প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে একগুচ্ছ করপ্রস্তাব প্রত্যাহার করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিল পাসের আগে সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্লাস্টিক পণ্য, ওষুধ শিল্প, নিউজপ্রিন্ট, অগ্নিনির্বাপক সামগ্রী, গার্মেন্টস ও চা শিল্পের কর কমানোর অনুরোধ করেন।
ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পখাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়েছে। গত ৬ জুন ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ পরিবর্তন আনা হয়। একই সঙ্গে তীব্র সমালোচনার মুখে প্লট, ফ্ল্যাট ও জমি কেনায় কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিয়েছে সরকার।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘জমির দাম বেড়ে যাবে, এ জন্যই এ দাবিটি বিবেচনা করা হযেছে। ব্যক্তি শ্রেণীর করমুক্ত আয়সীমা দুই লাখ থেকে বাড়িয়ে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব বহাল রাখা হয়েছে। এছাড়া সংবাদপত্র শিল্পে ব্যবহৃত আমদানি করা নিউজপ্রিন্টের ওপর প্রস্তাবিত শুল্কহার কমানো হয়েছে। সংবাদপত্র মালিকদের তীব্র বিরোধিতা এবং নিউজ পেপারস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) নেতাদের বিশেষ অনুরোধে শুল্কহার কমানোর এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিড়ির ওপর উচ্চ করারোপের প্রস্তাবেও সামান্য পরিবর্তন আনা হয়েছে।’
শনিবার জাতীয় সংসদে এসব প্রস্তাব সংশোধনী এনে অর্থবিল ২০১৩ কণ্ঠভোটে পাস করা হয়েছে। প্র্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ অনুরোধে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এসব সংশোধনী আনেন। এ সময় বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া উপস্থিত ছিলেন।
গত ৬ জুন অর্থমন্ত্রী ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় প্লট, ফ্ল্যাট ও জমিতে কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি, অর্থনৈতিক সমিতি, এফবিসিসিআই, ডিসিসিআইসহ অনেকেই এই প্রস্তাবের কঠোর সমালোচনা করে। তারা সবাই উৎপাদনশীল ও শিল্পখাতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার দাবি জানান। সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার ক্ষেত্র প্রসারিত করা হলো। এখন ১০ শতাংশ কর দিয়ে যে কোনো শিল্পখাতে টাকা বৈধ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তার আয়ের উৎস জানতে চাওয়া হবে না।
বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং প্রান্তিক করদাতাদের করভার লাঘবের কথা বিবেচনা করে ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতার করমুক্ত আয়সীমা ২ লাখ ২০ হাজার টাকা বহাল রাখা হয়েছে। ৬ জুনের প্রস্তাবিত বাজেটে এ প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। চলতি বছর করমুক্ত আয়সীমা ছিল দুই লাখ টাকা। এছাড়া নারী ও ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে নাগরিকদের করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ এবং প্রতিবন্ধী করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ টাকা বহাল রাখা হয়েছে। চলতি বছর নারী ও ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে নাগরিকদের করমুক্ত আয়সীমা ছিল দুই লাখ ২৫ হাজার এবং প্রতিবন্ধী নাগরিকদের ছিল পৌনে তিন লাখ টাকা।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় প্রিন্ট মিডিয়ার জন্য ব্যবহৃত নিউজপ্রিন্টের আমদানি শুল্ক সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রস্তাব থেকে সরে এসে নিউজপ্রিন্টের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রকাশনা শিল্পে ব্যবহৃত প্রিন্টিং প্লেটের আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ কমিয়ে ৩ শতাংশ হারে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
নতুন অর্থবছরের বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে বা জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের মধ্যে রাখার প্রস্তাব বহাল রাখা হয়েছে। যদিও দেশের অর্থনীতিবিদরা বলে আসছেন, এই দুই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না।
সিটি করপোরেশনের করদাতাদের জন্য ন্যূনতম কর ৩ হাজার টাকা, জেলা শহরের ক্ষেত্রে ২ হাজার ও জেলা সদরের বাইরে অন্যান্য এলাকা বা গ্রামীণ এলাকার করদাতাদের ন্যূনতম কর ১ হাজার টাকার প্রস্তাব বহাল রাখা হয়েছে।
