মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে রায় যেকোনো দিন।
বুধবার বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রথম ট্রাইব্যুনাল আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখার আদেশ দেন।
একই সাথে ট্রাইব্যুনাল আসামিপক্ষকে তাদের আইনি যুক্তি (আর্গুমেন্ট) লিখিত আকারে আগামী ৫ দিনের মধ্যে জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
এদিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ডাকা টানা চার দিনের হরতালের শেষ দিন বুধবারও আসামিপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী কোনো আইনজীবী আদালতে উপস্থিত ছিলেন না। এ নিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা টানা চার দিন ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে অনুপস্থিত থাকেন।
আসামিপক্ষের সহযোগী আইনজীবীরা মামলার কার্যক্রম মুলতবির আরজি জানান। আদালত তা নাকচ করে মামলাটির রায় অপেক্ষাধীন (সিএভি) রাখেন। ট্রাইব্যুনাল বলেন, আসামিপক্ষ লিখিতভাবে তাদের যুক্তি উপস্থাপন করতে পারবে।
২০১২ সালের ২৮ মে মতিউর রহমান নিজামীর বিচার শুরু হয়। ওই দিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ নিজামীর বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অভিযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ গঠন করে আদেশ দেন।
একই দিনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার বিচারও শুরু হয়। ওই মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার যাবজ্জীবন সাজার রায় হয়। কিন্তু গত ১৭ সেপ্টেম্বর একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করার দায়ে কাদের মোল্লাকে মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
নিজামীর মামলায় অভিযোগ গঠনের আদেশের দিন আসামির পরিচিতিতে বলা হয়, ১৯৪৩ সালে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে নিজামী জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬১ সালে ফাজিল ও ১৯৬৩ সালে কামিল পাস করেন। একাত্তরে তিনি জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের (বর্তমানে ছাত্রশিবির) পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি ও আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন। রাজাকার, শান্তি কমিটি, আলবদর প্রভৃতি গঠনে তিনি তত্কালীন জামায়াতের পূর্ব পাকিস্তানের আমির গোলাম আযমকে সহায়তা করেছিলেন।
আদেশে বলা হয়, ২০১০ সালের ২ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় নিজামীকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ গঠনের পক্ষে ও আসামিপক্ষ অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন করে। আদেশের এ পর্যায়ে দুই পক্ষের যুক্তি ও এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত তুলে ধরা হয়। অভিযোগ থেকে অব্যাহতির জন্য আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ করেন ট্রাইব্যুনাল।
এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ পড়ে শোনান। এসব অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও এ ধরনের অপরাধে সহযোগিতা এবং ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ আনা হয়।
নিজামীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ:
নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগসহ ১৬টি অভিযোগ আনা হয়েছে। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ছাড়াও তার বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, নির্যাতন, মানবতাবিরোধী অপরাধে ষড়যন্ত্র ও উসকানি এবং এ ধরনের অপরাধে সহযোগিতা করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড-সম্পর্কিত ১৬ নম্বর অভিযোগ হচ্ছে, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের প্রাক্কালে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে আলবদর বাহিনী। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আলবদর সদস্যরা ওই গণহত্যা ঘটায়। জামায়াতের তত্কালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই গণহত্যার দায় নিজামীর ওপর পড়ে। এ জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ৩(২)(সি) ধারার সঙ্গে ৪(১) ও ৪(২) ধারায় নিজামীর বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল।
নিজামীর বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ হচ্ছে, পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিনকে নির্যাতন করে হত্যা। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার চালাতেন। একাত্তরের ৪ জুন পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে অপহরণ করে নূরপুর পাওয়ার হাউসের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিজামীর উপস্থিতিতে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। ১০ জুন তাঁকে ইছামতী নদীর পাড়ে অন্যান্য ব্যক্তির সঙ্গে হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ১০ মে বেলা ১১টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ওই সভায় নিজামী বলেন, শিগগিরই পাকিস্তানি সেনারা শান্তি রক্ষার জন্য আসবে। ওই সভার পরিকল্পনা অনুসারে পরে বাউশগাড়িসহ দুটি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ করে রাজাকাররা।
পঞ্চম অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ১৬ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে নিজামীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা ঈশ্বরদী উপজেলার আড়পাড়া ও ভূতেরবাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে বাড়িঘর লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় ২১ জন নিরস্ত্র মানুষ মারা যায়।
দশম অভিযোগে বলা হয়, পাবনার সোনাতলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র কুণ্ডু প্রাণ বাঁচাতে ভারতে চলে যান। নিজামীর নির্দেশে রাজাকাররা তার বাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। অষ্টম অভিযোগে বলা হয়, ৩০ আগস্ট নিজামী নাখালপাড়ার পুরোনো এমপি হোস্টেলে গিয়ে সেখানে আটক রুমী, বদি, জালালদের হত্যার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের প্ররোচনা দেন।
নিজামীর বিরুদ্ধে ১১, ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বর অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউটে ইসলামী ছাত্রসংঘ আয়োজিত সভায় নিজামী বলেন, পাকিস্তান আল্লাহর ঘর। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তিনি প্রিয় ভূমির হেফাজত করছেন। দুনিয়ার কোনো শক্তি পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে পারবে না। ২২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক একাডেমি হলে আল মাদানীর স্মরণসভায় নিজামী বলেন, পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে শত্রুরা অস্ত্র হাতে নিয়েছে। তিনি পাকিস্তানের শত্রুদের সমূলে নির্মূল করার আহ্বান জানান। ৮ সেপ্টেম্বর প্রতিরক্ষা দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে ছাত্রসংঘের সভায় নিজামী বলেন, হিন্দুস্তানের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতে রাজাকার, আলবদররা প্রস্তুত। ১০ সেপ্টেম্বর যশোরে রাজাকারদের প্রধান কার্যালয়ে এক সুধী সমাবেশে নিজামী প্রত্যেক রাজাকারকে ইমানদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আল্লাহর পথে কেউ কখনো হত্যা করে, কেউ মারা যায়। এসব বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি ছাত্রসংঘের সদস্য, রাজাকার ও অন্যদের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের উসকানি ও প্ররোচনা দেন। ট্রাইব্যুনালস আইনের ৩(২)(এফ) ধারার সঙ্গে ৪(১) ও ৪(২) ধারায় এসব অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের মে মাসের শুরু থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ছিল। রাজাকার ও আলবদর বাহিনীও সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। নিজামী ওই ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র করতেন।
১৫ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের মে মাস থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাঁথিয়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে রাজাকার ক্যাম্প ছিল। নিজামী প্রায়ই ওই ক্যাম্পে গিয়ে রাজাকার সামাদ মিয়ার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করতেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এসব অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল ৩ (২)(জি) ধারায় নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন