বেক্সিমকোর ৯৬২ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল

ঋণগুলো জনতা ব্যাংকের একই শাখা থেকে হল-মার্কের মতো নিজস্ব কোম্পানির মধ্যে ঋণপত্র বা এলসি খুলে, বিলের স্বীকৃতি দিয়ে অর্থ বের করে নিয়েছিল বেক্সিমকো গ্রুপ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সরেজমিন পরিদর্শনে তা আবিষ্কার হয় বছর খানেক আগে। পরিদর্শক দল নিয়ম অনুযায়ী তা খেলাপি চিহ্নিত করতে বলে।

কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায় ‘বিশেষ আনুকূল্য’ দেখায়। বিষয়টি ছেড়ে দেওয়া হয় ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ওপর। ব্যাংক অশ্রেণীকৃত বা নিয়মিতই রাখে। যদিও অতীতের মতো ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করেনি বেক্সিমকো। খেলাপি হয়ে পড়ে ঋণগুলো। সর্বশেষ গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের আবারও বিশেষ আনুকূল্যে ঋণগুলো পুনঃ তফসিল হয়েছে। এ দফায়ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি ‘ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্ক’-এর ওপর ছেড়ে দিয়েছে।

এতে বেক্সিমকো গ্রুপের পাঁচ কোম্পানির ৩৫৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ও ৬০৭ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধের সময় পুনঃ তফসিল করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৯৬২ কোটি টাকার বিশেষ সুবিধা পেল আলোচিত এই গ্রুপটি।
ব্যাংক সূত্র জানায়, বেক্সিমকো গ্রুপের এ্যাসেস ফ্যাশনসের ৫৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা, ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যাপারেলস্ ইউনিট-১-এর ৫৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা, একই নামের কোম্পানির ইউনিট-২-এর ১৫৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, ক্রিসেন্ট ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইনের ৮৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকার ঋণ সম্প্রতি খেলাপি হয়ে পড়ে। আর বাংলাদেশ এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কোম্পানির ৬০৬ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত থাকলেও এর পরিশোধের মেয়াদ ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয় জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। তবে একক গ্রাহকের ঋণসীমা অনুসারে এই ঋণগুলো বৃহৎ অঙ্কের ঋণ হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তির জন্য পাঠানো হয়।
জানা গেছে, খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিয়ম অনুসারে কোনো ডাউনপেমেন্ট বা এককালীন জমা নেওয়া হয়নি। তবে চেক দেওয়া হয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান গতকাল সোমবার দাবি করেন, নিয়ম অনুসারে ঋণগুলো পুনঃ তফসিল করা হয়েছে। কোনো ধরনের সুদ ছাড় নেওয়া হয়নি। কেন ঋণগুলো সময়মতো পরিশোধ করতে পারলেন না প্রশ্নে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তো অনেক ঝামেলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। তা ছাড়া দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যেও সমস্যা হচ্ছে।’

অন্যদিকে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এস এম আমিনুর রহমান বলেন, কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় এগুলো পুনঃ তফসিল করে তাদের পর্ষদ। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি পাওয়ার পর ঋণগুলো নিয়মিত হয়ে গেছে।

জনতা ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় থেকে বেক্সিমকো গ্রুপের বেক্সটেক্স, বেক্সিমকো সিনথেটিক, ক্রিসেন্ট লিমিটেড, ক্রিসেন্ট এক্সেসরিজ ও বেক্সিমকো লিমিটেড—এই পাঁচ কোম্পানি বিপুল পরিমাণ স্বীকৃত বিল তৈরি করে এসব অর্থ ব্যাংক থেকে বের করে নিয়েছিল। বিপরীত পক্ষে ছিল বেক্সিমকোর চার প্রতিষ্ঠান এ্যাসেস ফ্যাশনস, ক্রিসেন্ট ফ্যাশনস, ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যাপারেলস্ ইউনিট-১ ও ২। মজার ব্যাপার হলো, সবগুলো কোম্পানির আমদানি ও রপ্তানিকারক ব্যাংক একই অর্থাৎ জনতা ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়। হল-মার্ক বিভিন্ন ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখাতে তৈরি বিলের স্বীকৃতি দিয়ে টাকা বের করে নিয়েছিল। আর বেক্সিমকো এসব কোম্পানির মাধ্যমে অর্থ বের করতে জনতা ব্যাংকের একটি শাখাকেই ব্যবহার করেছে।

