প্রধান বিরোধী দল বিএনপিবিহীন নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে শনিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ইশতেহার ঘোষণা করেন। যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকরের পর আগামীতে এ বিচার বানচালের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের প্রতিশ্র“তি দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সেই সঙ্গে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা দূর করে রাষ্ট্র ও সমাজজীবনের সর্বক্ষেত্রে শান্তি, শৃংখলা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছে দলটি। ঘোষিত ইশতেহারে কোরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন না করার অঙ্গীকারও করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের ঘোষিত এ ইশতেহারে আগামী পাঁচ বছরে দেশের প্রতিঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা, একই সময়ে দ্বিতীয় যমুনা ও দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু, ফোর-জি চালু, বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে পেনশন ব্যবস্থা প্রচলনের উদ্যোগ, প্রাথমিক শিক্ষার স্তর পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীত এবং অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা, দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা-দক্ষতা বাড়িয়ে এর কার্যকারিতা বাড়ানো, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার অব্যাহত রাখা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণসহ আইন-শৃংখলা বাহিনীকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখারও প্রতিশ্র“তি রয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে গিয়ে আন্দোলনের নামে হত্যা, সন্ত্রাস, পবিত্র কোরআন শরিফে অগ্নিসংযোগ, শিল্পকারখানায় অগ্নিসংযোগ, রেলওয়ের ফিসপ্লেট উপড়ে ফেলা, সড়ক কাটাসহ রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পদের ধ্বংস, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, উপাসনালয় ধ্বংস, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও বৃক্ষ নিধনের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের বিচার করার অঙ্গীকার করেছেন শেখ হাসিনা। এছাড়া সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পকারখানাসহ অর্থনীতির পুনর্বাসন, ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা এবং নাশকতায় ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনা পুনঃনির্মাণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ারও ঘোষণা দেন তিনি।
‘দুর্নীতি প্রতিরোধ’ অংশে বলা হয়েছে, নিজেদের সম্পদ, আয়-রোজগার সম্পর্কে সর্বস্তরের নাগরিকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে।
নতুন প্রেক্ষিত পরিকল্পনা রূপকল্প-২০৪১ প্রণয়ন করে চূড়ান্ত হয়েছে আওয়ামী লীগের ইশতেহার। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে বিশ্বের প্রথম সারির উন্নত দেশগুলোর সমপর্যায়ে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়ে সুশাসন, গণতন্ত্রায়ন ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রায়নকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এবারের ইশতেহার তৈরি হয়েছে। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিভিন্ন পেশাজীবী ও বিপুল সংখ্যক দলীয় নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে এ ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। এ সময় অনুষ্ঠানে ঢাকাস্থ রাশিয়া ও শ্রীলংকার রাষ্ট্রদূত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আফগানিস্তান, মালদ্বীপ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার দূতাবাসের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্ধারিত সময় ৩টার ১৫ মিনিট পর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করেন। তিনি প্রবেশের পরপরই জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয়। এ সময় পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতিথিদের জন্য নির্ধারিত সামনের সারিতে অবস্থান করেন। ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ শেষ হলে বেলা সাড়ে ৩টায় শেখ হাসিনা মঞ্চে ওঠেন। তার টেবিলের দুই পাশে ছিল জাতীয় ও দলীয় পতাকা। সামনে দুটি প্রজেক্টর দেখা গেছে।
আওয়ামী লীগের ইশতেহার থেকে ‘আমাদের লক্ষ্য ও ঘোষণা’ অংশটি পড়ে শোনান প্রধানমন্ত্রী এবং দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এ অংশ পড়া শেষ হলে ‘দেশবাসীর প্রতি আহ্বান’ অংশটি পড়েন। তিনি দাবি করে বলেন, আমরা আমাদের কথা রেখেছি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আমরা যেসব অঙ্গীকার করেছিলাম তা পালন করেছি। সংকট মোচন করে দেশকে এগিয়ে নেয়ার যে কর্মসূচি দিয়েছিলাম, অত্যন্ত সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে আমরা তা বাস্তবায়ন করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, দেশবাসী সংঘাত নয়, শান্তি চায়। তারা অসাংবিধানিক পথে বা স্বৈরশাসনে ফিরে যেতে চায় না। তারা চায় সহিষ্ণু গণতন্ত্রের আলোকোজ্জ্বল অভিযাত্রা। দেশবাসীর কাছে ভোট চেয়ে তিনি বলেন, আমরা ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে উন্নয়ন, অগ্রগতির যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও পথ রচনা করেছি- সে পথ থেকে কোনো অপশক্তি আমাদের বিচ্যুত করতে পারবে না।
আমাদের বিশ্বাস উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং দেশকে শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে আওয়ামী লীগকে আপনারা আরেকবার দেশ সেবার সুযোগ দেবেন।
প্রধানমন্ত্রী জানান, দেশবাসী সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ খাদ্যে উদ্বৃত্ত হবে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, অপুষ্টির অভিশাপ দূর হবে, দারিদ্র্যের লজ্জা ঘুচে যাবে, নিরক্ষরতা দূর হবে, শিক্ষিত দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে উঠবে, শিল্প-সভ্যতার ভিত্তি রচিত হবে, বেকারত্বের অবসান ও কোটি কোটি তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে, যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে, পরিকল্পিত নগর-জনপদ গড়ে উঠবে, রাজধানী ঢাকা যানজটমুক্ত তিলোত্তমা নগরে পরিণত হবে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ সমৃদ্ধির সোপানে পা রাখবে।
এ ছাড়া রাজনীতি থেকে হিংসা, হানাহানি, সংঘাতের অবসান হবে, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের ধারা থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে আসবে। গড়ে উঠবে একটি সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। শেখ হাসিনা আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু’ ও ‘হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর’ প্রতীক; স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতীক নৌকায় ভোট দিন। আসুন, আমরা বিভেদ ভুলে সম্মিলিতভাবে শান্তি, উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাই। হত্যা, সন্ত্রাস, হানাহানি সংঘাত-রক্তপাতের চির অবসান ঘটাই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলি। দেশ গড়ার এ সংগ্রামে ‘জনগণের জয়-বাংলাদেশের জয় অনিবার্য।’
‘শান্তি গণতন্ত্র উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ শীর্ষক ইশতেহারে ২৬টি দিক আলোকপাত করে সেসব বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। ইশতেহার শুরু করা হয়েছে পটভূমি দিয়ে যার প্রথম লাইনটি হল- ‘আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ।’ এছাড়া গত নবম সংসদ নির্বাচনে দেয়া ইশতেহারের কোন খাতে কি অগ্রগতি হয়েছে সেগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি অসমাপ্ত প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়ন এবং রূপকল্প ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা। সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে শুরু করে ’৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন পর্যন্ত সংক্ষেপে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।
এর পরেই বাংলাদেশের স্বর্ণযুগ শিরোনামে ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সফলতা তুলে ধরা হয়েছে। এরপর ‘সম্ভাবনার অপমৃত্যু-বিএনপি-জামায়াত দুর্বৃত্তকবলিত বাংলাদেশ’ শিরোনামে ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের দুঃশাসনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ অধ্যায়ে ওই সময়ের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিকসহ সব বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা রয়েছে। এরপর রয়েছে ‘বিরাজনীতিকরণের রাজনীতি ও মাইনাস টু’র অপপ্রয়াস’ শিরোনামে আরেকটি অধ্যায়। যেখানে এক-এগারোর সরকারের মাইনাস টু ফর্মুলাসহ তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা রয়েছে।
তারপরেই ‘আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পাঁচ বছর : বদলে যাওয়া দৃশ্যপট’ শিরোনামে সদ্য সাবেক মহাজোট সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও সফলতা তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে রূপকল্প-২০২১ এর পথে বাংলাদেশ কতদূর এগিয়েছে তা বর্ণনা করা হয়েছে। পাশাপাশি ‘বিরোধী দলের অসহযোগিতা, ধ্বংস ও সংঘাতের রাজনীতি’ শিরোনামে আরেকটি অংশে বিরোধী দলের নেতিবাচক ভূমিকা তুলে ধরে তার সমালোচনা করা হয়েছে। বিরোধী দলের অসহযোগিতা, জ্বালাও-পোড়াও-গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ, আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা, পেট্রল বোমার বিভীষিকা তুলে ধরা হয়েছে।
এরপর দল হিসেবে আগামীতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলে ‘শান্তি গণতন্ত্র উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জাতীয় সনদ’ নামে করণীয়-কর্তব্য, অঙ্গীকার ও কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়েছে। ১৭টি বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে আওয়ামী লীগের পরবর্তী পরিকল্পনা ও প্রতিশ্র“তি রয়েছে।