এরশাদের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণায় পাল্টে গেছে দেশের সমগ্র দৃশ্যপট। নির্বাচন যে ঘোষিত সিডিউল অনুযায়ী হচ্ছেনা এটা নিশ্চিত। সারা দেশে সহিংসতা এবং রাজনীতির যে সংকট দেখা দিয়েছে তাতে জরুরী অবস্থা জারি করা ছাড়া এই মূহুর্ত্ত্বে অন্য কোন উপায় নেই। এমনকি প্রধানমন্ত্রী যদি এই মুহুর্তে পদত্যাগের ঘোষণাও দেন কিংবা সরকারের পতন ও হয়, সেক্ষেত্রেও চলমান সংকট নিরসন হবেনা। বরং সহিংসতা বাড়বে এবং নতুন নতুন সংকট শুরু হবে।
রাজনীতি এখন আর রাজনীতিবীদদের হাতে নেই। সরকার যত কথাই বলুক না কেনো সারাদেশের প্রশাসনের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রন নেই। জনজীবন এতটাই নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে যে- স্বাধীনতার পর দেশবাসী এরুপ ভয়াবহ অবস্থায় আর পড়েনি। রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের প্রতি এতোটাই আদিম ও হিংস্র হয়ে উঠেছে যে, প্রতিপক্ষের রক্ত পান না করা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছেনা। এতোসব যন্ত্রনার মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য একের পর এক ছলচাতুরী করে যাচ্ছে।
এরশাদ যে শেষ মুহুর্তে এমনটি করবেন একথা অনেকেই বলেছিলো। কিন্তু সরকারী দল অতিরিক্ত কুটনৈতিক সফলতা দেখাতে গিয়ে নিজেদের জালে নিজেরাই আটকা পড়েছে। এখন তারা যতবেশী নড়াচড়া করবে ততবেশী ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বে। রাজনীতির একটি সহজ সরল হিসাব রয়েছে। ঠিক মতো কাজ করলে উত্তম ফলাফল পাওয়া যাবে যেমনটি হয়ে থাকে উন্নত বিশ্বে। কিন্তু এখানে চালাকী করতে গেলেই সহজ অংকটি ক্রমেই জটিল হয়ে যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবাই নেপথ্যে খেলতে ভালবাসে। ১৯৯১ সালের পর থেকে বেচারা এরশাদের সঙ্গে সবাই খেলে আসছে। প্রতিটি লোক তার নিকট থেকে স্বার্থ হাসিল করেছে কিন্তু বিনিময়ে তার কষ্টগুলো অর্থ্যাৎ মামলাগুলো ঝুলিয়ে রেখেছে আজ অবধি। সাম্প্রতিক কালে নির্বাচন থেকে সরে আসার ঘোষনার নেপথ্যে অবশ্যই চমকপ্রদ কিছু ঘটনা রয়েছে। আমার অনুমান- জনাব এরশাদকে যে টাকা পয়সা দেবার প্রলোভন দেয়া হয়েছিলো তা সময়মতো দেয়া হয়নি। না দেবার পেছনেও হয়তো আরো চমকপ্রদ কাহিনী থাকতে পারে। সরকারে যোগ দেয়া জাতীয় পার্টি মন্ত্রীদের কেউ কেউ হয়ত সরকারী দলকে বুঝিয়েছে যে- এরশাদ কে টাকা দিয়ে বিশ্বাস করা যায়না। টাকা পেলেই সে বিদেশে চলে যাবে। এর বাইরে মামলা মোকদ্দমা, সংসদীয় আসন বন্টন, প্রার্থীদের নিরাপত্তা এবং সর্বপরি দলের অভ্যন্তরে প্রচন্ডÍ আওয়ামী বিরোধী একটি গ্রুপের প্রভাবের কারনে এরশাদ ছিলেন সবসময়ই সিদ্ধান্তহীনতায়। ফলে তিনি যেদিন মনোনয়ন বিতরন করেন সেই দিনই বলেন যে- তোমরা সবাই আমার ফাইনাল হুকুমের জন্য অপেক্ষা করবে।
সরকারের যেসব প্রভাবশালী বিদেশী বন্ধু রাষ্ট্র এতোদিন সরকার ও এরশাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করছিলেন তারাও সাম্প্রতিক কালে এরশাদকে নির্বাচন থেকে দুরে সরে যাবার পরামর্শ দিয়ে থাকতে পারেন। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা মহলও এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কালে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করেছে বলে বিভিন্ন কুটনৈতিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। ফলে বাতাস আর আগের মতো দক্ষিন দিক থেকে প্রবাহিত হচ্ছেনা।
সারা দেশে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। লাখ লাখ নেতাকর্মী প্রচন্ড হতাশা আর দুঃখের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। কেউই অশান্তির মধ্যে নির্বাচনে অবতীর্ন হতে চাচ্ছেনা। কিন্তু সভানেত্রীর ভয়ে টু শব্দটি উচ্চারণ করতে পারছেনা। অন্যদিকে সভানেত্রী একক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে করতে নিজের অবস্থান এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে- ওখানে গিয়ে কেউ সত্য কথা স্বাধীনভাবে বলবে এরুপ চিন্তার মানুষ দলে নেই। নেত্রী নিজেও হয়তো ভুলে গেছেন যে- তার সামনে কেউ মুখ উঁচিয়ে কথা বলতে পারেন! ফলে যা হবার তাই হচ্ছে- একজন বাঁশি বাঁজাচ্ছে আর পুরো দল সদল বলে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিচ্ছে নিজেদের নির্ঘাত পতন জানার পরও।
