নারায়ণগঞ্জের আলোচিত-সমালোচিত সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান হঠাৎ করেই যেন আলোচনার বাইরে চলে যেতে বসেছেন। গত ১০ ডিসেম্বর শহরে বিশাল র্যালি ও শো ডাউনের পর থেকেই নারায়ণগঞ্জে আর দেখা মিলছে না তার। দেখা যাচ্ছে না দলীয় কোন কর্মসূচি বা অন্য কোন অনুষ্ঠানেও।
তবে এ সময়ের মধ্যে তিনি মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরসহ বিদেশ ভ্রমণ করে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের বেদনা কিছুটা ভোলার চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন তার ঘনিষ্টজনরা।
তারা এও বলেছেন, ‘নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতি চাঙ্গা করতে ও ভবিষ্যতে বিরোধী দলের কর্মকাণ্ডের কাউন্টার দিতে শামীম ওসমানকে প্রয়োজন হবে। কিন্তু তাকে বিতর্কিত করায় তিনি নিজে থেকে এখন আর নতুন করে কোন ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। সুবিধামতো সময়ে ঠিকই গা-ছাড়া দেবেন তিনি। ফের তার নেতৃত্বেই নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি পরিচালিত হবে।’
শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ এক সূত্র বাংলানিউজকে বলেন, ‘বিগত আওয়ামী লীগের শামীম ওসমানের সঙ্গে বর্তমান শামীম ওসমানের পার্থক্য রাত-দিনের। এখন কোন পদ পদবি না থাকায় তিনি অনেকটা মিইয়ে গেলেও তার সাংগঠনিক শক্তি প্রবল।
গত ৩০ অক্টোবর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিপুল ভোটে পরাজিত হওয়ার পর অনেকে প্রচার করেছিল শামীম ওসমান ‘শেষ’ হয়ে গেছেন। কিন্তু গত ১০ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শামীম ওসমানের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত শো ডাউনে জনতার ঢল প্রমাণ করে তিনি এখনো ফুরিয়ে যাননি। কারণ দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা এখনো তার প্রতি দুর্বল ও আনুগত্য রাখে।
নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা বাংলানিউজকে বলেন, ‘শামীম ওসমানকে হারাতে শত শত কোটি টাকার খেলা হয়েছে। কিন্তু তার পরও শামীম ওসমান হারিয়ে যাননি।’
গত ১০ ডিসেম্বর শামীম ওসমান শো ডাউনের আগে বলেছিলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে বিএনপি- জামায়াত কোটি কোটি টাকার খেলা খেলেছে। আমার মত আওয়ামী লীগের একজন সাধারণ কর্মীকে পরাজিত করতে বিরোধীদলের নেতা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগের রাতে তার প্রার্থীকে কোরবানি দিয়েছেন। ওই ভোটগুলো অন্য জায়গায় পড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘পরাজয় থেকেও অনেক কিছু শেখার রয়েছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজিত হয়ে আমি অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। তবে নির্বাচনে পরাজিত হলেও আমার ইচ্ছে আজীবন মানুষের সেবা করে যাওয়া।’
ওই বক্তব্যে নিজের রাজনীতি সঠিক পথে এগুচ্ছে বলেও দাবি করেন শামীম ওসমান।
নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-আহবায়ক মফিজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী দল, আর নারায়ণগঞ্জ একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা। এ জেলায় দলের নেতা-কর্মীদের সব সময়ে উজ্জীবিত করে রাখা প্রয়োজন।’
নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের আহবায়ক কমিটির সদস্য ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আনিসুর রহমান দীপু বাংলানিউজকে বলেন, ‘নেতা হওয়া সহজ, কিন্তু জননেতা হওয়া সহজ নয়। শামীম ওসমান প্রবলভাবে একজন সাংগঠনিক নেতা। তার অনুগত বিশাল কর্মীবাহিনী রয়েছে যারা মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে শহরে বিশাল শো ডাউন করার সামর্থ রাখে। তাকে দিয়ে দলের অগ্রযাত্রা সম্ভব।’
ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি সাইফ উল্লাহ বাদল ও সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী বাংলানিউজকে বলেন, ‘শামীম ওসমান জানেন কি করে দল ও কর্মীদের প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনতে হয়। কিন্তু তার বিরুদ্ধে বার বার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। এ কারণেই হয়তো তার আগ্রহে কিছুটা ভাটা পড়েছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের এক নেতা বাংলানিউজকে বলেন, ‘১৯৯৮ সালের ৯ জুন বিএনপির চট্রগ্রাম অভিমুখী লংমার্চ আটকে দিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেই শামীম ওসমানকে ফোন করে অনুরোধ করা হয়। সে অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়েই শামীম ওসমানের ললাটে গডফাদার এর তিলক এঁটে যায়।’
