দেশের ১২ জন বিশিষ্ট নাগরিক সুন্দরবনের কাছে প্রস্তাবিত কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে তা প্রত্যাহার করে পরিবেশ-জনিত প্রভাব ও জনমত যাচাই সাপেক্ষে অন্য কোনো সুবিধাজনক স্থান নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বাপা’র মহাসচিব ড. এম এ মতিন, আবু নাসের, ব্লাস্ট’র অবৈতনিক পরিচালক সারা হোসেন, নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশি কবীর, সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ফারাহ কবির এবং টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আবেদনে স্বাক্ষর করেন।
আবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ সরকার বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলায় ১৩০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভারতের এনটিপিসির সঙ্গে আগামী ২৯ জানুয়ারি চুক্তি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে বলে আমরা অবগত হয়েছি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়ে সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য রামপাল উপজেলাকে নির্বাচিত করায় আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। রামপালকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের স্থান নির্বাচিত করায় বিশ্ব ঐতিহ্যের ধারক পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন এবং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।’
বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেন, সরকার যে প্রাথমিক পরিবেশগত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুকূলে অবস্থানগত ছাড়পত্র প্রদান করেছে তাতে প্রকল্প এলাকা যে সুন্দরবনের পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার ৪ কিলোমিটারের মধ্যে এবং তা যে সুন্দরবনের সীমানা থেকে ১০ কিলোমিটার বাফা’র জোনের মধ্যে অবস্থিত তা স্পষ্ট। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, প্রাথমিক পরিবেশগত প্রতিবেদন কিংবা পরিবেশ অধিদফতরের অবস্থানগত ছাড়পত্র কোনোটিতেই সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার ওপর কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রভাব নিয়ে কোনো রকম আলোকপাত করা হয়নি। উপরন্তু আইন অনুযায়ী শিল্প এলাকা বা শিল্পসমৃদ্ধ এলাকা ছাড়া এ রকম প্রকল্পের ছাড়পত্র দেবার এখতিয়ার পরিবেশ অধিদফতরের নেই।
তারা বলেন, ‘সকলেই অবগত যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিপুল পরিমাণ কার্বন এবং ছাইভষ্ম নিঃসরিত হয়ে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের মারাত্মক দূষণ ঘটায়। এসব স্থাপনা থেকে নির্গত গ্যাসে ভারি ধাতু, সালফার এবং নাইট্রোজেন অক্স্রাইড মিশ্রিত থাকে, যা বাতাসের সঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্য পানি দ্বারা আশেপাশের জলাশয়ের পানি দূষিত হওয়া একটি অত্যন্ত পরিচিত দৃশ্য।’
‘সুন্দরবনের পাশে এমন মারাত্মক দূষণকারী একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে উঠলে তা সুন্দরবনের পরিবেশ ও রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ সমস্ত জীববৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। পাশাপাশি সুন্দরবনের মাটির গুণগত মান, প্রাণীদের হরমোন জাতীয় সমস্যা, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, নদী দূষণ, মাটির উর্বরতা হ্রাস এবং উদ্ভিদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।’
তারা বলেন, ‘ইতিমধ্যে জাতিসংঘের রামসার কনভেনশন’র সচিবালয় থেকে সুন্দরবন সংলগ্ন সরকারের তিনটি প্রকল্পের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। বন অধিদফতর কর্তৃক সুন্দরবনের অভ্যন্তরে এবং বাফা’র জোনে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপিত হলে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ সমস্ত জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে লিখিত অভিমত প্রদান করা হয়। বন বিভাগের এমন অভিমত প্রমাণ করে যে, প্রাথমিক পরিবেশগত প্রতিবেদন প্রণয়নে কিংবা অবস্থানগত ছাড়পত্র প্রদানে সংশ্লিষ্ট অধিদফতরগুলোর মতামত গ্রহণ করা হয়নি।’
তারা বলেন, ‘যেখানে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সমগ্র দেশবাসী সুন্দরবনকে বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তমাশ্চর্য নির্বাচিত করতে ভোট প্রদান করেছেন, সেখানে সরকারের এমন স্ববিরোধী সিদ্ধান্ত কোনো ভাবেই কাম্য এবং গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্ব ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে সুন্দরবন রক্ষায় বাংলাদেশ কেবল যে সাংবিধানিকভাবে নিজ জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তা নয়, বরং আমরা বিশ্বের প্রতিটি নাগরিকের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
‘মাত্র কিছুদিন আগে যেখানে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে নৌ-রুট প্রচলন নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হলো, সেখানে সুন্দরবনের স্পর্শকাতরতা বিবেচনা না করে প্রণীত প্রাথমিক পরিবেশগত প্রতিবেদন এবং প্রদত্ত অবস্থানগত ছাড়পত্রের ভিত্তিতে মারাত্মক দূষণকারী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ জনস্বার্থ বিরোধী।’
আবেদনে বিশিষ্ট নাগরিকরা আরো বলেন, ‘এমতাবস্থায় আমরা সুন্দরবনের স্পর্শকাতরতা বিবেচনা না করে প্রণীত প্রাথমিক পরিবেশগত প্রতিবেদন এবং প্রদত্ত অবস্থানগত ছাড়পত্র বাতিলের দাবি জানাই। একই সঙ্গে আমরা অবিলম্বে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার এবং পরিবেশগত প্রভাব ও জনমত যাচাই সাপেক্ষে অন্য কোনো সুবিধাজনক স্থানকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য নির্বাচিত করার দাবি জানাচ্ছি। বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় সম্পদ ও ঐতিহ্য রক্ষায় এ বিষয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীর সদয় ও আশু হস্তক্ষেপ কামনা করি।’