সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। চলমান সংকটের সহসা উত্তরণ ঘটবে, এমন আলামত এখনও দেখা যাচ্ছে না। দেশি-বিদেশী সকল মহল একটি অবাঁধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করলেও ঘটনাপ্রবাহে প্রতীয়মান হচ্ছে, সে প্রত্যাশা পূরণের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়াই নির্বাচন কমিশন হুট করে নির্বাচনের তফসিল দিয়ে সম্ভাবনা অনিশ্চিত করে দিয়েছে। সরকার একদলীয় বা একতরফা নির্বাচন করে পুনরায় ক্ষমতায় যেতে চায়, এ সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। সরকারের আজ্ঞাবাহী নির্বাচন কমিশন সরকারের এই মতলব বাস্তবায়নে কতটা বেপরোয়া, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। সরকার ও নির্বাচন কমিশন একজোট হয়ে একতরফা, প্রশ্নবিদ্ধ ও অগ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন-প্রহসন অনুষ্ঠান করতে চায়, তা সকলের কাছেই স্পষ্ট। সরকারি দল ও তার মিত্ররা বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে। সরকারের তরফে লাগাতার বলা হচ্ছে, নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন হবেই, কেউ তা রোধ করতে পারবে না। সমঝোতা হলে নির্বাচনের তফসিল পরিবর্তন করা হবে বলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হলেও সমঝোতার কোনো লক্ষণ নেই। অতএব, তফসিল পরিবর্তনের আপাতত প্রশ্ন উঠছে না। এদিকে বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোট একতরফা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে দেশজুড়ে দ্বিতীয় দফা অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথম দফা অবরোধ চলাকালে দেশজুড়ে ব্যাপক পুলিশি তাণ্ডব ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ২০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, কয়েক শ’ আহত হয়েছে। নির্বিচার ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দ্বিতীয় দফা অবরোধের প্রথম দিনেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ৮ জন নিহত হওয়া ছাড়াও শত শত মানুষ আহত হয়েছে। পুলিশ ও সরকারি দলের ক্যাডাররা একাট্টা হয়ে অবরোধ কর্মসূচি প্রতিহত করতে যে রকম আচরণ করছে তাতে আগামীতে আরও প্রাণহানি, আরও সহিংসতার আশংকা করা হচ্ছে।
এই বাস্তবতার পাশাপাশি বিরোধীদল দমনে সরকার যে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করেছে তাতে সংলাপ-সমঝোতার আশা দূরাশায় পরিণত হয়েছে। হাস্যকর মামলার সূত্রে বিরোধী দলীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, জেলে পাঠানো হচ্ছে, রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশ সেদিন যেভাবে হামলা ও ভাংচুর করেছে, রিজভী আহমদকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে, তাতে পুলিশের অপব্যবহারের নিকৃষ্টতম নজির স্থাপিত হয়েছে। কার্যত দেশকে ‘পুলিশি রাষ্ট্রে’ পরিণত করা হয়েছে। এভাবে পুলিশি শক্তি ব্যবহার করে ক্ষমতা নিরাপদ করা যায় না। বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এই প্রেক্ষাপটে সরকারকে হুঁশিয়ায় করে দিয়ে বলেছেন, স্বৈরশাসকের পথ বেছে নেবেন না। তাহলে পরিণতি স্বৈরশাসকের মতোই হবে। যখন রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সরকারের সংযম, সহিষ্ণুতা এবং গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ প্রত্যাশিত, তখন সরকার বিরোধী দল ও মত দমনে চরমপন্থা অনুসরণ করছে। এর পরিণতি সরকার ও দেশের জন্য মঙ্গলকর হবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। সরকার ও সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করছেন কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। সকল মহল থেকে একবাক্যে বলা হচ্ছে, একটি অবাঁধ, সুষ্ঠুু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও সবদলের অংশগ্রহণভিত্তিক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণভাবে সরকার পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক সংলাপ-সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। অথচ সরকার এ অভিমত বিন্দুমাত্র আমলে নেয়ার প্রয়োজন বোঁধ করছে না। ফলে সংকটের সুরাহা হচ্ছে না।
বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক-পর্যবেক্ষকদের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক সমঝোতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হলেও সরকার এদিকে যেমন কান দিচ্ছে না তেমনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অভিমত ও পরামর্শও গ্রাহ্য করছে না। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন সংস্থা ও দেশের পক্ষ থেকে অবাঁধ, সুষ্ঠুু নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণভিত্তিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দেয়া হয়েছে। এই তাগিদের মাধ্যমে তারা কি বুঝাতে চাইছে, তা না বুঝতে পারার কিছু নেই। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, অন্য সবাই বুঝলেও সরকার বুঝতে চাইছে না। এহেন বাস্তবতায় জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন দ্বিতীয় দফা প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার বরাবরে চিঠি দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া চিঠিতে বান কি মুন উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, সত্যিকার অর্থেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় ফুরিয়ে আসছে। তিনি বাস্তবিক অর্থে বিশ্বাসযোগ্য ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে পরস্পরের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানোর তাগিদ দিয়েছেন। তার এই উদ্বেগ ও তাগিদ কোনো বিবেচনাতেই উপেক্ষাযোগ্য নয়। সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীকেই অংশগ্রহণমূলক, বিশ্বাসযোগ্য ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। একতরফা নির্বাচন নয়, বরং দেশি-বিদেশী সকল মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও কাক্ষ্মিত নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য তিনি কার্যকর উদ্যোগ, পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, সঙ্গতকারণেই আমরা সেটা প্রত্যাশা করি। আর সেটা করতে হবে সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই।