মার্কিন ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির দামে যখন টালমাটাল দশা চলছে, তখন ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক চেষ্টা শুরু করেছে নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের সাথে রুপি’তেই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য শুরু করা যায় কি না, তা দেখার।
যে দেশগুলোকে এই ‘রুপি সোয়াপে’র জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে আছে প্রতিবেশী বাংলাদেশও। কিন্তু ভারতীয় অর্থনীতি জগতের পর্যবেক্ষকরাই বলছেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের দিক থেকে এ ধরনের প্রস্তাবে সাড়া মেলা মুশকিল। তবে এক্ষুণি না হলেও কয়েক বছরের মধ্যেই রুপিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য শুরু হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
আঞ্চলিক বাণিজ্যে যাতে ডলারের ওঠাপড়ার আঁচ না-লাগে, তাই স্থানীয় কোনও মুদ্রায় দুটো দেশের মধ্যে বাণিজ্যের রেওয়াজ চালু আছে বিশ্বের বহু জায়গাতেই। আর অর্থনীতির পরিভাষায় একে বলে কারেন্সি সোয়াপ অ্যারেঞ্জমেন্ট। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, রিজার্ভ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ও রকস্টার অর্থনীতিবিদ বলে পরিচিত রঘুরাম রাজন এই ব্যবস্থার প্রবল সমর্থক। এ মাসের গোঁড়ায় দায়িত্ব নিয়েই রঘুরাম রাজন ঘোষণা করেছিলেন, সময়টা ঠিক উপযুক্ত না হলেও তিনি চান ভারতীয় রুপির আন্তর্জাতিকরণ।
মি. রাজন বলেছিলেন, বিদেশে ভারতীয় বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে লেনদেনটা রুপিতেই হোক, ভারত সেটাই চাইবে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে ধারাবাহিক উদারীকরণই হবে আমাদের নীতি।
রিজার্ভ ব্যাংক সূত্রের খবর, গভর্নরের এই ঘোষণার পরই তারা নতুন সাতটি অর্থনীতিকে চিহ্নিত করেছেন, যাদের সঙ্গে রুপিতে লেনদেন করা সম্ভব বলে ভারত মনে করছে।
বাংলাদেশ ছাড়াও সেই তালিকায় আছে ভিয়েতনাম, রাশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, তুরস্ক ও মেক্সিকোর মতো দেশ। দিল্লিতে আর্থিক বিষয়ের বিশ্লেষক শুভময় ভট্টাচার্য বলছিলেন, এই সবগুলো দেশের সাথেই ভারতের বাণিজ্য ডলারের ওঠাপড়ার শিকার হয়েছে। তিনি বলেন, ভারতীয় রুপির বাজার আন্তর্জাতিকভাবে নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা বা নেপালের সঙ্গেও ভারতের ব্যবসায়ীদের যখন লেনদেন হয়, পুরো অ্যাকাউন্টিংটাই হয় ডলারে! ফলে ডলারের দামে ওঠাপড়া হলে পণ্যের দামও সেভাবে কমে-বাড়ে। এই চাপটা সাঙ্ঘাতিক, কারণ যে কোনও রফতানিকারীকে বাজারে ঢুকতে হলে আগে থেকে ডলারের ব্যবস্থা করে রাখতে হচ্ছে। রুপিতে লেনদেন শুরু হলে এই সমস্যা হয়তো কাটবে, কিন্তু সেই দেশের মুদ্রা যদি ডলারের বিপরীতে শক্তিশালী থাকে তাহলে তাদের রুপিতে ব্যবসা করার আগ্রহ না-থাকাটাই স্বাভাবিক। যেমন, বাংলাদেশের টাকা ডলারের বিপরীতে সম্প্রতি রীতিমতো স্থিতিশীল থেকেছে। তাহলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কি আদৌ রুপিতে লেনদেন করার গরজ থাকবে? ভট্টাচার্য বলছেন, “মোটেই গরজ থাকবে না। বস্তুত বাংলাদেশি টাকা গত কয়েক মাসে ভারতীয় রুপির সাপেক্ষে যে রেজিলিয়েন্স দেখিয়েছে, তা নজিরবিহীন। বাংলাদেশি টাকার দাম বেড়েছে দারুণভাবে, ফলে তারা কেন রুপি সোয়াপে উৎসাহী হবেন? বরং যে দেশগুলোর মুদ্রার সাপেক্ষে ভারতের রুপি মোটামুটি স্থিতিশীল থেকেছে, তাদের সঙ্গেই এই ধরনের প্রস্তাব কার্যকরী হবে বলে তাঁর অভিমত। যেমন, জাপানের সঙ্গে ভারতের ‘রুপি সোয়াপ’ ইতিমধ্যেই সফলভাবে কাজ করছে। তারপরও রিজার্ভ ব্যাংক বাংলাদেশকে এই রুপি সোয়াপের জন্য শর্টলিস্ট করেছে, কারণ ভারত থেকে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ পণ্য কেনে, এবং তার কিছুটা অংশের দাম রুপিতে মেটানোর আগ্রহ থাকবে বলেই ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধারণা।
শুভময় ভট্টাচার্য অবশ্য মনে করেন, এর পরেও লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে রুপির আকর্ষণ এক্ষুণি বাড়ানো কঠিন। তার কথায়, ভারতীয় রুপি নিয়ে বাংলাদেশীরাতো অন্য কারও সঙ্গে ব্যবসা করতে পারছেন না, তাদের আবার ব্যবসাটা ভারতের সঙ্গেই করতে হচ্ছে। এটা সম্ভব, যদি রুপির দাম মোটামুটি এক জায়গাতেই থাকে। কিন্তু দু’মাসের মধ্যে যদি রুপির দাম মারাত্মক পড়ে যায়, তাহলে যে ব্যবসায়ী ভারতীয় রুপিতে লেনদেন করেছেন তার তো প্রচুর ক্যাপিটাল লস হয়ে যাবে।
অবশ্য ইদানীংকার উথালপাথাল কাটিয়ে ভারতীয় রুপি যদি অদূর ভবিষ্যতে স্থিতিশীল হতে পারে, তাহলে রুপিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, এমন কী বাংলাদেশের সাথেও না হওয়ার কোনও কারণ নেই বলেই ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের বিশ্বাস। তবে হ্যাঁ, তার আগে মিলতে হবে অর্থনীতির অনেকগুলো যদি আর কিন্তুর জটিল সমীকরণ।
সূত্র: বিবিসি