জেনেভায় ইরান ও ছয় জাতিগোষ্ঠীর মধ্যকার সংলাপে সম্ভাব্য চুক্তি বানচাল করে দেয়ায় ফ্রান্সের তীব্র সমালোচনা শুরু করেছে ইরানি গণমাধ্যম। সংলাপ নিষ্ফল করে দেয়ার জন্য ফ্রান্সকেই দোষারোপ করছে এসব মিডিয়া। কোনো কোনো গণমাধ্যম মন্তব্য করেছে, এ সংলাপে ফ্রান্স ধ্বংসাত্মক ভূমিকায় নেমেছিল.
ইরানের গণমাধ্যমগুলো বলছে- সংলাপে সম্ভাব্য চুক্তি না হওয়ার পেছনে মূল দায়ী ব্যক্তি হলেন ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরা ফ্যাবিয়াস। ইরানের দৈনিক আফতাব ইয়ায্দ পত্রিকা রোববার প্রধান শিরোনাম করেছে-“প্যারিস আটকে দিল জেনেভা চুক্তি।”
সংলাপে ফ্রান্সের নেতিবাচক ভূমিকার কথা উল্লেখ করে হাফতে সোব নামে ইরানের আরেকটি দৈনিক শিরোনাম করেছে- “শেষ নৈশভোজে ফ্রান্সের ষড়যন্ত্র।”
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরা ফ্যাবিয়াসের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় তুলেছেন ইরানিরা। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তারা নানা ধরনের পোস্ট দিয়েছেন ফেইসবুক পেইজে।
ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফেইসবুক পেইজে এক ইরানি নাগরিক বলেছেন, “ তোমার জন্য ঘৃণা ফ্যাবিয়াস; আমরা আমাদের দেশকে ভালোবাসি।”
ইরানের সংসদ সদস্যরাও ফরাসি মন্ত্রীর সমালোচনা করেছেন। ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক সংসদীয় কমিটির মুখপাত্র হোসেইন নাকাভি হোসেইনি বলেছেন, “ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইরানকে প্রতারণা করতে চাইছে।”
গত শনিবার জেনেভায় তৃতীয় দিনের আলোচনার শুরুতেই ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরা ফ্যাবিয়াস বলেছিলেন, তার দেশ প্রস্তাবের প্রাথমিক খসড়া মেনে নেবে না কারণ এতে বেশ কিছু বিষয়ের উল্লেখ নেই। তিনি সেদিন এও বলেছিলেন যে, ইরানের পরমাণু ইস্যুতে ইসরাইলের উদ্বেগের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।
শনিবার দিন শেষে ইসরাইলের গোয়েন্দামন্ত্রী ইউভাল স্তেইনিত্জ ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, “এটা উৎসাহব্যঞ্জক যে, জেনেভা সংলাপে ইসরাইলের উদ্বেগের বিষয়টি তুলে ধরার জন্য আমাদের অন্য এক পার্টনার রয়েছেন।”
ফ্রান্সের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক সংসদীয় কমিটির উপ প্রধান মানসুর হাকিকতপুর বলেছেন, “ফরাসি সরকার সম্পূর্ণভাবে ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। পাশাপাশি এ দেশটি ইরান ও ছয় জাতিগোষ্ঠীর সর্বশেষ আলোচনায় আমেরিকার স্বার্থকেও তাড়া করেছে।”
মানসুর হাকিকতপুর বলেন, এবারের জেনেভা আলোচনায় ফ্রান্সের প্রতিনিধিরা ইসরাইলের হয়ে কথা বলেছেন।
ইরানের এ সংসদ সদস্য বলেন, “ফ্রান্স সরকার পরিপূর্ণভাবে ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় আমরা ফরাসি জাতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।”
ব্যবস্থা নেবেন ইরানের ব্যবসায়ীরা
পরমাণু ইস্যুতে ইহুদিবাদী ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সম্ভাব্য চুক্তি বানচাল করে দেয়ায় ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছেন ইরানের ব্যবসায়ীরা। এর অংশ হিসেবে ইরানের ব্যবসায়ীরা ফ্রান্সের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক কমিয়ে দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছেন। জেনেভায় টানা তিনদিনের বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের ব্যবসায়ীরা এ চিন্তা করছেন। এ বিষয়ে রাজধানী তেহরানে ইরানের ব্যবসায়ীদের একটি দল গত রোববার বৈঠক করেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতির দেশ হিসেবে ইরানের সঙ্গে ব্যবসা ও শিল্প ক্ষেত্রে ফ্রান্সের বড় ধরনের অংশীদারিত্ব রয়েছে। কিন্তু এবারের জেনেভা বৈঠকে ফ্রান্সের ভূমিকার কারণে দেশটিকে বাদ দিয়ে ইরানের ব্যবসায়ীরা বিকল্প কোনো দেশকে খুঁজে নেয়ার কথা বিবেচনা করছেন। তারা বলছেন, ফ্রান্সের এ ভারসাম্যহীন ভূমিকার কারণে এ দেশটিকে ইরানি ব্যবসায়ীরা ভালো অংশীদার হিসেবে আর মেনে নিতে পারছেন না।
কেন ফ্রান্সের এ ভূমিকা?
প্রশ্ন উঠেছে ফ্রান্স কেন এ ভূমিকায় গেল? এর জবাব উঠে এসেছে ইরানের ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের এক সংবাদ বিশ্লেষণে। এতে বলা হয়েছে- সৌদি আরবের তায়েফ সামরিক ঘাঁটিতে গত কয়েকদিন ধরে ফ্রান্সের সঙ্গে সৌদি আরবের সামরিক মহড়া চলছে। এ সম্পর্কে দু’জন সামরিক কমান্ডারের উদ্ধৃতি দিয়ে সৌদি আরবের একটি ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে ‘আল রিক-১’ সামরিক মহড়া থেকে সব বিষয়ে বিশেষ করে সামরিক ক্ষেত্রে সৌদি আরব ও ফ্রান্সের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও সহযোগিতার বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়। মূলত সৌদি আরবের সঙ্গে ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করা এবং মাঝদিয়ে বিপুল অর্থের অস্ত্র বিক্রির লক্ষ্য থেকেই ফ্রান্স জেনেভায় এক ধরনের পুলিশের ভূমিকা পালন করেছে। ইরানের সঙ্গে ছয় জাতিগোষ্ঠীর সাম্প্রতিক বৈঠকে যাতে কোনো সমঝোতা না হয় সে জন্য ফ্রান্সের প্রচেষ্টাকে নিতান্তই ষড়যন্ত্রের আলোকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, জেনেভা বৈঠকে পরমাণু ক্ষেত্রে সমঝোতায় ফ্রান্সের বাধা দেয়ার সঙ্গে রিয়াদ-প্যারিস নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কের একটা ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। কিছুদিন আগে ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জ্য ওয়াইভেস লা দ্রায়া অস্ত্র বিক্রি করার জন্য সৌদি আরব সফরে যান।
ফরাসি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে কোনো কোনো গণমাধ্যম জানিয়েছিল- বিপুল অংকের অস্ত্র বিক্রির বিষয়টি খতিয়ে দেখা ছিল জ্য ওয়াইভেস লা দ্রায়ার দু’দিনের রিয়াদ সফরের প্রধান উদ্দেশ্য। ২০০ কোটি ইউরো মূল্যের সামরিক চুক্তি চূড়ান্ত হলে ফ্রান্স সরকার সৌদি সেনাবাহিনীকে অত্যাধুনিক ‘ক্রুতাল’ ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করবে। ফ্রান্সের তালিস অস্ত্র নির্মাণ কোম্পানি ৯০’র দশকে এ ক্ষেপণাস্ত্র ফরাসি সেনাবাহিনীকে সরবরাহ করে।
এছাড়া, ইরানের তেল ও গ্যাস খাতের ওপর আমেরিকার যেমন নজর রয়েছে তেমনি রয়েছে ফ্রান্সের লোভাতুর দৃষ্টি। এ বিষয়টিও জেনেভা বৈঠক বানচাল করে দেয়ার পেছনে কাজ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বৈঠকে পশ্চিমাদের মতভেদও ছিল সুস্পষ্ট। এ সম্পর্কে বৈঠকে অংশ নেয়া ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফ জানিয়েছেন, “এবারের জেনেভা বৈঠকে ইরমাণু চুক্তির বিষয়ে ছয় জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছিল তা মীমাংসার জন্যই তাদের বেশি সময় ব্যয় হয়েছে।”
কী করবে ইরান?
কোনো চুক্তি ছাড়াই জেনেভা বৈঠক শেষ হয়েছে ঠিকই তবে ইরান তার অবস্থান থেকে সরে আসবে না বলেই মনে হয়। পরমাণু ইস্যুতে ইরান বার বার বলেছে এবং এখনো বলছে- পরমাণু বিস্তাররোধ চুক্তি বা এনপিটি-তে সই করা দেশ হিসেবে ইরান বেসামরিক ও শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরমাণু কর্মসূচি পরিচালনা করতেই পারে। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় তেহরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের যে কৌশল রপ্ত করেছে তা আর ছাড়বে না। এটা ইরানের মৌলিক অধিকার বলেও ঘোষণা করেছে। এর বিপরীতে বরং ইরান বলছে, বিশ্বকে নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে হলে পরমাণু অস্ত্র ধ্বংসের কোনো বিকল্প নেই। মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র পরমাণু অস্ত্রধর ইসরাইলের হাত থেকেও ভয়াবহ ও গণবিধ্বংসী পরমাণু অস্ত্র ধ্বংসের দাবিতে অনড় রয়েছে তেহরান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাওয়াদ জারিফ ইরানের চ্যানেল-২ টেলিভিশনকে দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে বলেছেন-আট বছর আগে আমাদের কাছে ছিল মাত্র ২০০ সেন্ট্রিফিউজ কিন্তু নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর তা এখন ১৯,০০০ হাজারে পৌঁছেছে।” এছাড়া, ইরানের জাতীয় সংসদের স্পিকার প্যানেলের সদস্য মোহাম্মাদ দেহকান বলেছেন, প্রয়োজনে ইরান তার বেসামরিক পরমাণু কর্মসূচি আরো জোরদার করবে। তিনি বলেছেন, প্রশাসনকে এ কাজ করার নির্দেশ দেয়ার কর্তৃত্ব ইরানের জাতীয় সংসদের আছে। এসব বক্তব্য বিবৃতি থেকে এটা পরিষ্কার যে, ইরান তার পরমাণু অধিকার ছাড়বে না। সে কারণে পশ্চিমাদেরকেই চুক্তি বা সমাধানের জন্য কোনো কার্যকরী পথ বের করতে হবে। তবে, আশা করা হচ্ছে আগামী ২০ নভেম্বর জেনেভায় ইরানের সঙ্গে চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন, আমেরিকা ও জার্মানির যে বৈঠক হতে যাচ্ছে সেখানে একটা ফয়সালা হবে; চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।