এ প্রসঙ্গে শামীম ওসমান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমিত সাপেক্ষে ২০০০ সালের ১৬ এপ্রিল দেশ বরেণ্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে তোলারাম কলেজে জাহানারা ইমাম ভবন উদ্বোধনের পর মুক্তমঞ্চের সমাবেশ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি ও ওই সভা থেকেই নারায়ণগঞ্জে নিজামীসহ যুদ্ধাপরাধীদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। এর মূল্য উদ্দেশ্য ছিল বর্তমান প্রজন্মকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা।’
তিনি বলেন, ‘ঘটনার তিন দিন পর মুন্সীগঞ্জে যেতে পারেননি নিজামী। পরে জামায়াতের মজলিশে শূরার এক বৈঠকে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়। লং মার্চে বাধা, টানবাজার পতিতা পল্লী উচ্ছেদে তৎকালীন যেসব গোষ্ঠীর স্বার্থ বিঘ্নিত হয়েছিল তারাও তখন মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর ওই ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারে শরিক হয়। ষড়যন্ত্র আর অপপ্রচারের পাশাপাশি ২০০১ সালের ১৬ জুন বোমা হামলা করে আমাকে হত্যার চেষ্টা করে ওই চক্রটি। ২১ আগস্ট ও ১৬ জুনের বোমা হামলা একই চক্রের এবং একই সূত্রে গাঁথা। এসব ঘটনার পর থেকে কিছু কিছু পত্রিকা কাটতি বৃদ্ধির জন্য আমাকে গডফাদার উপাধি দেয়।’
তবে শামীম ওসমান বিরোধী গ্রুপ বলছে- ‘তাকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করা যায় না।’
এ অভিযোগে এরইমধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের আহবায়ক ও সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি নেন এসএম আকরাম।
তার বক্তব্য, ‘আমরা অনেকেই জানি, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সম্মেলন হলে শামীম ওসমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হবেন না। কারণ, বর্তমানের নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সুস্থ ধারার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী।’
নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘৩০ অক্টোবর নির্বাচনেই জনতা রায় দিয়েছে কে জনপ্রিয় আর কাকে মানুষ অপছন্দ করে।’
নির্বাচনের পর মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভী বলেন, ‘শামীম ওসমান এখন চেঞ্জ ইমেজ, চেঞ্জ নারায়ণগঞ্জ- শ্লোগানে নিজের ইমেজ পরিবর্তন করতে চাইছেন। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের মানুষ এখন জেগে উঠেছে। মানুষ এখন ভাল-মন্দের পার্থক্য করতে শিখেছে। তবে উনি যদি মনমানসিকতা পরিবর্তন করেন, মানুষের কল্যাণে কাজ করেন, তাহলে অবশ্যই তার সঙ্গে কাজ করবো। শহরে কাজ করতে হলে, মানুষকে শান্তি দিতে হলে, শান্তিপ্রিয় মানুষেরই প্রয়োজন। তবে শামীম ওসমান সাংগঠনিক নেতা।’
অপর এক নেতা বাংলানিউজকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কোন দাম্ভিকতাই কাজে আসেনি শামীম ওসমান ও তার ভাইদের। নারায়ণগঞ্জবাসী নারায়ণগঞ্জের উন্নয়নের সারথী হিসেবে বেছে নিয়েছে সাবেক পৌর মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভীকে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নীতি নির্ধারকরা এখন আর শামীম ওসমানকে নিয়ে ভাবতে নারাজ।’
শামীম বিরোধী এক নেতা জানান, স্থানীয় আওয়ামী লীগে তার কোন পদ নেই। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি বিশাল অংশ তার বিরুদ্ধে অবস্থান করছে। নারায়ণগঞ্জের সুশীল সমাজও তার পক্ষে কথা না বলে অবস্থান নিয়েছে কঠোর বিরোধিতায়।
প্রসঙ্গত, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনে পালিয়ে যাওয়ার পর তার উপর আস্থা হারাতে থাকেন নেতাকর্মীরা। তাদের অভিযোগ, ২০০১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত শামীম ওসমান নিজে বাঁচতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে বেড়ালেও তার নেতাকর্মীরা ছিল বেকায়দায়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচনের পর ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি শামীম ওসমান দেশে ফিরে এলেও আগের অবস্থানে যেতে পারেননি।