নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের চতুর্থ বর্ষপূর্তি মঙ্গলবার।
বিচার বিভাগের উপর নির্বাহী বিভাগের অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ ও নিম্ন আদালত বিশেষ করে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের উপর বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর পৃথক বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়।
স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে দিনটি মাইলফলক হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার ফলে দেশের নিম্ন আদালতের অন্যতম প্রধান অংশ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ওপর বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বিচার ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাসদার হোসেনের দায়ের করা একটি রিট মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ করতে ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য ছয় মাস সময় বেঁধে দেন।
এরপরও সরকারের আট বছর লেগেছে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ করতে।
বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ফলে ঢাকার নিম্ন আদালতে মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়লেও মামলার বিচারে পদ্ধতিগত কোন পরিবর্তন না হওয়ায় ভোগান্তি কমেনি বিচার প্রার্থীদের।
২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের আগে ২০০৫ সালে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলা দায়ের হয় ৮ হাজার ৬৫৭টি, নিষ্পত্তি হয় ৬ হাজার ২৮২ টি। ২০০৬ সালে মামলা দায়ের হয় ১৪ হাজার ৩২২টি নিষ্পত্তি হয় ৭ হাজার ২৭৩ টি।
২০০৭ সালে মামলা দায়ের হয় ১২ হাজার ৬৮টি, নিষ্পত্তি হয় ৭ হাজার ৭৩৩ টি।
বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর ২০০৮ সালে মামলা দায়ের হয় ১৪ হাজার ৩০৪ টি, নিষ্পত্তি হয় ৮ হাজার ৭৬৩ টি। ২০০৯ সালে মামলা দায়ের হয় ১৭ হাজার ৯৫ টি, নিষ্পত্তি হয় ১২ হাজার ২৯৮ টি। ২০১০ সালে মামলা দায়ের হয় ১৮ হাজার ২৪ টি, নিষ্পত্তি হয় ১৩ হাজার ৭২৭ টি এবং ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মামলা দায়ের হয়েছে ২১ হাজার ৪৬ টি ও মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ১০ হাজার ২৪৬ টি।
বিচার বিভাগ পৃথকীকরন প্রসঙ্গে ঢাকা বারের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাহবুবুল আলম দুলাল বাংলানিউজকে বলেন, ‘বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ফলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়েছে। মামলা নিষ্পত্তির হার বেড়েছে। নি¤œ আদালতের বিচারকদের প্রতি নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব বিলুপ্ত হয়েছে। তবে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এখনও কোন কোন মামলায় মন্ত্রণালয় হতে অযাচিত হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সুফল পেতে দেশের আদালতগুলোতে প্রসিকিউটর (আইন কর্মকর্তা) নিয়োগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। পিপি, অতিরিক্ত পিপি, স্পেশাল পিপি, এপিপি, জিপি, অতিরিক্ত জিপি, এজিপিদের নিয়োগ রাজনৈতিক হবার ফলে তারা রাষ্ট্রের বদলে সরকারের আনুগত্য করে। ফলে তারা মামলার বিচারে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে।’
তিনি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে স্থায়ী আইন কর্মকর্তা নিয়োগের দাবী জানান।
সহকারী জজ নিয়োগে সম্পূর্ণ নতুন লোক নিয়োগের ফলে সামাজিক ন্যায় বিচার ব্যাহত হচ্ছে বলেও দাবী করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অনেকগুলো ধাপ পার হয়ে বিচার কার্যে বসতেন। ফলে তাদের মাধ্যমে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হতো। কিন্তু বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ফলে নতুন লোক নিয়োগে এবং কমপক্ষে এক বছর তাদের ট্রেনিং না থাকায় ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তা অপর্যাপ্ত।’
২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বেতন-ভাতাদি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করা হয়।
নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হলেও এখনো স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দেওয়া হয়নি বিচারকদের। বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পে-কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে নিম্ন আদালতের বিচারকদের মূল বেতনের ৩০ শতাংশ হারে `বিশেষ ভাতা` প্রদান করা হয়। কিন্তু আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোন বেতন বাড়েনি। তাদের ৩০ শতাংশ হারে `বিশেষ ভাতা` প্রদান করা হয় না। ফলে তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
এছাড়া নিম্ন আদালতের এজলাসের সমস্যা প্রকট। ছোট অপরিসর কক্ষে চলে বিচার কাজ। তাও কোন কোন এজলাসে ভাগাভাগি করে দুই-তিনজন বিচারককে বিচারকাজ পরিচালনা করতে হয়। বিচারকদের জন্য পর্যাপ্ত খাস কামরা নেই। স্টোর কক্ষ, স্টেনো কক্ষ, কম্পিউটার কক্ষ বা অন্য কোনো কক্ষ খাস কামরা হিসেবে ব্যবহার করছেন বিচারকরা।
অ্যাডভোকেট মাহবুবুল আলম দুলাল বলেন, ‘এসব সমস্যা দ্রুত সমাধান না করলে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সুবিধা পেতে সাধারণ মানুষকে অপেক্ষা করতে হতে পারে আরও অনেক বছর।