শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের প্রবাস আয় করমুক্ত রাখার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর কারণ হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে উল্লেখ করেছে। এনবিআরের বক্তব্য হচ্ছে, মুহাম্মদ ইউনূস অনুমতি না নিয়ে বিদেশ গিয়ে আয় করেছেন সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এ প্রতিবেদন যে কোনো সময় মন্ত্রিপরিষদ সভায় উঠবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সরকারি কর্মকর্তা। তিনি বিদেশে যাওয়ার আগে সরকারের পূর্বানুমতি গ্রহণ করেননি। তাই ড. ইউনূসের পুরস্কার, বক্তৃতা ও বিদেশি ভাষা অনূদিত বইয়ের স্বত্ব হিসেবে পাওয়া অর্থ গ্রহণের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ।
এই প্রথম ড. ইউনূসকে সরকারি কর্মকর্তা বলা হলো। তবে তাঁকে সরকারি কর্মকর্তা বলা যায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
২০১২ সালের ২ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ সভায় ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা কালে ওয়েজ আর্নার হিসেবে কত টাকা বিদেশ থেকে এনেছেন এবং তিনি তা আনতে পারেন কি না, এনে থাকলে কী পরিমাণ কর অব্যাহতি নিয়েছেন, সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য এনবিআরকে নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রায় এক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর গত আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে সেই প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠায় এনবিআর। সেই প্রতিবেদনে শুধু ড. ইউনূসের করের তথ্য নয়, গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম অধ্যাদেশ অনুযায়ী চলছে কি না, এসব বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন সাংবাদিকদের সাথে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। এর আগে এ-সংক্রান্ত আরেকটি প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জন্য তৈরি করেছিল এনবিআর। সেই প্রতিবেদনে ড. ইউনূসের প্রবাস-আয় করমুক্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
জানা গেছে, অনানুষ্ঠানিকভাবে সেই প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানানো হয়েছিল। পরে আবার তা সংশোধন করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয়। কর অব্যাহতি সম্পর্কে এনবিআরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৪ সালের জুলাই থেকে ২০১১ সালের জুন মাস পর্যন্ত ড. মুহাম্মদ ইউনূস মোট সাত অর্থবছরে আয়কর নথিতে ৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা প্রবাস-আয় হিসেবে দিয়েছেন। এ জন্য তিনি ১২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা আয়কর অব্যাহতি নিয়েছেন। প্রবাস-আয়কে করমুক্ত ঘোষণা করে ২০০৪ সালের ১৩ জুলাই প্রজ্ঞাপন জারি করে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি)।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের ৪৪ নং ধারার চার নং উপধারার ক্ষমতাবলে সরকার আবাসিক/ অনাবাসিক মর্যাদা-নির্বিশেষে বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের বাংলাদেশের বাইরে উদ্ভূত প্রচলিত আইনের অধীনে আনীত আয়কে উক্ত অধ্যাদেশের অধীনে প্রদেয় আয়কর হতে অব্যাহতি প্রদান করল।
এর মানে হলো, বাংলাদেশের কোনো নাগরিক দেশের বাইরে কোনো আয় করলে তা যদি তিনি বৈধ উপায়ে দেশে আনেন, তবে তাঁকে কোনো কর দিতে হবে না।
২০০৬ সালে ড. ইউনূসের নোবেল পুরস্কারের প্রাপ্ত অর্থও এসআরওর (বিধিবদ্ধ আদেশ) সূত্র দিয়ে কর অব্যাহতি দেওয়া হয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো এনবিআরের প্রতিবেদনে ড. ইউনূসের কর অব্যাহতি নিয়ে প্রশ্ন না তুললেও অন্য আরও বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সরকারি কর্মকর্তা। তিনি বিদেশে যাওয়ার আগে সরকারের পূর্বানুমতি গ্রহণ করেননি। তাই ড. ইউনূসের পুরস্কার, বক্তৃতা ও বিদেশি ভাষা অনূদিত বইয়ের স্বত্ব হিসেবে পাওয়া অর্থ গ্রহণের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে শুধু ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত প্রবাস-আয়ের তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু এনবিআর গ্রামীণ ব্যাংক ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অর্থ স্থানান্তর নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের আয়কর অব্যাহতির সমপরিমাণ অর্থ কীভাবে ব্যবহূত হয়েছে, তা-ও খুঁজেছে এনবিআর।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আয়কর নথি অনুযায়ী, ১৯৯৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর গ্রামীণ ব্যাংক তার রিভলভিং ফান্ড বা ঘূর্ণমান তহবিল থেকে ৩৪৭ কোটি টাকা এবং সোশ্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট ফান্ড থেকে ৪৪ কোটি টাকা গ্রামীণ কল্যাণ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করা হয়েছিল।
এনবিআর দাবি করছে, গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যব্যবস্থাপনা অনুযায়ী এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে না।
পরে দাতা সংস্থা নোরাডের আপত্তিতে একই দিনে আবার ৩৪৭ কোটি টাকা গ্রামীণ ব্যাংকে ফেরত আনা হয়।
নথিতে ফেরত আসা অর্থের কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। মূলত কর ফাঁকি দিতেই এ অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে বলে দাবি করছেন এনবিআর।
এনবিআরের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, অধ্যাদেশ অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংকের আয়কে কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে শর্ত থাকবে, আয়করের সমপরিমাণ অর্থ দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক সদস্যদের জন্য একটি পুনর্বাসন তহবিল গঠন করা হবে।