রাজউকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নূরুল হুদা হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি চাপা দিয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে তদন্ত কমিটি রাজউকের এই দুর্নীতি অনুসন্ধান করে। দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তিরও সুপারিশ করে কমিটি। শেষ পর্যন্ত দুর্নীতিবাজরা নানা পন্থা অবলম্বন করে রেহাই পেয়ে যায়।
জানা যায়, তদন্তে রাজউকে ভয়াবহ দুর্নীতির প্রমাণ পওয়া যায়। দুর্নীতির অভিযোগে ২৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাসপেন্ড করে তদন্ত কমিটি। তখন তদন্ত এড়াতে পালিয়ে যায় ৩৫ কর্মকর্তা। গ্রেফতার করা হয় একজনকে।
তদন্তে দেখা যায়, রাজউকের একটি দুর্নীতিবাজ চক্র প্লট বাণিজ্য, ঘুষ ও চেক জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। মৃত ব্যক্তির নামেও রাজউকের দুর্নীতিবাজরা প্লট বরাদ্দ নিয়ে ভাগ-বাটোয়ারা করেছে।
দুর্নীতির অভিযোগে সাসপেনশনে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পরবর্তীতে নানা ব্যক্তিকে ম্যানেজ করে কর্মস্থলে ফিরে আসে। পলাতক দুর্নীতিবাজরাও ফিরে আসে।
সূত্র জানায়, রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নূরুল হুদা স্বয়ং এসব দুর্নীতিবাজদের ‘শেল্টার’ দিয়েছেন, এখনও দিচ্ছেন। এসব দুর্নীতিবাজদের কাছ থেকে অবৈধ সুযোগ নিয়ে চেয়ারম্যান এখন তাদের ‘ব্যাকআপ’ দিয়ে যাচ্ছেন। শুধু ব্যাকআপই দিচ্ছেন না তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও চলমান তদন্তও ধামাচাপা দিতে ভূমিকা পালন করেছেন চেয়ারম্যান।
এ সমন্বিত চক্র একদিকে প্রকাশ্যে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। অন্যদিকে নগরবাসীকে করে রেখেছে জিম্মি। রাজউকে কর্মরত সুইপার থেকে চেয়ারম্যান সবাই একাধিক সরকারি প্লটের মালিক হয়েছে যা বেআইনি।
জানা যায়, রাজউকের আরেকটি জমজমাট দুর্নীতির ক্ষেত্র হলো প্লট পরিবর্তন। এই বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে রাজউকে গড়ে উঠেছে একাধিক দালাল চক্র। রাজউকের শতকরা ৮৫ ভাগ কর্মচারী-কর্মকর্তাই প্লট পরিবর্তন বাণিজ্যে জড়িত। পরিত্যক্ত প্লট জালিয়াতির মাধ্যমেও তারা চালাচ্ছে লুটপাট। বিদেশে অবস্থানরত কিংবা মৃত ব্যক্তিদের নামে বরাদ্দকৃত প্লট পরিত্যক্ত দেখিয়ে বিনা নোটিশে বাতিল করে মোটা অংকের উৎকোচের বিনিময়ে অন্যের নামে বরাদ্দ দিচ্ছে দুর্নীতিবাজরা। আবার কখনো প্লটের মালিক থাকা সত্ত্বেও পরিত্যক্ত দেখিয়ে ভুয়া নামে একাধিক প্লটের মালিক বনে গেছেন এদেরই কেউ কেউ। অথচ রাজউকের বিধি অনুযায়ী এক ব্যক্তির একাধিক প্লট থাকা আইনত দণ্ডনীয়।
দুর্নীতির আর একটি ক্ষেত্র বাড়ির নকশা অনুমোদন। রাজউকের বিধি অনুযায়ী কোনো ইমারতের নকশা অনুমোদনের আগে সেখানে বাধ্যতামূলক ১২ ফুট চওড়া রাস্তা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে ইমারত পরিদর্শকরা মোটা উৎকোচ নিয়ে ৮ ফুট রাস্তা কাগজে-কলমে বড় দেখিয়ে ইমারতের নকশার অনুমোদন দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রেও ব্যাপক দুর্নীতির সন্ধান পায় তদন্ত সংস্থা। তদন্তে দেখা যায় সিবিএ নেতাদের আত্মীয়-স্বজনরা গণহারে নিয়োগ পেয়েছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে লেনদেন হয়েছে কোটি কোটি টাকা। নিয়োগকৃতদের প্রথমে মাষ্টার রোলে নিয়োগ দেয়া হয়।
পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে তা স্থায়ী করা হয়েছে। এতে পরিদর্শক ও সার্ভেয়ারসহ অন্যদের প্রশিক্ষণ, মেধা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতাও দেখা হয়নি। তারা দায়িত্ব পালনের চাইতে অর্থ ভাগাভাগিতে বিজ্ঞ বলে মন্তব্য করেছিলেন তদন্তকারীরা। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও চেয়ারম্যানের আশীর্বাদ নিয়ে রাজউকে এখনও বহাল তবিয়তে আছেন।
জানা যায়, চেক জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে একাধিক মামলাও বিচারাধীন আছে। চেক জালিয়াতিকে কেন্দ্র করে রাজউকের অভ্যন্তরে ভুয়া সিল পার্টিও গড়ে উঠে। এই জালিয়াতির সাথে সিবিএ নেতা, ব্যাংক কর্মচারী, রাজউকের একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ততার প্রমাণ পায় তদন্ত সংস্থা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভূমি মালিকেরও জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের এক কর্মকর্তা বলেন, এত বড় বড় দুর্নীতিবাজদের ‘শেল্টার’ দিয়ে এখন ফায়দা লুটছেন চেয়ারম্যান। পুরো রাজউককে তিনি জিম্মি করে রেখেছেন। এর ফলে সেবা পেতে আসা নগরবাসী নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কেউ কোন অভিযোগ করলেই রাজউক চেয়ারম্যান নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় বলে সবাইকে ভয় দেখান।