নওয়াজ শরীফই পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে তার দল পাকিস্তান
মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর গতকাল জাতীয় পরিষদে তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন তিনি। গতকালই সন্ধ্যায় তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করান প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি। এরই মধ্যে তিনি পাকিস্তানে ড্রোন হামলা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। ঘোষণা দিয়েছেন ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের। একটি আধুনিক, উন্নত ও সমৃদ্ধশালী পাকিস্তান উপহার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। পাকিস্তানের প্রভাবশালী পত্রিকা ডন-এর অনলাইন সংস্করণ জানায়, প্রধানমন্ত্রী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মোট তিন জন। তারা হলেন পিএমএল-এন-এর নওয়াজ শরীফ, পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)-র মাখদুম আমিন ফাহিম ও পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ (পিটিআই)-এর জাভেদ হাশমী। পার্লামেন্টে ২৪৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন নওয়াজ শরীফ। মাখদুম আমিন ফাহিম পান ৪২ ভোট, জাভেদ হাশমী পান ৩১ ভোট। ১৯৯৯ সালে সাবেক সেনাপ্রধান পরে প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের হাতে তিনি ক্ষমতা হারান এক অভ্যুত্থানে। তারপর সৌদি আরবে ৭ বছরের নির্বাসিত জীবন কাটান। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি ঠাণ্ডা মাথায় পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছিলেন। এরপর ১১ই মে’র জাতীয় নির্বাচনে তার দল বাজিমাত করে দেয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে তার দল বিজয়ী হওয়ায় তিনিই যে পাকিস্তানের ১৮তম প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন এটা নিশ্চিত হয়ে যায় আগেই। নির্বাচনী প্রচারণার সময় ৬২ বছর বয়সী নওয়াজ শরীফ প্রতিশ্রুতি দেন তার দল বিজয়ী হলে পাকিস্তান হবে নতুন, আধুনিক ও উন্নত একটি দেশ। তিনি বেলুচিস্তানের সমস্যার সমাধানেরও আশ্বাস দেন। ভারতের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্কের কথা বলেন। সন্ত্রাসকে পাকিস্তানের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ বলে ঘোষণা দেন। তালেবানদের সঙ্গে শান্তি আলোচনার পক্ষে কথা বলেন। সামপ্রতিক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, তার সরকারের প্রথম কাজ হচ্ছে দেশের বিদ্যুৎ খাতের উন্নতি করা। যে হারে সেখানে লোডশেডিং হয় তা কমিয়ে আনা। অর্থনীতির উন্নতি করা। এছাড়া তিনি সড়ক, বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন স্থানের অবকাঠামোগত উন্নতির আশ্বাস দিয়েছেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দেশে বুলেট ট্রেন চালুর। তার এসব প্রতিশ্রুতির ফলে এরই মধ্যে পাকিস্তানের শেয়ারবাজার অপ্রত্যাশিতভাবে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। মঙ্গলবার ডন-এর হাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার একটি তালিকা আসে। তাতে সম্ভাব্য মন্ত্রী হিসেবে যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন পিএমএল-এন-এর সিনিয়র নেতা ইসহাক দার, চৌধুরী নিসার, আহসান ইকবাল, খুররম দস্তগির ও শাহিদ খাকান আব্বানি। এ ছাড়া ওই তালিকায় রয়েছেন পিএমএল-এফ-এর সদরুদ্দিন রাশাদি। এসব ব্যক্তির হাতে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হতে পারে। ওই তালিকা অনুযায়ী যে যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেতে পারেন তা এ রকম- অর্থমন্ত্রণালয়- ইসহাক দার, স্বরাষ্ট্র- চৌধুরী নিসার, তথ্য- পারভেজ রশিদ, বাণিজ্য- খুররম দস্তগির, প্রবাসী- মুর্তজা জাতোই, তথ্য প্রযুুক্তি- আহসান ইকবাল, আইন- জাহিদ হামিদ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক- শাহিদ খাকান আব্বাসি, উন্নয়ন- সদরুদ্দিন