প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক আদালতে জামায়াত নেতা গোলাম আযমের মানবতা বিরোধী অপরাধের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, এর ফলে দীর্ঘদিনের একটি প্রতীক্ষার অবসান এবং সংগ্রামের ফল বাস্তবায়িত হয়েছে। বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে দেয়া রায় কার্যকর করা হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আদালত রায় দিয়েছেন। সেখানে গোলাম আযমকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল যে শাস্তি দিয়েছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট হয়েছি। সাজা কি হবে তা আদালতের বিষয়।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সংসদে নবম সংসদের ১৮তম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে এ সব কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ৪২ বছর পর সাহস নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, সকল প্রকার ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে বিচারকরা বিচারের কাজ শুরু করতে পেরেছেন, একের পর এক রায় দিয়েছেন- এটাই হচ্ছে জাতির সবচেয়ে বড় পাওনা।
সংসদে বিরোধী দলের অনুপস্থিতির সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গোলাম আযম এবং যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি বিএনপি নেত্রীর যে সমর্থন তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি জামায়াত-শিবিরের গতকাল এবং আজকের হরতালের সমর্থন করে।
যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সহায়তাকারীদের ব্যাপারে সজাগ থাকার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তারা সংসদে না এসে জামায়াতের হরতালের সমর্থন করলেন। তার জন্য জাতি তাদের ধিক্কার জানাবে।
তিনি বলেন, সোমবার এবং আজ গোলাম আযমের রায়কে কেন্দ্র করে জামায়াত হরতাল ঘোষণা দেয়। তাদের হরতালকে সমর্থন করে বিএনপি দু’দিন সংসদ অধিবেশনে যোগ দেয়নি। জামায়াতের হরতালকে বিএনপির সমর্থন জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।
এর আগে তিনি বিরোধী দলকে সংসদে যোগ দেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, সংসদে তারা অনেক আলোচনা করেছেন। তাদের অনেক বক্তব্যই কুরুচিপূর্ণ ছিল, যা পার্লামেন্টের মান-মর্যাদা ক্ষুন্ন করেছে। তারপরও তাদেরকে অনেক সময় দেয়া হয়েছে। তাদের সদস্য সংখ্যা অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে যথেষ্ট বলার সুযোগ দেয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা গণতন্ত্রকে সম্মান করি। গণতন্ত্র যাতে অব্যাহত থাকে সেটাই আমাদের লক্ষ্য। গণতন্ত্র সমুন্নত রাখা, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপরিচালনা করাই আমাদের উদ্দেশ্য।
তিনি বলেন, আমরা এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। এ সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা সার্চ কমিটি গঠন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছি। স্বাধীনভাবে তারা নির্বাচন পরিচালনা করছে। একটি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় যে যে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন তা তা নেয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অঙ্গীকার ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবো। আমরা শুরু করেছি। এর মধ্যে কয়েকটি রায় হয়েছে। বিচারের রায় আমরা কার্যকর করবো।
তিনি বলেন, ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান মার্শাল ল’অর্ডিন্যান্স করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ বন্ধ করে দেয়। শুধু তাই নয়, জিয়াউর রহমানের আমলে গোলাম আযম পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসে। স্বাধীনতা বিরোধীদের মন্ত্রী বানানো হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, হাওয়া ভবনের দুর্নীতির কথা মানুষ ভুলে যায়নি। হাওয়া ভবনকে কিছু না দিয়ে কোন ব্যবসায়ী কোন ব্যবসা করতে পারতো না। জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস ছিল প্রতিনিয়ত ঘটনা। বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগ নেতা শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যা করা হয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে।
তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছাত্রদল, যুবদলের সন্ত্রাসীদের বিচার বিএনপি করেনি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আসামীর ভাইকে নেতা বানিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। তাদের (বিএনপি) দলের ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিনকে অপহরণ ও পরে হত্যাসহ ছাত্রলীগের ৮ নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা সরকার গঠনের পর দেশ থেকে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসী দূর করতে পেরেছি। ছেলেকে দিয়ে হাওয়া ভবন, খোয়াব ভবন তৈরি, গ্রেনেড হামলার মতো ঘটনা মহাজোট সরকারের সময় ঘটেনি। আমাদের আমলে যখন কোন ঘটনা ঘটেছে আমরা ব্যবস্থা নিতে চেষ্টা করেছি। বিশ্বজিৎ হত্যার সাথে জড়িত সকলকে আমরা গ্রেফতার করেছি, মামলা করেছি। বিচার শুরু হয়েছে। অপরাধীরা যেই হোক আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। জানিনা অন্য কোন দল এরকম ব্যবস্থা নিয়েছিল কিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, হলমার্কের সৃষ্টি হাওয়া ভবন থেকে। এ অন্যায় দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছিল। আমরাই ধরেছি। ব্যাংকের টাকা লুটপাট করেছে ডান্ডিডায়িং ও খাম্বা লিমিটেড কোম্পানি। ৯৮০ কোটি টাকা ব্যাংক তাদের কাছে পাওনা।
তিনি বলেন, মানি লন্ডারিং কারা করেছে আমার বলা লাগে না। বিদেশে প্রমাণিত হয়েছে। সিঙ্গাপুরের আদালত রায় দিয়েছে। বিদেশে পাচারকৃত টাকা আমরাই ফেরত এনেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, বিরোধী দলের নেতা বলেছিলেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে মসজিদের আজানের ধ্বনি শোনা যাবে না, উলু ধ্বনি শোনা যাবে। আমরা ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলাম।
আবার ২০০৮ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাই। এ সময়ে কোন মসজিদে আযান বন্ধ হয়ে যায়নি। বরং মসজিদ-মাদ্রাসার উন্নয়ন আওয়ামী লীগ আমলেই হয়েছে। হজ ব্যবস্থাপনায় এশিয়ার মধ্যে আমরা শ্রেষ্ঠ হয়েছি। অন্যদিকে বিএনপি আমলে হজের টাকা মেরে খাওয়ার ইতিহাসও আছে।
তিনি বলেন, ইসলামের সেবায় কেউ যদি কাজ করে থাকে, তা আওয়ামী লীগই করেছে। নামাজ-রোজা আওয়ামী লীগের লোকজনই বেশি করে। আমাদের দুর্ভাগ্য তাদের (বিএনপি) মিথ্যা বলার সাথে আমরা পেরে উঠি না। তারা মিথ্যা বলায় পারদর্শী।
এবারের বাজেটকে চমৎকার বাজেট উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৫ বছর মেয়াদের সরকারের এটি শেষ বাজেট। বাংলাদেশকে একটি আর্ত-সামাজিক উন্নয়নে এগিয়ে নেয়ার জন্য এ বাজেট চমৎকার। অতীতে অন্য কোন সরকার এরকম বাজেট দিতে পারেনি। যে উন্নয়ন করেছি দেশ-জাতি তার সুফল পাচ্ছে।
তিনি বলেন, জনগণ যদি আবার আমাদের নির্বাচিত করে তাহলে আমরা এ বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারবো।
সংসদ পরিচালনার জন্য স্পিকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বাজেট অধিবেশন পরিচালনা করেছেন।
কেবিনেট মিটিংয়ের প্রায় ৯৯ ভাগ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুশাসন এবং রাষ্ট্র ক্ষমতায় দক্ষতা ছাড়া এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। দেশের মানুষের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। আর্ত-সামাজিক উন্নতি হয়েছে। বার্ষিক কর্মসূচি ৯২ থেকে ৯৩ ভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। রোজার মাসেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা গেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা চাই এ বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকুক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে সাড়ে চার বছরে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন। তিনি হেফাজত নেতা আল্লামা শফি আহমেদের বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী সংসদ পরিচালনায় দক্ষতার জন্য স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী, বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া, মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ উপনেতা, চিফ হুইপ, বিরোধী দলের চিফ হুইপ ও সকল সদস্যের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
তিনি ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ, সংবাদ ও মিডিয়া কর্মীদেরসহ সংশ্লিষ্ট সকলকেও আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
তিনি পবিত্র রমজান সবার জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে সকল সংসদ সদস্য ও দেশবাসীকে ঈদের অগ্রিম শুভেচ্ছা জানান।