শুরু থেকেই সরকার চেষ্টা করছে একের পর এক চমক দেখানোর জন্য। চমক রাজনীতির কোন উপাদান নয়। সাধারণত জুয়া, ভেলকিবাজি বা যাদু-টোনায় চমক থাকে। মানুষ তখনো চমকিত হয় যখন আকাশ থেকে ঠাডা পড়ে। প্রতিটি চমকের আগে পিছে থাকে মিথ্যা, ধ্বংশ আর নানা রকম প্রলয় আর অশান্তির ইতিবৃত্ত। ফলে নানা চমকের বর্ণাঢ্য ভেলকী বাজিতে সরকার নিজেই আটকা পড়েছে। চমকের অক্টোপাস যেনো গিলে ধরেছে সরকারী দলকে।
কি দরকার ছিলো অতো তাড়াহুড়া করে ১৫ তম সংশোধনীর। কিংবা তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে আরো দুটো নির্বাচন হলে আওয়ামীলীগের কি এমন ক্ষতি হতো? কতো গুলো অযোগ্য মন্ত্রী আর উপদেষ্টাদের দায় কেন পাঁচটি বছর ধরে বহন করা হলো? কতো গুলো জাতীয় কলংকের দায় কেন দলকে বহন করতে হলো। শেয়ার মার্কেট, হলমার্ক, ডেসটিনি বা কুইক রেন্টালের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কয়জন নেতা কর্মী সুবিধা পেয়েছে? এসব নিয়ে কেউ মুখ না খোলার কারণে দেশবাসী মনে করছে সরকারী মদদেই এসব সংগঠিত হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বুঝতে হবে যে, তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কেউই তার চেয়ে কোন অংশে কম খেলোয়ার নন। কাজেই তিনি যে খেলা অতীতে খেলেছেন কিংবা বর্তমানে খেলছেন তার প্রতিটি-উপখ্যানই সময় সুযোগ মত তার সঙ্গে খেলা হবে বা হচ্ছে। জনাব এরশাদকে নিয়ে তিনি যে খেলাটি গতপর্বে বিএনপির সঙ্গে খেলেছিলেন তা প্রায় একই ভাবে এবং একই চালে বিএনপি খেলছে- আমার মনে হয় একটু বেশি সফলতার সঙ্গে খেলছে।
সম্মানীত পাঠকগনের অবশ্যই মনে আছে গত বিএনপি সরকারের শেষ সময়ে জনাব এরশাদকে নিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর নাটক গুলোর কথা। সেই নাটকের অভিনয় করতে গিয়ে এরশাদ-বিদিশার তালাক পর্যন্ত হয়ে যায়। জনাব তারেক রহমান ও বাবরের সঙ্গে কথা দেবার পর প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বিদিশা। কারন সে সব সমসয়ই চাচ্ছিলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্য করতে। অন্যদিকে, রওশন চাচ্ছিলেন বিএনপিকে। তৎকালীন সরকারের চাপে জনাব এরশাদ বিদিশাকে তালাক দিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করতে বাধ্য হন। এরই মধ্যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সফল কূটনৈতিক চালে এরশাদ নিখোঁজ হন। প্রথমে উত্তরার একটি বাসায় আত্নগোপন করে থাকেন এবং তারপর জিয়াউদ্দিন বাবলুর বাসায় আশ্রয় নেন।
এরশাদ সাহেবের ঘনিষ্ট জন বলে পরিচিত গোলাম রেজা এবং গোলাম মসিহ সুধাসদনে সুদীর্ঘ রুদ্ধদার বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সঙ্গে। ফলে আওয়ামী লীগের শেষ জনসভায় এরশাদ উপস্থিত হলে জাতীয় রাজনীতির সকল হিসেব নিকেশ পাল্টে যায় এক মূহুর্তের মধ্যে ।এবারও ঠিক একই খেলা হয়েছে- কিন্তু উল্টো চালে এবং পূর্বের তুলনায় ভয়াবহ ভাবে। এরশাদ যখন আত্ন গোপন যাবার পূর্বে ঘোষণা দিলেন নির্বাচন না করার জন্য তখন তার দুই সহযোগী জিয়াউদ্দিন বাবলু ও আনিসুল ইসলাম মাহমুদ প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হিসেবে গাজীপুরের কোনা বাড়িতে । আর অন্যদিকে রওশন এরশাদ, রুহুল আমীন হাওলাদার, এ্যাডভোকেট সালমা এবং মজিবুল হক চুন্নরা সচিবালয় নিজ নিজ দপ্তরে বসে সরকারের গোপন ফাইল পত্র তদারকী করছে। কি অদ্ভুত আর ভয়াবহ পরিহাস! তারপরও সরকার জোর গলায় বলছে নির্বাচন হবে!
এই মূহুর্তে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা ছাড়া সরকারের কোন বিকল্প নেই। এটি যতো তাড়াতাড়ি হবে ততই সকলের জন্য মঙ্গল । দেরী করলে সরকার বিপদে পড়বে সব চেয়ে বেশি। একক সিদ্ধান্ত আর গুটি কয়েক দালালের মোসাহেবীর কারনে সারা দেশের বঙ্গবন্ধুর লাখ লাখ সৈনিক বিপদ গ্রস্থ হচ্ছে- এই দৃশ্য নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে বরদাশত করতেন না। জরুরী অবস্থা দিয়ে সরকার নিশ্চিন্তে ২৪শে জানুয়ারী পর্যন্ত নির্বিঘ্নে থাকতে পারে। এরপর সংবিধান মতে- পার্লামেন্ট ভেঙ্গে যাবে, মন্ত্রী পরিষদ পদত্যাগ করবে এবং পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচন যদি তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তবর্তীকালীন সরকারের অধীনে হয় তবে আওয়ামীলীগের লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না । কিন্তু জেদাজেদী করলে সবকিছু হারাতে হবে বলেই অনেকের মতো আমি ও আশংকা করছি।