রাশদি, খাদ্য নিরাপত্তা- সরদার ইউসুফ এবং সংখ্যালঘু বিষয়ক- কামরান মাইকেল। এছাড়া কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর তালিকায় রয়েছে তারিক ফজল চৌধুরী, আনুশা রেহমান ও সায়রা আফজালের নাম। নওয়াজ শরীফ শপথ নেয়ার মাধ্যমে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবার গণতান্ত্রিক সরকারের হাত থেকে গণতান্ত্রিক উপায়ে একটি সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হলো। এর আগে কোন নির্বাচিত সরকার তার ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে যে ইতিহাস রচিত হলো তার কৃতিত্ব পিপিপি এবং পিএমএল-এন উভয়েরই। নওয়াজ শরীফ ১৯৮০ সালে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। প্রথমে তিনি পাঞ্জাবের অর্থমন্ত্রী, পরে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সাধারণ নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী নির্বাচন হয় পাকিস্তানে ১৯৯০ সালের নভেম্বরে। সে নির্বাচনে তিনি প্রথমবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনের আগে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর সরকার ভেঙে দেয়া হয়। তারপরেই ওই নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে নওয়াজ শরীফ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খানের সঙ্গে তার রাজনৈতিক মতপার্থক্যের জন্য প্রেসিডেন্ট তাকে বরখাস্ত করেন। এরপর সুপ্রিম কোর্ট তার সরকারকে পুনর্বহাল করলেও নওয়াজ শরীফ পদত্যাগ করেন এবং পার্লামেন্ট ভেঙে দেন। এর মধ্য দিয়ে নতুন নির্বাচনের পথ সৃষ্টি হয়। সে নির্বাচনে দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন বেনজির ভুট্টো। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সরদার ফারুক লেগারি পিপিপির এ সরকারকে বরখাস্ত করেন। এরপর নতুন নির্বাচন হয়। তাতে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করে পিএমএল-এন। দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন নওয়াজ শরীফ। এরপর তখনকার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ সাজ্জাদ আলীর সঙ্গে তীব্র দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন তিনি। তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। পরে তা প্রত্যাহার করা হয়। নওয়াজ শরীফ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে ১৯৯৮ সালে প্রথম পাকিস্তান পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়। এর কয়েক দিন পর একই পরীক্ষা চালায় ভারত। আস্তে আস্তে নতুন নিয়োগ দেয়া সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সঙ্গে কারগিল ইস্যুতে তার মতপার্থক্য তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। এ দ্বন্দ্বের সমাপ্তি ঘটে ১৯৯৯ সালের ১২ই অক্টোবর। সেদিন নওয়াজ শরীফকে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করেন পারভেজ মোশাররফকে। এরপর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পারভেজ মোশাররফকে বহনকারী বিমান অবতরণ করতে না দিয়ে তার গতি পাল্টে দেয়ায় তার বিরুদ্ধে বিমান ছিনতাই ও সন্ত্রাসের অভিযোগে সন্ত্রাসবিরোধী আদালত ২০০০ সালের এপ্রিলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। একপর্যায়ে এ ঘটনায় মধ্যস্থতা করেন লেবাননের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরি। তিনি নওয়াজ শরীফের শাস্তি লাঘব করিয়ে তাকে সৌদি আরবে নির্বাসনে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। অবশেষে ২০০৭ সালের নভেম্বরে নওয়াজ শরীফ পাকিস্তানে ফিরে আসেন। এর এক মাস আগে পাকিস্তান ফেরেন বেনজির ভুট্টো। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় নির্বাচন। এতে তার দল পার্লামেন্টের মোট আসনের এক-চতুর্থাংশ আসনে বিজয়ী হয়। সরকার গঠন করে পিপিপি। এ সরকারের মেয়াদ শেষে গত ১১ই মে ফের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিজয়ী হয় নওয়াজ শরীফের পিএমএলএ-ন।