বাগেরহাটের রামপালে সুন্দরবনের কাছে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভারতের সঙ্গে চুক্তি করেছে সরকার, বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন যার বিরোধিতা করে আসছে।
রোববার রাজধানীর বিদ্যুৎ ভবনে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানির (এনটিপিসি) সঙ্গে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এ চুক্তি করে। চুক্তিতে সই করেন এনটিপিসির চেয়ারম্যান অরূপ রায় চৌধুরী এবং পিডিবি চেয়ারম্যান এ এস এম আলমগীর কবীর।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আাবদুল মুহিত, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মশিউর রহমান, জ্বালানি বিষয়ক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এনামুল হক, বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব আবুল কালাম আজাদ এবং ভারতের বিদ্যুৎ সচিব পি উমা শঙ্কর এ চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
অর্থমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বলেন, “সরকারি খাতে এই প্রথম যৌথ বিনিয়োগে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।”
উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এতে সালফারের পরিমাণ কম থাকবে, পরিবেশ দূষণের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে থাকবে।”
আইন ও সালিশ কেন্দ্রর নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানসহ ১২ জন বিশিষ্ট নাগরিক রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ বাতিলের আহ্বান জানিয়ে শুক্রবার এক বিবৃতি দেন।
ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য অন্য কোথাও স্থান নির্বাচনের পরামর্শ দিয়ে তারা বলেন, বনের পাশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মনোয়ার ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য পরিবেশগত ছাড়পত্র এখনো দেওয়া হয়নি। শুধু লোকেশন ক্লিয়ারেন্স (অবস্থানগত ছাড়পত্র) ইআইএ সম্পন্ন হলে তারপর পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়া হবে। যদি ইআইএ দেখে অধিদপ্তর যথাযথ মনে না করে তবে ছাড়পত্র দেওয়া হবে না।”
দেশের সবচেয়ে বড় এ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুাৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য গত বছরের ৩০ অগাস্ট এনটিপিসির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে সরকার। এনটিপিসি ও পিডিবির যৌথ উদ্যোগে এ কেন্দ্রের জন্য ইতোমধ্যে মংলা সমুদ্র বন্দরের কাছে ১ হাজার ৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
বর্তমানে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় ২৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে, যার জ্বালানি আসে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে। তবে রামপালের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চলবে আমদানিনির্ভর কয়লা দিয়ে।
বাগেরহাটে নির্মিতব্য এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এনটিপিসি এবং পিডিবির সমান অংশীদারিত্ব থাকবে জানিয়ে পিডিবি চেয়ারম্যান আলমগীর কবীর বলেন, “২০১৬ সালের মধ্যে এ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের আশা করছি।”
বাগেরহাটের রামপালে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হলেও এ কেন্দ্রের নাম ঠিক করা হয়েছে ‘খুলনা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র’। এ কেন্দ্রে ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট থাকবে।
চুক্তি স্বাক্ষরের আগে নির্মিতব্য এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে পিডিবি চেয়ারম্যান বলেন, সুন্দরবন এবং মংলা বন্দর থেকে ১৪ কিলোমিটার এবং বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে এ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। আর সুন্দরবনের আকরাম পয়েন্ট থেকে এর দূরত্ব হবে ৯১ কিলোমিটার।
“এতে আমদানি নির্ভর বিটুমিনাস কয়লা ব্যবহার করা হবে, যাতে সালফার ডাই অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড কম থাকবে। সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, যাতে উচ্চ দক্ষতা ও কম কয়লা ব্যবহার হবে।”
বর্তমানে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় সাবক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এর চেয়ে সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি উন্নতমানের বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়।
চুক্তি স্বাক্ষর শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এনটিপির চেয়ারম্যান অরূপ রায় চৌধুরী জানান, এ কেন্দ্র নির্মাণে আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে এক দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার।
এক প্রশ্নের জবাবে পিডিবি চেয়ারম্যান জানান, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এ কেন্দ্রের কয়লা আমদানি করা হবে। পাশাপাশি চীনের কথাও ভাবা হচ্ছে।
“এ কেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় মেটানো হবে বিভিন্ন দাতার সংস্থার কাছ থেকে ৭০ শতাংশ ঋণ (লোন) নিয়ে এবং বাকি ৩০ শতাংশ এনটিপি ও পিডিবি যৌথভাবে বিনিয়োগ করবে”, বলেন তিনি।
এ কেন্দ্র থেকে পিডিবি পাঁচ থেকে সাত টাকা দরে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনবে বলে জানান পিডিবি চেয়ারম্যান।
দেশে বর্তমানে ৭ হাজার মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে দৈনিক বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ৫ হাজার মেগাওয়াটেরও কিছু বেশি।
২০১৬ সালের মধ্যে বিদ্যুতের উৎপাদন প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সরকার এ নিয়ে মোট ৫০টি বিদ্যুুৎ কেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি করেছে। এর মধ্যে ১৭টি দ্রুত ভাড়াভিত্তিক, তিনটি ভাড়াভিত্তিক, ১১টি আইপিপি (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) এবং ১৯টি সরকারি।