সমঝোতার দাবিতে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী নেতার বাসভবন ঘেরাওয়ের হুমকি দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক-মালিকরা এ ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশ নেবেন। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে শ্রমিকের বেতন, সরকারের কর কিছুই দেয়া যাবে না। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ব্যবসা ও শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে। থেমে যাবে অর্থনীতির চাকা। গতকাল ব্যবসায়ীদের মানববন্ধন থেকে এসব কথা বলা হয়। ব্যবসায়ীরা নেতারা বলেন, আমরা বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমেছি। সংঘাত-সহিংসতার কারণে পোশাক শিল্প ক্রেতা হারাতে বসেছে। গৌরব হারাতে বসেছে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ব্রান্ড। ব্যবসায়ী নেতারা হুমকি দিয়ে বলেছেন, ব্যবসায়ী সমাজ রাস্তায় নেমে আসলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে না। ব্যবসায়ীরা এর আগে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। তাই সমঝোতা না হলে রাস্তায় নামা ছাড়া উপায় থাকবে না।
দুপুর ১২ থেকে ১টা পর্যন্ত বিজিএমইএ ভবনের সামনে মানববন্ধনের আয়োজন কর্মসূচি পালিত হয়। দেশব্যাপী চলমান সহিংস পরিস্থিতির অবসান এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনার স্বাভাবিক পরিবেশের দাবিতে এ মানববন্ধনের আয়োজন করে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমইএ। একই দাবিতে আগামী ১৫ই ডিসেম্বর সারা দেশে সাদা পতাকা মিছিল করারও ঘোষণা দেয়া হয়েছে এ মানববন্ধন থেকে।
এতে বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, আমরা অপারগ হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছি। এটা আমাদের কাজ নয়। দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করা আমাদের কাজ। আমাদের বাধ্য করবেন না এর চেয়ে বেশি কিছু করতে। আপনারা সমঝোতায় আসুন। আমাদের ব্যবসার পরিবেশ দিন। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবসা করতে চাই। তিনি বলেন, শিল্পের ইতিহাসে আমরা এ ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি কখনও হইনি। তিলে তিলে গড়ে তোলা মেইড ইন বাংলাদেশের ক্রেতারা আস্থা হারাতে বসেছে। আমরা পোশাক শিল্পকে বাঁচাতে বদ্ধপরিকর। কারণ এর সঙ্গে দেশের ৬ থেকে ৭ কোটি লোকের জীবন ও জীবিকা জড়িত। আতিকুল ইসলাম বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে আমরা কিভাবে ওভার টাইম ও শ্রমিকের বেতন দেব? কিভাবে আমরা ব্যাংক ঋণ ও তার সুদ পরিশোধ করবো? এভাবে চলতে থাকলে মালিকরা কিছুই দিতে পারবে না বলে জানান তিনি। আর এর দায় দুই নেত্রীকে গ্রহণ করতে হবে বলে সতর্ক করেন ব্যবসায়ী এ নেতা।
শ্রমিকদের নিয়ে রাস্তায় নামার হুমকি দিয়ে তিনি বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে পোশাক খাত বেশি সঙ্কটে পড়েছে। ব্যবসায়ীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আমরা এখন ক্রেতা হারাতে বসেছি। স্ট্যান্ডার্ড কারখানা আগুনে পুড়ে গেছে। আর ব্যবসায়ীরা পুড়ছে রাজনীতির আগুনে। বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, আমরা নিরাপদে পণ্য গন্তব্যে পাঠাতে পারছি না। বন্দরে কন্টেইনারভর্তি মাল পড়ে আছে জাহাজীকরণের অপেক্ষায়। সমস্ত সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়েছে। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ লাখ ৩২ হাজার টন পণ্য বিমানে পাঠাতে হয়েছে, এর ফলে লোকসান হয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা। বিনা ঝামেলায় শিল্প থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য অন্য দেশের মত চ্যাপ্টার-১১ (লিকিউইডেশন) এর অনুরূপ পরিকল্পনা চাই। আমাদের একটি এক্সিট (বের হয়ে যাওয়া) পরিকল্পনা দিন।
বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি ও ইএবি’র সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, রপ্তানি শিল্প প্রায় ধ্বংসের মুখে। আমরা অসুস্থ রাজনীতি চাই না। অসুস্থ রাজনীতি পরিহার করুন। দু’দলে বসে আলোচনা করুন। তা-না হলে ৭ কোটি লোক নিয়ে রাস্তায় নামবো আমরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বলেন, পোশাক শিল্প আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এ শিল্পকে বাঁচানোর জন্য আমাদের গণঐক্য ও সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দীন বলেন, আমরা সরকারের রাজস্ব আয়ের ৭৪ শতাংশ সরকারকে দিয়ে থাকি। আমাদের অধিকার আছে নিরাপত্তা চাওয়ার। আমাদের অবশ্যই নিরাপত্তা দিতে হবে সরকারকে। তাই আপনার সহিংসতা বন্ধ করে সমঝোতা করুন। আমাদের ব্যবসা করতে দিন। আপনারা আমাদের ব্যবসায়ে নিরাপত্তা দিন। তা না হলে আমরা আপনাদের বিদায় জানাব।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল আলম পারভেজ বলেন, তিন-চার দিনের মধ্যে দুই নেত্রী সমঝোতায় না আসলে কারখানার শ্রমিক কর্মচারীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার বাসা ঘেরাও করা হবে বলে হুমকি দেন।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সহসভাপতি হেলাল উদ্দিন রাজনীতিবিদদের উদ্দেশে বলেন, ব্যবসায়ীরা লাল-সবুজের পতাকা বহন করে। আপনাদের প্রতি আল্লাহর দোহাই, মায়ের কসম দিয়ে বলছি সহিংস রাজনীতি বন্ধ করুন। শিল্পকে রক্ষা করুন।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আনিসুল হক দুই প্রধান দলের উদ্দেশে বলেন, অসুস্থ রাজনীতি ছাড়েন, আপনারা আস্তে আস্তে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে চলে যাচ্ছেন। আপনাদের হাতে সময় খুব অল্প আছে। তিনি বলেন, অসুস্থ নীতি থেকে আমাদের মুক্তি দিন। আমরা সাহস করে কিছু বলছি না। আপনারা দুজনেই মা। অনুভব করুন ১৬ কোটি মানুষের কথা। সঙ্কট সমাধানের একমাত্র পথ আলোচনা। আলোচনায় আসুন। সমঝোতায় আসুন।
বিটিএমএ সভাপতি জাহাঙ্গীর আলামীন বলেন, দু’দলের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলছি- অর্থনীতি না থাকলে রাজনীতি অর্থবহ হবে না। আপনারা সমাধানে আসুন।
বিকেএমইএ সভাপতি মো. হাতেম বলেন, অসুস্থ রাজনীতি থেকে মুক্তি দিয়ে শিল্পকে রক্ষা করতে হবে। আমরা আর অসুস্থ রাজনীতি দেখতে চাই না। এর অবসান চাই।
বারবিডা সভাপতি হাবিবুল্লাহ ডন বলেন, জ্বালাও-পোড়াও করতে থাকলে হাজারো ব্যবসায়ী রাস্তায় নেমে আসবে। তখন দুই নেত্রীর পক্ষে পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব হবে না।
শ্রমিক নেতা সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, আপনারা ধ্বংসাত্মক রাজনীতি বন্ধ করুন। শিল্পকারখানা না থাকলে শ্রমিকদের জন্য মজুরি বোর্ডের নির্ধারিত মজুরি মালিকদের পক্ষে দেয়া সম্ভব হবে না।
বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমইএর দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন দেশের সব শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা। এফবিসিসিআই, ডিসিসিআই, আইসিসি, বিএএফএফএ, বিজিসিসিআই, বিজিবিএ, ন্যাশনাল এক্সেসরিজ ও কলম্বিয়া মাল্টিটেক, বিজিইএ, ডিসিএএ, এজিএনআইএস, বারভিডা, বিটিটিএলএমইএ, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি এবং সব শ্রমিক সংগঠন এ কর্মসূচিতে একাত্মতা প্রকাশ করেন। মানববন্ধনে দক্ষিণ অফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার আত্মার মাগফেরাত কামনা করা হয়। এদিকে ১৫ই ডিসেম্বর সকালে সারা দেশে ব্যবসায়ীরা সাদা পতাকা মিছিল করার ঘোষণা দেন এফবিসিসিআই প্রতিনিধি হেলাল উদ্দিন।