ভ্যাট: অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাবের পর থেকেই ভ্যাটের আওতা বাড়ানোয় নাখোশ ক্ষুদ্র ও খুচরা ব্যবসায়ী এবং দোকানদাররা। এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকেও ভ্যাটে পরির্বতন আনার প্রস্তাব দেয়া হয়। যেসব ক্ষুদ্র ও খুচরা ব্যবসায়ী এবং দোকানদার তাদের জন্য বিক্রির ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ হারে টার্নওভার কর প্রদানে আগ্রহী নন, তাদের জন্য এলাকাভিত্তিক বার্ষিক ৩ হাজার, ৬ হাজার, ৯ হাজার ও ১২ হাজার টাকা ভ্যাট প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। এলাকাভেদে তা ৩০০ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত কমানো হচ্ছে। এছাড়া প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি পণ্যসহ যেসব খাত ভ্যাটের আওতার বাইরে ছিল, সেগুলো আগের মতোই সুবিধা পাবে। এর বাইরে ভ্যাট শব্দটি ব্যবহারের কারণে যেসব অস্পষ্টতা সৃষ্টি হয়েছে, তাও ঠিক করা হয়েছে। এজন্য নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করবে এনবিআর।
বাজেটে শেয়ারবাজারে তালিকাভূক্ত মোবাইল কম্পানির কর বাড়ানোর প্রস্তাব বহাল রাখা হয়েছে। এর ফলে একটিমাত্র কম্পানি (গ্রামীণফোন) আক্রান্ত হবে। এছাড়া শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সিগারেট প্রস্তুতকারী কম্পানির করহার বাড়ানোর প্রস্তাবকে বহাল রাখা হয়েছে। এর ফলে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি ও সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের কিছুটা উপকার হবে। আগামী বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শেয়ারবাজারে তালিকাভূক্ত মোবাইল ও সিগারেট কম্পানির কর বিদ্যমান ৩৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ উন্নীতকরার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। শেয়ারবাজারে বর্তমানে মোবাইল কম্পানির মধ্যে গ্রামীণফোন এবং সিগারেট কম্পানির মধ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো তালিকাভূক্ত কোম্পানি হিসেবে রয়েছে।
সংবাদপত্র শিল্পে ব্যবহৃত আমদানি করা নিউজপ্রিন্টের শুল্কহার হ্রাস, বিনিয়োগ বাড়াতে উৎপাদনমুখী শিল্পখাতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য ‘প্যাকেজের’ আওতায় মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ছাড়সহ প্রস্তাবিত বাজেটে বেশকিছু সংশোধনী আনা হচ্ছে। গত ৬ জুন ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এসব পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেসব সংশোধনী আনা হচ্ছে তার বেশির ভাগই শুল্ক-কর সংক্রান্ত।
শ্রমিকদের কথা বিবেচনা করে বিড়ির সম্পূরক শুল্কহার কমিয়ে আনা হচ্ছে। বাজেট ঘোষণায় বিড়ির সম্পূরক শুল্কহার ২০ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। সংশোধনীতে বিড়ির প্রস্তাবিত এই শুল্কহার কমিয়ে আগের হারই বহাল রাখা হচ্ছে।
শিল্পে ব্যবহৃত হয় এমন ৪৩টি মধ্যবর্তী পণ্যের ওপর আরোপিত ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রকমূলক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাজেট ঘোষণায় ওইসব পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করে তার সঙ্গে বাড়তি ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রকমূলক শুল্ক নির্ধারণের প্রস্তাব করা হলে ব্যবসায়ী মহল থেকে তীব্র বিরোধীতা আসে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই বাড়তি এই শুল্ক তুলে নিতে বলে। এসব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ন্ত্রকমূলক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। মধ্যবর্তী পণ্যগুলোর ওপর থেকে অতিরিক্ত হারে শুল্ক তুলে নেয়ায় সিরামিক, সিরিঞ্জ, গ্গ্নাস, স্টেইননেস স্টিল মোবাইল ব্যাটারি ইত্যাদি শিল্পের উৎপাদন খরচ কমে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
বাজেট ঘোষণায় প্লাস্টিকের তৈরি তৈজসপত্র ও গৃহস্থালি সামগ্রীর ওপর ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন করারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব পণ্য গরিব ও নির্ধারিত আয়ের লোকেরা বেশি ব্যবহার করে- সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ওইসব পণ্য থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে।