বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোটের শরীক হতে চায় বেশ কিছু নাম সর্বস্ব রাজনৈতিক দল। এ নিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে অনেকে দেন দরবারও করছেন। তাদের দাবি চারদলীয় জোটে তাদের শরীকের মর্যাদা দিতে হবে। খালেদা জিয়াও মোটামুটি গুরুত্ব দিয়ে এসব দলকে জোটে নেয়ার একটা চিন্তাভাবনা করছেন। কিন্তু রাজনৈতিক মহলে এসব দলের ব্যাপারে বেশ সমালোচনা রয়েছে।
সমমনা হিসেবে পরিচিত আটটি দলের মধ্যে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (বাংলাদেশ ন্যাপ) নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও ন্যাপ ভাসানীর নিবন্ধন নেই।
জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, মহাসচিব খন্দকার লুৎফর রহমান, এনপিপি’র সভাপতি শেখ শওকত হোসেন নীলু, মহাসচিব এডভোকেট ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, বাংলাদেশ ন্যাপের সভাপতি জেবেল রহমান গনি, মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া, বাংলাদেশ লেবার পার্টির সভাপতি ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, মহাসচিব হামদুল্লাহ আল মেহেদী, মুসলিম লীগের নির্বাহী সভাপতি এএইচএম কামরুজ্জামান, মহাসচিব আতিকুল ইসলাম, ইসলামিক পার্টির এডভোকেট আবদুল মোবিন, মহাসচিব আবদুর রশীদ প্রধান, ন্যাপ ভাসানীর শেখ আনোয়ারুল হক, মহাসচিব হাসরত খান ভাসানী, এনডিপির চেয়ারম্যান খন্দকার গোলাম মোর্তুজা, মহাসচিব আলমগীর মজুমদার – এই ১৬ জন ছাড়া মাঠে তাদের অন্য কোনো নেতাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। দেশের জাতীয় রাজনীতিতে এদের অবদান কতটুকু তা নিয়ে রয়েছে ব্যাপক সমালোচনা। আর এই ১৬ জনের মধ্যে জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান ওএনপিপি’র সভাপতি শেখ শওকত হোসেন নীলুকে অনেকে চেনেন। বাকিরা একেবারেই অপরিচিত মুখ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রাজনৈতিক নেতা বলেন, আটটি দলের ১৬ নেতা খুঁজে পাওয়াই যেখানে দায় সেখানে ওই দলের চেয়ারম্যানরা খালেদা জিয়ার পাশে বসেন কিভাবে? গত রমজানে বেশ কয়েকটি ইফতার পার্টিতে ওই আটটি দলের সভাপতিরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে এক মঞ্চে বসে ইফতারি করায় তখনো অনেকে এ নিয়ে সমালোচনা করেছেন।
জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সভাপতি শফিউল আলম প্রধানের দলে সর্বসাকুল্যে নেতাকর্মীর সংখ্যা শ’পাঁচেকের বেশি হবে বলে মনে হয় না। শফিউল আলম প্রধান বেশ কয়েকবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন করলেও বৈতরণী পার হতে পারেননি। তবে তিনি পরিচিত মুখ। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছাত্রলীগের সভাপতিরও দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি বিএনপিতে যোগ দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে একটি সূত্র জানায়।
ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন নীলু। এই দলটির নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন থাকলেও নেতাকর্মীর সংখ্যা দু’একশর বেশি নয়। নির্বাচন কমিশনের ফলাফল থেকে দেখা গেছে ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দু’টি আসনে নির্বাচন করেছিলেন শওকত হোসেন নীলু। ওই নির্বাচনে একটিতে ২৮০ অপরটিতে ২৮২ ভোট পেয়েছেন তিনি। জানা গেছে নীলু বর্তমানে অসুস্থ থাকায় দলের কোনো কার্যক্রমে নেই। তার অবর্তমানে এই দলটির কোনো অসিত্ব থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন অনেকেই। জানা গেছে, শওকত হোসেন নীলু একসময় ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জিয়াউর রহমানের সময় তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। পরে বিএনপি থেকে বের হয়ে পিএনপি নামে একটি দল করেন। এরশাদের আমলে জাতীয় পার্টিও করেছেন কিছুদিন।
বাংলাদেশ লেবার পার্টি নামের যে দলটি সমমনা আটটি দলের প্রতিনিধিত্ব করছে সেই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান দাবি করেন দেশের ১০/১২ টি জেলায় তাদের কমিটি আছে। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম, কমিলস্না, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, খুলনা, সিলেটে তার সংগঠন আছে। কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সংখ্যা ২৭ জন। সর্বসাকুল্যে সারা দেশে শ’দুয়েকের বেশী নেতাকর্মী না থাকলেও চেয়ারম্যানকে রাজনৈতিক মাঠে সক্রিয় দেখা যায় সব সময়। চারদলীয় জোটের ২৭ সেপ্টেম্বরের নয়াপল্টনের জনসভার মঞ্চেও উপস্থিত ছিলেন ইরান। ছাত্রজীবনে এনডিএর ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র শক্তির কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। এনডিএ ভেঙে যাওয়ার পর ২০০০ সাল থেকে তিনি লেবার পার্টি করেন। ‘চিরন্তন বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠনেরও সভাপতি তিনি। ওই সংগঠনের ব্যানারে প্রেস ক্লাবে বিভিন্ন সময় আলোচনা সভার আয়োজন করতে করতেই তিনি এখন নেতা।
জাতীয় প্রেস ক্লাব বা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এই ধরনের গোলটেবিল বৈঠক বা আলোচনা সভার আয়োজন ‘দোকান’ নামেই পরিচিত। এই মুহূর্তে সরকারি দলের সমর্থকদের অন্তত ১৪টি ‘দোকান’ সক্রিয় রয়েছে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এক সময়ের বেশ প্রতিষ্ঠিত একটি দল। কিন্তু কালের আবর্তে অনেকগুলো ভাগ হয়ে এ দলটির এখন আর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। সেই ন্যাপের একটি অংশ এখন বাংলাদেশ ন্যাপ নাম ধারণ করে বিএনপির জোটে শরীক হতে চাচ্ছে। সব মিলিয়ে দু’জন নেতাকেই মাঠে দেখা যায়। চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গনি আর মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া ছাড়া এই দলের আর কোনো নেতাকর্মীকে খুঁজে পাওয়া যায় না। জিয়াউর রহমানের গঠিত বিএনপির নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের নেতা মশিউর রহমান জাদু মিয়ার দৌহিত্র ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গাণি দু’একটি অনুষ্ঠানে এলেও তিনি রাজনৈতিকভাবে পরিচিত কোনো মুখ নন। দেড় বছর আগেও তিনি রাজনীতির মাঠে ছিলেন না। পিতা সফিকুল গানি স্বপনের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে দলের চেয়ারম্যানের পদটি পেয়েছেন। তিনি কোনোদিন ছাত্ররাজনীতিও করেননি।
ন্যাপ ভাসানীর শেখ আনোয়ারুল হক মওলানা ভাসানির আমলে দলের কোনো বড় পদ না পেলেও বর্তমানে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। গত কিছু দিন ধরে তিনি রাজনীতি থেকে দূরে অবস্থান করছেন। ইসলামিক পার্টির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আবদুল মবিন ২০/২৫ বছর ধরে একই পদে আছেন। তিনি অন্য কোনো রাজনৈতিক দল করেননি বলে জানা যায়। মুসলিম লীগের কামরুজ্জামানের অতীত রাজনীতির কোনো ইতিহাস নেই। কোনো সভায়ও বক্তৃতা দিতে দেখা যায়নি তাকে। পিতা মোনায়েম খানের কাছ থেকে দলের চেয়ারম্যানের পদটি পেয়েছেন।
