উড়াল পথে যাবে ঢাকার মেট্রোরেল। যাত্রীরা এক প্রকার উড়েই চলে যাবেন উত্তরা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক তথা মতিঝিল। কিম্বা মিরপুরের যাত্রীরা গুলিস্থানের একেবারে কাছে। ঘড়ি ধরে নির্দিষ্ট সময়ে। না কোন জ্যাম, না হর্নের শব্দ। এটি এখন আর কোন স্বপ্ন নয়। গত নভেম্বরে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের মাধ্যমে শুরু হয়ে গেছে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকার বহুল আলোচিত মেট্রোরেল প্রকল্পের কার্যক্রম। নির্মাণকাজ শেষ হবার পর এটি ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিকায়ন ও যানজট নিরসনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িতরা কাজ করে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে কাজ অনেকটা এগিয়েও গেছে। জড়িতরা জানান, আমাদের সঙ্গে এই প্রকল্পে আছে জাপানীরা। তারা নীরবে স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করে যাওয়াটাই পছন্দ করে। প্রচার, প্রচারণা নয়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য তিনটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হবে। এর প্রথমটি, ডিজাইন ও সুপারভিশন পরামর্শক নিয়োগের চুক্তি হয় গত ১৯ নভেম্বর। ডিজাইন ও সুপারভিশন পরামর্শক হিসেবে জাপানের নিপ্পন কোয়াই কোম্পানি লিমিটেডের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ করবে। এর মধ্যে রয়েছে নিপ্পন কোয়াই ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড, দিল্লি মেট্রোরেল করপোরেশন লিমিটেড, ভারতের মট ম্যাকডোনাল্ড লিমিটেড, যুক্তরাজ্যের মট ম্যাকডোনাল্ড প্রাইভেট লিমিটেড ও বাংলাদেশের ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালটেন্টস লিমিটেড। ডিজাইন ও সুপারভিশন পরামর্শক খাতে ব্যয় হবে ৯২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) দেবে ৭৪২ কোটি টাকা। বাকি অর্থের যোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার। চুক্তির মেয়াদ নয় বছর ছয় মাস। এর মধ্যে ২৪ মাসের মধ্যে তারা নকশার কাজ শেষ করবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার ইত্তেফাককে বলেছেন, নকশার কাজ করার জন্য ২৪ মাস রাখা হলেও আমরা আশা করছি তিন থেকে চার মাস আগেই কাজটি শেষ হয়ে যাবে। ড্রয়িং বোর্ডে নকশার শুরুর আগে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য পরামর্শকদের একটি দলের ডিসেম্বরে ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। এই দলটি উত্তরা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত যে সব স্থান দিয়ে উড়াল রেলপথ যাবে সেখানে কোথায় কতটুকু জায়গা দরকার হবে, কোথায় কোথায় স্থাপনা ভাঙ্গার প্রয়োজন হবে ইত্যাদি বিষয় দেখবে। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ায় তাদের আসা বিলম্বিত হচ্ছে। আমরা আশা করছি জানুয়ারিতে তারা আসবেন।
কর্মকর্তা আরো জানান, প্রকল্পের জন্য আরো দুইটি পরামর্শক নিয়োগের কাজ চলছে। এর একটি হলো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো উন্নয়ন পরামর্শক, অন্যটি পুনর্বাসন পরামর্শক। মেট্রোরেল পরিচালনার জন্য আমাদের একেবারেই কোন অভিজ্ঞতা নেই। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো উন্নয়ন পরামর্শক মেট্রোরেল পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল ও সহায়ক স্থাপনা দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে আমাদের পরামর্শ দেবে। আর এই প্রকল্পটি গড়ে তোলার সময় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তাদের পুনর্বাসন বিষয়ে পরামর্শ দেবে পুনর্বাসন পরামর্শক। তিনি উল্লেখ করেন জানুয়ারিতে ডিজাইন ও সুপারভিশন পরামর্শক কাজ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে জমি অধিগ্রহণ। ২০১৫ সালের শেষ দিকে মূল নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে যাবে।
প্রকল্প ব্যয়
২০ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মেট্রো প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২২ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য জাইকার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি হয়ে গেছে। চুক্তি অনুযায়ী ব্যয়ের ৮৫ শতাংশ অর্থাত্ ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকার যোগান দেবে তারা। কয়েক ধাপে এই অর্থ ছাড় করা হবে। বাকি অর্থ বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে দেয়া হবে।
কোন পথে কিভাবে যাবে
