জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে রাখতে সম্ভাব্য সব চেষ্টাই করছে সরকার। শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণায় কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়েছে ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজন নিয়ে। এইচএম এরশাদের অনড় অবস্থান বেকায়দায় ফেলেছে সরকারি দলকে। এ অবস্থায় সরকারের তরফে সম্ভাব্য সব চেষ্টা করা হচ্ছে এরশাদের মত পরিবর্তনের। দলের নেতা ও মন্ত্রীদের সঙ্গে আলাদাভাবে যোগাযোগ করা হচ্ছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। নেতারা কেউ কেউ সরকারের পক্ষেও অবস্থান নিয়েছেন। তবে সব ভণ্ডুল হয়ে যাচ্ছে এরশাদের অনড় ভূমিকার কারণে। গতকাল রাত পর্যন্ত তিনি তার সিদ্ধান্তেই অনড় ছিলেন। সরকারের নানা চেষ্টার কারণে মন্ত্রী ও নেতাদের মধ্যে স্পষ্ট বিভক্তি দেখা দিয়েছে। মন্ত্রী এবং উপদেষ্টারা পদত্যাগে গড়িমসি করছেন। চলছে পর্দার আড়ালে নানা খেলা। দফায় দফায় বৈঠক। এদিকে দলীয় প্রধানের নির্দেশের তিনদিনেও মন্ত্রীরা পদত্যাগ না করায় গুজব ও গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। সবার মুখে মুখে এখন প্রশ্ন একটাই- তারা কি নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রী-উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করবেন! নাকি এই সরকারেই থেকে যাবেন। তবে জাপা মহাসচিব বলেছেন, গতকাল পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময় চেয়েও তারা পাননি। আজ যে কোন সময় আবার তারা সময় চাইবেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জাপাকে নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকারে রাখতে মরিয়া সরকার। সরকারের তরফ থেকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে প্রচণ্ড চাপের পাশপাশি নেতাদের নানা ধরনের টোপ দেয়া হচ্ছে। তবে এসব প্রশ্নে এরশাদ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন; আমিই জাতীয় পার্টির ফাইনাল অথরিটি। তারা পদত্যাগ করলেই কি বা না করলেই কি। আমার শেষ কথা নির্বাচনে যাচ্ছি না। সূত্র জানিয়েছে, এরশাদকে নির্বাচনে আনতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে। নির্বাচন বর্জনের ঘোষণার পরপরই তার বাসার সামনে র্যাব এবং পুলিশের প্রহরা বসানো হয়। এই চাপের কারণেই এরশাদ আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। যদিও পরে তিনি এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এরশাদের বাসার সামনে ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম বাবুলকে গ্রেপ্তার চেষ্টারও উদ্দেশ্য ছিল সেখানে অবস্থান নেয়া নেতাকর্মীদের ভয় দেখানো। যদিও এখন পর্যন্ত জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা সেখানে অবস্থান করছেন। গত দু’দিন থেকে গুজব ছিল এরশাদ-রওশন এরশাদকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতে পারেন। তবে এ গুজব উড়িয়ে দিয়েছেন দলটির চেয়ারম্যান। তিনি বলেছেন, যতদিন বেঁচে আছি ততদিন আমিই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়োগের খবর বিভ্রান্তি তৈরির জন্যই ছড়ানো হয়েছে। এসব গুজব, অপপ্রচার। আমি এখনও সিদ্ধান্তে অনড়, সব দল অংশ না নিলে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে না- এটাই আমার ফাইনাল কথা। গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে নিজ বাসভবনের নিচে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। মন্ত্রীদের পদত্যাগের বিষয়ে তিনি বলেন, তারা পদত্যাগ করবেন। করলেই কি বা না করলেই কি। আমার শেষ কথা নির্বাচনে যাচ্ছি না। এর আগে ভোর ছ’টায় বাসার নিচে অপেক্ষমাণ নেতাকর্মীদের এরশাদ বলেন, মনে হয় ওরা আমাকে জেলে দেবে। তবে আমিও ছাড়বো না। সঙ্গে ৮/১০ জনকে নিয়ে যাবো। তোমরা ভয় করো না। আমার কোন ভয় নেই। আমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যা করেছি মানুষ আমাকে বাহবা দিচ্ছে। পথে রিকশাচালক বললো আপনি সঠিক কাজ করেছেন। আপনি নির্বাচনে দাঁড়ান, মানুষ আপনাকে ভোট দেবে। মসজিদে মুসল্লিরা বলেছেন, স্যার আপনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা সঠিক। আপনি একা নির্বাচন করলে মানুষ আপনাকেই ভোট দেবে। এ সময় নেতাকর্মীরাও বলেন, স্যার আপনার সিদ্ধান্ত সঠিক। আপনার কোন ভয় নেই। আমরা আপনার জন্য জীবন দেবো। প্রয়োজনে গায়ে বোমা বেঁধে এখানে পড়ে থাকবো। আপনার গায়ে কেউ হাত দিতে পারবে না। মানুষ বলে এরশাদকে আবার দরকার। এরশাদ বলেন, দেশে নির্বাচনের পরিবেশ নেই। এই জ্বালাও-পোড়াওয়ের মধ্যে মানুষ ভোট দিতে যাবে না। ওদিকে, নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার জন্য গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময় চেয়েও সময় পায়নি জাতীয় পার্টি। আজ আবার তারা সময় চাইবেন বলে জাপার মহাসচিব এবিএম রহুল আমিন হাওলাদার বিকাল পৌনে ৪টায় এরশাদের প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসভবনের সামনে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগাযোগ করে তাকে পাইনি। ছুটির দিন ছিল। এছাড়া, একজন সম্মানিত বিদেশী অতিথি এসেছেন। তাই তিনি ব্যস্ত আছেন। আজ আবার দেখা করার জন্য সময় চাওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জাতীয় পার্টির সাত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও উপদেষ্টার পদত্যাগপত্র জমা দেয়া হবে। বেগম রওশন এরশাদ, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ পদত্যাগ করবেন কিনা এমন প্রশ্নে জাপা মাহসচিব বলেন, তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা পদত্যাগপত্র দিয়ে দেবেন। এর আগে গুলশানে মহাসচিবের বাসায় যান বাণিজ্যমন্ত্রী ও এরশাদের ছোটভাই জিএম কাদের। বেলা ২টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত তারা সেখানে বৈঠক করেন। ওদিকে, বিকাল পৌনে ৪টা থেকে রাত ৭টা পর্যন্ত এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নু। বৈঠক শেষে মহাসচিব সাংবাদিকদের সঙ্গে কোন কথা বলেননি।
দু’দফা ভাঙনের মুখে এরশাদের জাতীয় পার্টি
সাবেক প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডিয়ামের অন্যতম সদস্য কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টিতে আরেক দফা আনুষ্ঠানিক ভাঙন হচ্ছে। ১৮ই নভেম্বর কাউন্সিলের মাধ্যমে এই ভাঙন হতে যাচ্ছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত না এলে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন বাবলুর নেতৃত্বে আরেক দফা ভাঙনে পড়বে এরশাদের জাতীয় পার্টি।
জাতীয় পার্টি সূত্রে জানা গেছে, বার বার অবস্থান পরিবর্তন এবং সর্বশেষ এরশাদের নির্বাচনে যাওয়ার আকস্মিক ঘোষণা জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের হতবিহ্বল করে তোলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রবল বিরোধী নেতাকর্মীরা এতে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হন। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার দলীয় পূর্ব সিদ্ধান্তে অবিচল থেকে তারা কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বে একতাবদ্ধ হয়েছেন। প্রেসিডিয়ামের ৪৫ জন সদস্যের মধ্যে ১৭ জন কাজী জাফরের সঙ্গে একাত্ম হন। কেন্দ্রীয় কমিটিরও এক তৃতীয়াংশ এই প্রক্রিয়ায় জড়িত। ১৮ই ডিসেম্বর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে কাউন্সিলের মাধ্যমে তারা পৃথক জাতীয় পার্টি গঠন করবেন।
কাজী জাফরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির এই অংশের নেতারা দু’ দফা বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন। খালেদা জিয়া তাদের নৈতিক সমর্থন ও মনোবল দিয়েছেন। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, বেগম খালেদা জিয়া তাদেরকে সুসংহত হয়ে ১৮দলীয় জোটে শরিক হওয়ার জন্য বলেছেন। এরশাদের সঙ্গে তার কোন ফোনালাপ ও দেখা হয়নি বলে সুস্পষ্টভাবে জানান। এইচ এম এরশাদের উপর আস্থাহীনতার কথা প্রকাশ করে সরকার থেকে জাতীয় পার্টির মন্ত্রীদের সরিয়ে আনা এবং দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেন খালেদা জিয়া। সংশয়ও প্রকাশ করেন শেষ পর্যন্ত তিনি এ সিদ্ধান্তে অটল থাকেন কিনা। বলেন, ১৮ দলীয় জোটে আসার আগে এরশাদকে বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। কাজী জাফর আহমদ সম্পর্কে বিরোধীদলীয় নেত্রী বলেন, কাজী জাফর ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী একজন পরীক্ষিত জাতীয়তাবাদী নেতা।
পৃথক অবস্থান নেয়ার পরই কাজী জাফর তার অংশের জাতীয় পার্টিকে নিয়ে ১৮ দলে যোগ দিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে রাজপথের আন্দোলনে শরিক হবেন। এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিতে আবার একীভূত হওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে কাজী জাফর বলেন, অনেক কিছুর পরও এরশাদ সাহেব এখন যে ভূমিকা নিয়েছেন তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে সন্দেহ রয়েছে তিনি এ সিদ্ধান্তে অটল থাকবেন না। সেক্ষেত্রে মিলনের সম্ভাবনা নেই।
এদিকে জাতীয় পার্টির মন্ত্রীদের সরকারে থাকা এবং তফসিল পিছানো সাপেক্ষে নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে এরশাদকে প্রভাবিত করতে ব্যারিস্টার আনিস, জিয়াউদ্দিন বাবলু জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সংসদের অধিবেশন ডেকে এরশাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে সরকারের দিক থেকে হুমকির কথা জানান হয়েছে এরশাদকে। এরশাদ তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলে ব্যারিস্টার আনিস-বাবলু জাতীয় পার্টি নামে পৃথক অবস্থান নেবেন। রওশন এরশাদও তাদের সঙ্গে শামিল হয়ে নেতৃত্বে আসতে পারেন। গতকাল এরশাদ বলেছেন, সবকিছুই তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ঘরে-বাইরে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছেন এরশাদ। ব্যক্তিগত ঝুঁকির চেয়েও বড় করে দেখছেন দলের স্বার্থ। দলটি নিজস্ব অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা নিয়ে সঙ্কটে নিপতিত। একটি অংশ বিএনপিতে এবং অপর অংশটি একটা পর্যায়ে বিএনপির সঙ্গে একীভূত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে তিনি হালকা করে দেখছেন না।