অর্থ বের করার নমুনা: ক্রয়চুক্তির বিপরীতে বেক্সটেক্সের আবেদনে জনতা ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় একই শাখার অপর গ্রাহক বেক্সিমকো সিনথেটিক্সের অনুকূলে ২০১০ সালের ২৯ আগস্ট এক কোটি ৭২ লাখ ডলারের ১৭টি ব্যাক টু ব্যাক এলসি বা ঋণপত্র খোলে। বেক্সটেক্সের পক্ষে স্থানীয় কার্যালয় ২৯, ৩০ ও ৩১ আগস্ট এই ১৭টি এলসির বিপরীতে তৈরি বিলে স্বীকৃতি দেয়। একই দিনে বেক্সিমকো সিনথেটিক্সের কাছ থেকে সবগুলো বিল ক্রয় করা হয়।

ছয় মাস পর অর্থাৎ ২০১১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২ ও ৩ মার্চ বিলগুলোর মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও বেক্সটেক্স মূল্য পরিশোধ করেনি। কিছুদিন পর বেক্সটেক্স জনতা ব্যাংককে চিঠি দিয়ে বলে, ক্রয়চুক্তির বিপরীতে ১২০ দিনের মধ্যে রপ্তানি ঋণপত্র পাওয়ার কথা থাকলেও তা পাওয়া যায়নি। আর সিনথেটিক্সের আবেদনে বিলের ছয় মাস মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু, এ দফাতেও টাকা পরিশোধ হয়নি, বরং মেয়াদ পূর্তির (২০১১ সালের ২৮ আগস্ট, ২ ও ৩ সেপ্টেম্বর) আগেই আবার ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন আসে এবং তা মঞ্জুর করা হয়। তার পরও মূল্য পরিশোধ করেনি বেক্সটেক্স।

এরও দীর্ঘদিন পর ২০১২ সালের ১৭ জুলাই স্থানীয় কার্যালয় ১৭২ কোটি টাকার ফোর্সড ঋণ সৃষ্টি করে বিলগুলো সমন্বয় করে। বেক্সটেক্স এভাবে কোনো প্রকার রপ্তানি ঋণপত্র না পেয়ে শুধু ক্রয়চুক্তির বিপরীতে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলে তার বিপরীতে একই শাখায় অ্যাকুমুডেটিভ বা স্থানীয় বিল বানিয়ে ১৭২ কোটি টাকা বের করে নেয়। এ ক্ষেত্রে কোনো রীতিনীতি অনুসরণ না করে বার বার বিলের মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে ব্যাংক। ১৭ মাস পার হলে ফোর্সড ঋণ তৈরি করা হয়েছে।

জনতা ব্যাংক সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল সরেজমিনে এসে এসব ঘটনা দেখে ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যাপারেলস্ ইউনিট-১-এর ৩২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, একই নামের ইউনিট-২-এর ৩৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকা এবং বেক্সটেক্সের ১৭২ কোটি মিলে ২৩৯ কোটি টাকার ঋণ ক্ষতিজনক মানে শ্রেণীকরণ করার কথা বলেছিল। আর একই গ্রুপের এ্যাসেস ফ্যাশনস, ক্রিসেন্ট ফ্যাশনস, ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যাপারেলস্ ইউনিট-১ ও ২-এর মেয়াদ উত্তীর্ণ অপরিশোধিত ৬৭১ কোটি টাকার স্থানীয় বিলগুলো সমন্বয়ের নির্দেশনা দিয়েছিল।

 

 

অর্থ বাণিজ্য