মেট্রো রেলপথ উত্তরা থেকে পল্লবী হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত স্থাপন করা হবে। তবে, কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনার (এসটিপি) মেট্রো রুট-৬ অনুযায়ী শুরুতে রুটটি বিজয় সরণি হয়ে মতিঝিল যাওয়ার কথা ছিল। পরে, বিমান বাহিনীর আপত্তির মুখে তা পরিবর্তন করা হয়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এটি সংসদ ভবন সংলগ্ন খামারবাড়ি হয়ে যাবে। স্টেশন থাকবে মোট ১৬টি। এগুলো হলো, উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, আইএমটি, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, তালতলা, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, সোনারগাঁও, জাতীয় জাদুঘর, দোয়েল চত্বর, জাতীয় স্টেডিয়াম, বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) তিন পর্যায়ে মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথম ধাপে ২০১৯ সালের মধ্যে পল্লবী থেকে হোটেল সোনারগাঁও পর্যন্ত চালু করা হবে। ২০২০ সালে শেষ হবে সোনারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত। আর শেষ ধাপে ২০২১ সাল নাগাদ উত্তরা থেকে পল্লবী অংশ চালু হবে। তবে বাস্তবায়নের এই ধারাটি পরিবর্তন করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের মতে, মেট্রো চালু হলে প্রথমেই দরকার হবে ডিপো। সেখানে থাকবে রক্ষণাবেক্ষণ ও ধোঁয়ার সুবিধা। ঢাকার ভেতরে ডিপো করার মতো জায়গা পাওয়া কঠিন। উত্তরায় এ ধরনের জায়গা পাওয়া সম্ভব। সে কারণেই উত্তরা-পল্লবী অংশটুকু প্রথমে করার চিন্তা করা হচ্ছে।
যাত্রার সময় ও টিকিটের দাম
মেট্রো চালু হলে প্রতি ৩৭ মিনিটে একটি ট্রেন উত্তরা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে পৌঁছবে। প্রতি সাড়ে তিন মিনিট পর পর পড়বে একটি স্টেশন। প্রতি ঘন্টায় উভয় দিকে ৬০ থেকে ৭০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন। টিকিটের দাম সর্বনিম্ন ১০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬০ টাকা রাখার চিন্তা করা হয়েছে। পরে এটা পরিবর্তন করা হতে পারে। কর্মকর্তারা জানান, টিকেটের দামের সঙ্গে কিভাবে মেট্রো নির্মিত হলো তার একটি ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে।
মেট্রো পাতালে নিয়ে যাওয়ার সমস্যা অনেক। প্রথমত, পাতালে লাইন করা অনেক ব্যয়বহুল। সেখানে রেল চালু রাখার ব্যয়ও অনেক বেশি। কৃত্রিম আলো, বাতাস ও আদ্রতা নিরোধক ব্যবস্থা রাখতে হয়। যেটা ভূপৃষ্টে বা উড়ালে প্রয়োজন নেই। আবার ঢাকায় ভূপৃষ্টে রেললাইন স্থাপনের মতো জায়গাও নেই। সে কারণেই উত্তরা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত পুরো রেলপথই থাকবে উড়ালে। উড়ালে থাকার কারণে পরিচালনা ব্যয় তুলনামূলকভাবে কম হবে। টিকেটের দামটি সে হিসেবেই চিন্তা করা হচ্ছে। তবে পাতালে রেল নিয়ে যাওয়ার চিন্তা একেবারে বাদ দেয়া হয়নি। পরিকল্পনার দ্বিতীয় পর্যায়ে শাপলা চত্বর থেকে যাত্রাবাড়ির দিক যাওয়ার সময় প্রায় দুই কিলোমিটার পথ পাতালে থাকার কথা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর অনেক বেশি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থাকায় এমন চিন্তা করা হচ্ছে।
ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ডের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং পরিবহন বিশেষজ্ঞ ডক্টর এস এম সালেহউদ্দিন বলেছেন, মেট্রোরেল স্থাপিত হলে রাস্তায় যাত্রী ও পরিবহনের ওপর চাপ কমবে। সাধারণত কোন শহরের জনসংখ্যা এক কোটির ওপরে উঠে গেলে মেট্রো ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থা দিয়ে সেই শহরের যাতায়াত সমস্যা মেটানো যায় না। ঢাকার জনসংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়েছে বেশ আগেই। তিনি নির্মাণ কাজের প্রথম পর্যায়ে উত্তরা-পল্লবী অংশ শেষ করার তাগিদ দিয়ে বলেন, মেট্রো চালু রাখার জন্য এটা খুবই জরুরি বিষয়। এটা করা না হলে বড় ধরনের ভুল হবে।
রুটের একটি অংশ নিয়ে বেশ আপত্তি আছে পরিবেশবিদদের। পরিবেশবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব মনে করেন, মেট্রো বর্তমানে যুক্তি সঙ্গত রুটে নেই। সমীক্ষা পর্বে সম্ভাব্যতা যাচাই করে পুরনো বিমান বন্দরের পাশ দিয়ে এটির যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যাচ্ছে সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে। এতে সংসদ ভবনের সৌন্দর্য ও নিরাপত্তা দুটোই হুমকির মুখে পড়বে।
ঢাকায় সড়ক আছে আট শতাংশ
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, একটি শহরের আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকা উচিত। কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) প্রণয়নের সময় করা সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকায় সড়ক আছে মাত্র সাত থেকে আট শতাংশ। এই সড়কগুলোর বিন্যাসও এমন যে সব রাস্তায় বাস চলাচল সম্ভব নয়। সমীক্ষা অনুযায়ী বাস চলাচল উপযোগী রাস্তা হচ্ছে মোট রাস্তার ৩০ শতাংশেরও কম। ফলে দেশে এখন পর্যন্ত একটি সুষ্ঠু গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। মূলত একটি জনবহুল শহরে বাসের সঙ্গে মেট্রোরেল-ব্যবস্থার কার্যকর সম্মিলনের মাধ্যমেই গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠে। তাই ঢাকায় মেট্রোরেলের প্রয়োজনীয়তা বলে বোঝানোর মতো কোন বিষয় নয়।