নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন এরশাদ স্টাফ রিপোর্টার December 3, 2013 এরশাদ লিখিত বক্তব্যে যা বললেন দেশের ইতিহাসে ভয়াবহ এক সংকটময় মুহূর্তে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে আমার কিছু বক্তব্য উপস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। দেশ-জাতি-গণতন্ত্র এবং আমার দলীয় রাজনীতির স্বার্থে আমি কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছি- সে কথা আরও একবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। দেশকে যখন আমি সমৃদ্ধির শীর্ষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলাম- তখন তথাকথিত ‘গণ আন্দোলনের’ মুখে- শুধু কোন ধরনের রক্তপাত না দেখার জন্য আমি স্বেচ্ছায় সাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তর করে নির্বাচনে আসতে চেয়েছিলাম। শর্ত ছিল আমাকে, আমার দলকে সব দলের মতো সমান সুযোগ দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হবে। কিন্তু আমি ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার মাত্র ৬ দিনের মাথায় অন্যায়ভাবে আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে আমাকে গ্রেপ্তার করা হলো। ঢালাওভাবে আমার দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হলো। বাকি নেতাকর্মীদের আত্মগোপনে চলে যেতে হলো। এই পরিস্থিতির মধ্যেও আমার দলকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে আমি নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার সেদিনের সিদ্ধান্তের ফসল জাতীয় পার্টির আজ অবধি টিকে থাকা। সেদিনও জনগণ আমাদের পাশে ছিল। তার জন্যই বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা ৩৫টি আসন পেয়েছি। আমি জেলে থেকে ৫টি আসনে বিজয়ী হয়ে এবং তা পরপর ২ বার- গণতন্ত্রের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ওই সময় প্রতিটি উপ-নির্বাচনে আমার দল বিজয়ী হয়েছে। জনতার রায় আমার পক্ষে এলেও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার আক্রোশে আমাকে কারাগারেই আটকে রাখা হলো। জেলে আটকে রেখেই আমার বিরুদ্ধে একের পর এক সাজানো মামলা দায়েরের পৈশাচিক উৎসব শুরু করা হলো। প্রাথমিক হিসাব অনুসারে ৪২টির মতো মামলা দায়ের করা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে। যেসব খেলো মামলা দায়ের করা হয়েছিল- তা যদি জনসমক্ষে তুলে ধরা হয় তাহলে যারা সেই মামলা দায়ের করেছিলেন- আজ লজ্জায় তাদের মাথা হেঁট হয়ে যাবে- জনগণ তাদের ধিক্কার দেবে। একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীকে চাকরিতে পুনর্বহালের সুপারিশ করেছি- তার জন্যও মামলা হয়েছে। ইরাকের প্রেসিডেন্টের দেয়া একটি শো-পিচ পিস্তল শো-কেসে রেখেছি তার জন্য অস্ত্র আইনে আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন বিদেশী রাষ্ট্রদূত আমার জন্য আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারপরও ওই মামলায় আমাকে সাজা দেয়া হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে আইন সংশোধন করে অস্ত্র আইনের সর্বোচ্চ সাজা ৩ বছরের স্থলে ১৪ বছর করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল- আমি যাতে জীবদ্দশায় জেল থেকে বের হতে না পারি। আমি দেশের একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং তখন জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার উপর কি অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। ৬টা বছর আমি সেহেরী খেয়ে রোজা রাখতে পারি নাই- ঈদের জামাতে নামাজ পড়তে পারি নাই। এক নাগারে সাড়ে তিনটা বছর কারো সঙ্গে আমাকে কথা বলতে দেয়া হয়নি। অসুস্থ্যতায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চলে গেছি- তবুও কোন উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়নি। জন্ডিসে আমার বিলোরেবিন ২৯ পর্যন্ত উঠেছিল- তারপরও আমার চিকিৎসা হয়নি। বেঁচে আছি অলৌকিকভাবে। আমার বিরুদ্ধে যেসব মামলায় সাজা হয়েছে- তার সবগুলোই ছিল প্রহসনের রায়। যে বিচারক সাজা দিতে পারেন নাই- সেই বিচারককেই মাসুল দিতে হয়েছে। জনতা টাওয়ার মামলায় বিচারপতি তার ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থ করেছেন- তার রায়ের মাধ্যমে। জেনারেল মঞ্জুর হত্যার জন্য আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে- ঘটনার ১৪ বছর পর। কোন মামলায় যখন আমাকে আটকানো যাচ্ছিল না- তখন মঞ্জুর হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। সেই