, ‘৫ জানুয়ারি নির্বাচন হলে এর আগে-পরে কোনো শান্তি আসবে না। ব্যবসা-বাণিজ্য শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমরা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই, গ্রহণযোগ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাই।’
আসন্ন নির্বাচন স্থগিত করার পক্ষে মত দিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আগামী ১ জানুয়ারি সংসদ ভবনের সামনে সমাবেশ আয়োজনের প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, যে ভোটাধিকার নব্বইয়ের আন্দোলনের বড় ফসল, তা আজ উঠে যাচ্ছে। অর্থনীতি পিছু হটতে শুরু করেছে।
প্রবীণ আইনজীবী রফিক-উল হক বলেন, ‘বাইরের লোক ডেকে এনে নয়, দুই নেত্রীকেই সংকট নিরসনে আলোচনায় বসতে হবে। দুই নেত্রীকে বলব, দেশের স্বার্থে সমঝোতায় আসুন। সংবিধানের আলোকেই নির্বাচন পেছানো যাবে। সময় আরও ৯০ দিন বাড়ানো যাবে। গণতন্ত্রকে গণতন্ত্রের মতো চলতে দিন।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মইনুল হোসেন বলেন, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বহাল থাকলে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন কখনোই হবে না। পঞ্চদশ সংশোধনী গণতন্ত্রের জন্য চরম আঘাত।
ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেন, এই নির্বাচন সংবিধানের মূল চেতনায় হচ্ছে না। সংবিধানে যে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে, সেই আলোকে আসন্ন নির্বাচন বন্ধে আদালতের মতামত নেওয়া যায় কি না, তা দেখতে হবে। তিনি মত দেন, আসন্ন নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ একটি কলঙ্কময় দল হিসেবে চিহ্নিত হবে।
মাহ্ফুজ আনামের মতে, নবম জাতীয় সংসদ পুনরুজ্জীবিত করে দুই প্রধান দল আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে। এই বিষয়ে রাষ্ট্রপতির শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হলে আরও প্রাণহানি হবে। একটা প্রাণ বাঁচানোও সবার দায়িত্ব।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, প্রহসনের নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া উচিত। মানুষের জন্য এই সংবিধান। এটা কোনো ধর্মীয় গ্রন্থ নয় যে পরিবর্তন করা যাবে না। মানুষের জন্য না হয় আরেকটা সংশোধনী আনা হোক। তাঁর মতে, বর্তমান ক্ষমতাসীনদের আচরণ নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রের মতো।
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারের সংজ্ঞা পরিষ্কার করতে হবে।
সহিংসতার রাজনীতি: প্রবীণ শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান বলেন, জনগণকে সম্পৃক্ত করে আন্দোলনে না গিয়ে বিরোধী দলের দেওয়া কর্মসূচিতে জনজীবন বিপর্যস্ত হলো, খেটে খাওয়া মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলো। অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে। তিনি সংকট উত্তরণে নাগরিক সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সাইয়ীদ বলেন, ‘রোম যখন পুড়িতেছিল, নিরো তখন বেহালা বাজাইতেছিল। আমাদের নিরোরা বাঁশি বাজিয়েই চলেছেন।’ তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘সাধারণত “বাপ” ভালো থাকে, আর ছেলেরা দুষ্ট হয়। কিন্তু আমরা ২৩ বছর ধরে এমন অবস্থায় আছি যে, বাপেরা সমস্যা করছে। প্রকৃত গণতন্ত্র দেশে আসেনি, এসেছে স্বৈরতান্ত্রিক গণতন্ত্র। যে দল ক্ষমতায় যায়, সেই দলই সর্বময় স্বৈরতান্ত্রিক শক্তি নিয়ে আসে। সে জন্যই দুর্নীতি ও দলবাজি বাড়ছে।’
রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রার নামে ৫ মের পুনরাবৃত্তি জনগণ ও রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে মেনে নিতে পারি না। গাছ কাটা, রেলের ফিশপ্লেট তুলে ফেলা, অবরোধ—এগুলো গণতন্ত্র কি না, জানি না। আজকের আলোচনার মাধ্যমে আমরা অগণতান্ত্রিক শক্তিকে ডাকছি কি না, তাও জানি না।’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে গুচ্ছ সমঝোতা বিএনপি-জামায়াত মেনে নেবে? আলোচনায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি হালকাভাবে আলোচনা হয়েছে বলে তিনি মত দেন।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনীতির অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে স্বাধীনতার উদ্দেশ্য ধূলিসাৎ হতে চলেছে। লগি-বইঠার উত্তরে দা-কুড়াল, পেট্রলবোমা; ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের উত্তরে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। সহিংসতায় লাভবান হচ্ছে অগণতান্ত্রিক শক্তি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, গণতন্ত্র রক্ষায় যদি দরকার হয় আরেকটা একাত্তর হোক। অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, জাতীয় নিরাপত্তা সংকটে পড়ছে। তিনিও নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষে মত দেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান খান বলেন, গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধকে ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে রক্ষা করা যাবে না।
বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ১৯৭১ সালের পর এমন সংকটে আর কখনো পড়েনি দেশ।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার দ্রুত করা দরকার।
সংকটে ব্যবসা-বাণিজ্য: বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা তপন চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতায় কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে মালিক-শ্রমিক সবাইকে না খেয়ে মরতে হবে। যাদের অর্থনীতিতে কোনো অবদান নেই, তারাই সহিংসতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আনিসুল হক বলেন, গত তিন মাসে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার তৈরি পোশাক উড়োজাহাজে করে গন্তব্যে পাঠাতে হয়েছে। সরকারের রাজস্ব আয় নেমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কয়েক মাস পর বেতন-ভাতা দিতে পারবে না সরকার।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমান সংকট সমাধানে রাজনৈতিক নেতাদের ইচ্ছা কতটা কাজ করবে, সেটাই বড় কথা। তাই নাগরিক সমাজ তাঁদের (রাজনৈতিক নেতারা) ওপর চাপ দিতে পারবে কি না, সেটাও দেখার বিষয়। তাঁর মতে, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন আবার দেশকে একটি নতুন সংঘাতের দিকে নিয়ে যাবে।
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন সিপিডির বিশেষ ফেলো রওনক জাহান, সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, নারীনেত্রী আয়শা খানম, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান, আইনজীবী সালমা আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পিয়াস করিম, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি রিয়াজউদ্দিন আহমেদ, মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, পরিবেশ আইনবিদ সমিতির নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক, বাংলাদেশ এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি কামরান এইচ চৌধুরী, আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনালের আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত, ডেমক্রেসিওয়াচের নির্বাহী পরিচালক তালেয়া রেহমান, জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান প্রমুখ।