এনডিপির চেয়ারম্যান খন্দকার গোলাম মোতুর্জা ছাত্রজীবনে জাসদ ছাত্রলীগ করতেন। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর হাত ধরে তিনি এনডিপিতে যোগ দেন। পরে সালাহউদ্দিন কাদের বিএনপিতে যোগ দিলে গোলাম মোর্তুজা দলের দায়িত্ব পান।
সব মিলিয়ে সমমনা এসব দলের একটি নাম ছাড়া আর কোনো কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায় না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমমনা একটি দলের নেতা পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, চারদলীয় জোটের বিএনপি জামায়াত বাদে অন্য যে দলগুলো রয়েছে তাদের সাংগঠনিক অবস্থা কি আমাদের চেয়ে ভালো? তিনি বলেন, আমিনীর মাদ্রাসা বাদ দিলে কি আছে? আর বিজেপির আন্দালিব রহমান পার্থ, তার ভাই আর মা ছাড়া সে দলের কয়জন নেতাকর্মীর নাম পাওয়া যায় বলেও তিনি প্রশ্ন করেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে রাজনীতির মাঠে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নতুন করে শরীক হয়েছে এলডিপি ও কল্যাণ পার্টি।
এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল অব. অলি আহমদ এমপি মহাসচিব অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম ও প্রেসিডিয়াম সদস্য রেদোয়ান আহমদ ছাড়া অন্য কোনো নেতার রাজনৈতিক পরিচিতি নেই। তাছাড়া এই তিন নেতা এক সময় বিএনপির রাজনীতি করতেন। এর মধ্যে রেদোয়ান আহমদ ও জাহানারা বেগম ২০০১ সালে বিএনপির মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। বর্তমানে এলডিপি করলেও তাদের চট্টগ্রামে কর্নেল অলির নিজ আসন ছাড়া অন্য কোথাও প্রার্থী দিলে পাঁচ’শ ভোট পেতে কষ্ট হবে।
এর চেয়েও নাজুক অবস্থা কল্যাণ পার্টির। দলের চেয়ারম্যান ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও জামানত ফেরত পাননি একটিতেও। কল্যাণ পার্টি বলতে মেজর জেনারেল অব. ইবরাহিম বীর প্রতীক ছাড়া অন্য কোনো নেতার নাম খুঁজে পাওয়া যায় না।
এ বিষয়ে একজন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ বলেন, দেশে বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত আর জাতীয় পার্টি ছাড়া অন্য কোনো দলের এদেশে কোনো অস্ত্বিত্ব নেই। যারা আছে সবই নাম সর্বস্ব। দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠে থাকলেও নির্বাচনের সময় নিজস্ব মার্কায় নির্বাচন করতে ভয় পায়। কারণ নিজের মার্কায় নির্বাচন করে জয়লাভ করা তাদের পক্ষে কঠিন। এদেশের রাজনীতি এখন দুই দলের ওপর নির্ভরশীল, আরএটাই বাস্তবতা।
ভূঁইফোড় দল নিয়ে বিএনপি কেমন জোট করছে-এমন প্রশ্নের উত্তরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, “এসব দলের সংগঠন কত শক্তিশালী সেটা বড় কথা নয়। অনেকগুলো দল এক জোট হলে জনগণের মধ্যে একটা প্রভাব পরে।” তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, “আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটেও জাতীয় পার্টি আর আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দলের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।”
তিনি বলেন, “বিএনপিসহ চারদলীয় জোটের সঙ্গে যেসব সমমনা দলগুলো এক জোট হয়ে কাজ করছে তারা বিভিন্ন সময় মানববন্ধন আলোচনা সভার আয়োজন করে থাকে। এসব অনুষ্ঠানের বক্তব্য বিবৃতিও আন্দোলনে প্রভাব ফেলে। সুতরাং আমরা যাদের সঙ্গে জোট করছি, তাদের দলে কয়জন নেতাকর্মী আছে সে হিসাব আমরা করি না। একটা দল আছে এটাই বড় কথা।”