মামলা আজ ১৮ বছর ধরে চলছে। ১৩ জন বিচারক বদল হয়েছে- কিন্তু মামলার গতি-প্রকৃতি বদলানো হয়নি। অর্থাৎ আমাকে ঝুলিয়ে রাখতেই হবে। কোনো সাক্ষী আমার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি- তথাপিও মামলা শেষ হচ্ছে না। আমার দলীয় প্রতীক লাঙ্গল- তাও কেড়ে নেয়ার জন্য মামলা হয়েছিল। সে মামলা এখনো উচ্চ আদালতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কেনো আমি এত মামলা মোকদ্দমা-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে আসছি। যদি বলতাম আমি আর রাজনীতি করবো না- আর কোন নির্বাচনে অংশ নেবো না- আমার দল যে যার মতো ভাগ করে নাও- তাহলে আমাকে কোনো নির্যাতন সইতে হতো না। আমি সাবেক রাষ্ট্রপতির মর্যাদা নিয়ে সুখে জীবন যাপন কাটাতে পারতাম। কিন্তু আমার মন-মানসিকতায় রক্তে-মাংসে-চিন্তায়-চেতনায় মিশে গেছে দেশ-জাতি-গণতন্ত্র আর নিজ দলের প্রতি ভালোবাসা। জীবনকালে সে ভালোবাসা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো না বলেই আমি এতটা ত্যাগ স্বীকার করে যাচ্ছি- আর ভবিষ্যতেও এই পথেই থেকে যাবো। আমি যে দুঃখময় রাজনীতিকে বরণ করেছি- সেটাই আমার পথ ও পাথেয় হয়ে থাকবে। আমি যা কিছু করি যা কিছু বলি তার অলক্ষ্যে থাকে গণতন্ত্রের সুরক্ষা এবং আমার দলের প্রতি ভালোবাসা আর স্বার্থের চিন্তা। বলা হয়- আমি নাকি বারবার কথা বদলাই। এক জায়গায় আমি গো-ধরে থাকি না এটা সত্য। কারণ রাজনীতিতে জেদ অমঙ্গল ডেকে নিয়ে আসে- যা বর্তমান সময়ে চলছে। এখন এক পক্ষ বলছে- কেয়ারটেকার ছাড়া নির্বাচনে যাবো না- আর একপক্ষ বলছে কেয়ারটেকার দেয়াই যাবে না। এই যে কথা না বদলানোর জেদ চলছে- এতে কি দেশের মঙ্গল হচ্ছে? মানুষ কি এখন শান্তিতে আছে? গণতন্ত্র কি নিরাপদ আছে? নির্বাচন কি অনুষ্ঠিত হবার সম্ভাবনা আছে? পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুসারে পদক্ষেপ নেয়া- কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কি অপরাধের কিছু? যারা কথা বদলাতে পারছেন না- তারা দেশকে ধ্বংসের কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন- দেশবাসীকে তা বিবেচনা করতে হবে। সচেতন মানুষ মাত্রেই সকলের প্রত্যাশা শান্তিপূর্ণভবে ক্ষমতার হস্তান্তর। নির্বাচন ছাড়া তার কি কোন বিকল্প পথ আছে? আমি লাশের রাজনীতি সহ্য করতে পারি না বলেই স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আর এখন প্রতিদিন সারি সারি লাশ দেখতে হচ্ছে- আর সে লাশ হচ্ছে ক্ষমতার লোভের বলি। সহ্য করতে পারছি না- প্রতিদিন এই বীভৎস দৃশ্য। কোথায় চলে গেছে আমাদের জাতির সভ্যতার মানদণ্ড। আমরা মানুষ হয়ে- জ্যান্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারছি- একজন গর্ভবতী মা আগুনে পুড়ে কাতরাচ্ছে। অনাগত শিশুটি কোন দেশে জন্ম নেবার জন্য মাতৃগর্ভে অপেক্ষা করছে। ওই শিশুর জন্য কোন দেশ রেখে যাবার জন্য আমি আমার কথায় অনড় থাকবো। তাই আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই- ওই আগুনে পোড়া মায়ের অনাগত সন্তানের জন্য একটি আগ্নেয়গিরি দেশ আমি রাখতে চাইনা। একটি শান্ত সুশীতল- শান্তিময় দেশ গড়ার জন্য সমালোচনার ভাষ্য অনুসারে শুধু সকাল-বিকাল- কেনো প্রতিমুহূর্তেও যদি অবস্থান বদলাতে হয়- আমি তাও করতে পারবো। আমি বলেছিলাম- সব দল নির্বাচনে না গেলে আমি নির্বাচনে যাবো না। সেই সব দলের মধ্যে আমিও তো একজন। আমি ভেবেছিলাম- কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতে হবে। তাই প্রথম এগিয়ে আসার দায়িত্বটা আমিই নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের অর্জন আসবে না। আসতে পারেও না। কারণ গণতন্ত্রে ক্ষমতার রদবদলে একটাই পথ নির্বাচন। আমি সেই পথেই হেঁটেছিলাম। ভেবেছিলাম- আরো দল আমাকে অনুসরণ করবে। দূর্ভাগ্য আমার দুর্ভাগ্য গোটা জাতির কোন প্রত্যাশাই পূরণ হলো না। বলেছিলাম- সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ এবং নিরাপদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে- আমরা নির্বাচনে থেকে যাবো। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে- পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ ক্রমেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তাই এই পরিস্থিতিতে আমাকেও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হলো। এখন দেশের অনিশ্চিত গন্তব্য কোথায় গিয়ে থামবে- তা শুধু সর্ব শক্তিমান আল্লাহরই জানা থাকলো। অন্যান্য জেলা সংবাদ বাংলাদেশ রাজনীতি শীর্ষ খবর