জাতীয় পার্টি ভেঙ্গে যাচ্ছে?

জাতীয় পার্টি ভেঙ্গে যাচ্ছে?

kajiজাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর আহমদ বলেছেন,  “শেখ হাসিনার অধীনে তথাকথিত নির্বাচনকালীন ‘সর্বদলীয়’ সরকারে অংশগ্রহণ করেছেন হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ। এ ঘটনায় শুধু আমি নই, সমগ্র জাতি হতভম্ব ও স্তম্ভিত”।

শনিবার সন্ধ্যায় পাঠানো এক বিবৃতিতে হাসপাতালে থাকা কাজী জাফর এমন প্রতিক্রিয়া জানান। বিবৃতিতে জাপা ভাঙ্গার সুষ্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন।

কাজী জাফর জাতীয় পার্টির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, ”আপনারা জাতীয় পার্টির মধ্যে থাকা সরকারের অনুগত নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী অবস্থান গ্রহণ করুন।”

তিনি সুস্থ হওয়ার পর পার্টির অধিকাংশ প্রেসিডিয়াম সদস্য, এমপি, ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম-মহাসচিব ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে সাংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তী কার্যক্রমের দিক নির্দেশনা দেবেন বলে জানিয়েছেন।

পাঠানো বিবৃতিতে কাজী জাফর বিভিন্ন সময় সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের বক্তব্যগুলো তুলে ধরেন।

কাজী জাফরের পাঠানো বিবৃতিটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে দেয়া হলো-

‘জাতীয় জীবনের এক বিশেষ যুগসন্ধিক্ষণে অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আপনাদের সম্মুখে কিছু বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য সাংবাদিক সম্মেলন আহবান করেছিলাম। কিন্তু আমি হাসপাতালে চলন শক্তিহীন অবস্থায় চিকিৎসারত আছি তাই সংবাদ পত্রের বিবৃতির মাধ্যমে আমি আমার বক্তব্য উপস্থাপন করছি। আপনারা লক্ষ্য করেছেন, জাতীয় পার্টির কয়েকজন নেতা আকস্মিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে তথাকথিত নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে অংশগ্রহণ করেছেন। এ ঘটনায় শুধু আমি নই, সমগ্র জাতি হতভম্ব ও স্তম্ভিত। আমি সংক্ষেপে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সংবাদ মাধ্যমে এবং জনগণের সামনে কোন তারিখে কি বলেছিলেন তা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

১৬ নভেম্বর তিনি বলেন, ‘মহাজোটে থেকে নির্বাচন করলে লোকে আমাকে বেঈমান বলবে’।

১৩ নভেম্বর তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে একতরফা নির্বাচন ও সর্বদলীয় সরকারে অংশ নেবেনা জাতীয় পার্টি। এটিই আমার শেষ কথা। আমি তো অনেক আগেই ঘোষণা দিয়েছি সব দল অংশ না করলে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। আর সে নির্বাচনে জাতীয় পার্টিও অংশগ্রহণ করবে না’।

১১ নভেম্বর তিনি বলেন, ‘সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে একতরফা নির্বাচনে জাতীয় পার্টি যাবে না। সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনে গেলে মানুষ আমাকে থুতু দেবে। এর চেয়ে জেলে মরাই ভাল’।

৯ সেপ্টেম্বর তিনি বলেন, ‘দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি আতংকিত, শংকিত ও উদ্বিগ্ন।’

২১ অক্টোবর গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির এক প্রতিনিধি দল। বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ বলেন, জাতীয় পার্টি মহাজোটে থাকবে। আর বিএনপি নির্বাচনে না এলে জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করবে।

সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের জবাবে ২২ অক্টোবর এরশাদ বলেন, ‘সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য মিথ্যা ও ভিত্তিহীন’।

১৯ অক্টোবর তিনি বলেন, ‘শেষ বয়সে কলাবরেটর হতে চাইনা। বিএনপি না গেলে জাতীয় পার্টিও নির্বাচনে যাবে না’।

এছাড়া অতি সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের সাথে আমি বেহেশতে যেতেও রাজী নই’। তার এসব বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছিল এবং আওয়ামী শাসকগোষ্ঠীর ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

জনগণ আশান্বিত হয়েছিল এই ভেবে যে, শেখ হাসিনার সরকার বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে একতরফাভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ষড়যন্ত্র থেকে সরে আসবে এবং নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সকল দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবী মেনে নেবে। কিন্তু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জনগণের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান গ্রহণ করে জাতীয় পার্টির অধিকাংশ নেতৃবৃন্দেকে অবহিত না করে কিছু সুবিধাবাদী ও দোদুল্যমান মন্ত্রীত্বলোভী নেতাকে আওয়ামী লীগের তথাকথিত সর্বদলীয় সরকারের মন্ত্রীত্বে আসীন করেছেন। আমরা মনে করি, দলের সর্বোচ্ছ ফোরাম প্রেসিডিয়ামকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধত্তিতে পাটির গৃহীত পূর্বাপর অবস্থানের বিপরীত এমন একটি সিদ্ধান্ত এরশাদ নিয়েছেন যা জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। আমার দুঃখ রাখার জায়গা নেই যে, চেয়ারম্যান এরশাদ জাতীয় পার্টিকে এক বিশ্বাসঘাতক গণধিকৃত পার্টি হিসেবে জনগণের সামনে উপস্থাপন করেছেন। টেলিভিশনের পর্দায় যখন দেখি, আমাদের পার্টি ও তার নেতার বিরুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ থুথু নিক্ষেপ করছেন এবং ঝাড়– ও জুতা নিয়ে মিছিল করছেন, তখন লজ্জা ও বেদনায় হৃয়দ বিদীর্ন হয়ে যায়। জাতীয় পার্টির লক্ষ লক্ষ নেতা-কর্মী আজ এ ঘটনায় চরমভাবে অপমানিত এবং আশাহত। নিদারুন মনকষ্টে তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

আপনারা লক্ষ্য করেছেন যে, জাতীয় পার্টির যারা তথাকথিত সর্বদলীয় সরকারে অংশগ্রহণ করেছেন নিজ নিজ এলাকার জনগণ তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে এবং তাদেরকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। রাতারাতি ভোল পাল্টে নির্বাচনকালীন সরকারে অংশ নেয়ায় এরশাদকে নিয়ে নানা রকম ব্যঙ্গবিদ্রুপ এবং সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে সমগ্র দেশ জুড়ে। ফেসবুকে এরশাদকে থুথু মারার জন্য আহবান জানানো হচ্ছে। আমি মনে করি শুধু এরশাদের নয়, এটা সমগ্র জাতীয় পার্টির জন্য অত্যন্ত অবমাননাকর।

এখানে আমি গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এরশাদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করতে চাই। আপনাদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে যে, যখন গাজীপুর জেলার জাতীয় পার্টির সকল নেতা-কর্মী প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জেলা কমিটির সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) কাজী মাহামুদুল হাসান ও নুরুল ইসলাম এম,এ, এর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে বিরোধী দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছিলো, তখন আকস্মিকভাবে প্রেসিডিয়ামের সাথে কোনো আলোচনা না করেই এরশাদ একটি বেসরকারী ব্যাংকে বসে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করেন এবং গাজাীপুর জেলার নেতা-কর্মীদের সরকারী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার নির্দেশ দেন। এটা অত্যন্ত লজ্জাজনক যে, পার্টি চেয়ারম্যানের এই নির্দেশ নিবেদিত নেতা-কর্মীরা সম্পূর্ণ অমান্য করে বিরোধী দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন। ভোটাররাও এরশাদের কথায় কান না দিয়ে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে বিরোধী দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করেন।

যে জাতীয় পার্টিকে আমরা অনেক বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে তিল তিল করে গড়ে তুলেছি সেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের এহেন লজ্জাজনক এবং গণবিরোধী কার্যকলাপের বিষয়ে আমরা নিশ্চুপ থাকতে পারি না। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আমরা যদি নিশ্চুপ থাকি তবে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। আমি এই বিবৃতির মাধ্যমে জাতীয় পার্টির তৃণমূল পর্যায়ের সকল নেতাকর্মীদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি- আপনারা জাতীয় পার্টির মধ্যে থাকা সরকারের অনুগত নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী অবস্থান গ্রহণ করুন। পার্টির অধিকাংশ প্রেসিডিয়াম সদস্য, এমপি, ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম-মহাসচিব ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে আমার সুস্থ্যতার পরবর্তীতে সাংবাদিক সম্মেলন করে পরবর্তী কার্যক্রমের দিক নির্দেশনা দেয়া হবে।

আমি এখন দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই। আমি মনে করি, সংবিধানের তথাকথিত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তুলে দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার এই সংকটের সৃষ্টি করেছে। আমি বিশ্বাস করি, নির্বাচনে নিশ্চিত ভরাডুবির আশংকা করে শেখ হাসিনার সরকার নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছে। প্রধান বিরোধী দল যাতে নির্বাচনে আসতে না পারে তার জন্য যতরকম ষড়যন্ত্র এবং অপকৌশল আছে তা তারা চালিয়ে যাচ্ছে। আপনারা আমার সাথে নিশ্চয়ই একমত হবেন যে, বর্তমান সরকারের জনপ্রিয়তা তলানীতে এসে ঠেকেছে। তাই নীল নকশার নির্বাচন করে পার পাবার জন্য প্রধান বিরোধী জোটকে বাইরে রেখে একটা প্রহসনমূলক নির্বাচন করার জন্য তারা আজ মরীয়া। তাদের এই ষড়যন্ত্র সফল করার জন্য জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দেবার লক্ষ্যে তারা নজীরবিহীন দমননীতি শুরু করেছে।

আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই আমি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বর্তমান সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। আমি মনে করি, দেশের বর্তমান রক্তাক্ত সংঘাত ও সংকটের একমাত্র সমাধানের পথ হলো প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ। একমাত্র এর মাধ্যমেই জাতীয় সংলাপ এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের পথ সুগম হতে পারে।

আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই, বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দলকে বাইরে রেখে বর্তমান গণবিরোধী ও ফ্যাসিস্ট সরকারের একতরফা নির্বাচনের ষড়যন্ত্র যে কোনো মূল্যের বিনিময়ে জনগণ প্রতিহত করবে।

আমি সরকারের প্রতি আহবান জানাই, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের গণদাবি অবিলম্বে মেনে নিন এবং দেশকে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করুন।

পরিশেষে আমি জাতীয় পার্টির নেতা কর্মীদের প্রতি অনুরোধ জানাই, আপনারা নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পডুন এবং এ দাবী মানতে সরকারকে বাধ্য করুন।”

বাংলাদেশ রাজনীতি শীর্ষ খবর