বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে সামপ্রতিক কয়েকটি বড় রকমের অগ্নিকাণ্ড বিশেষ করে অতি সমপ্রতি সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর বাংলাদেশের পোশাক শিল্প রক্ষায় নড়েচড়ে বসেছে মার্কিন প্রশাসন। এ বিষয়ে গতকাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়), ডিপার্টমেন্ট অব লেবার (শ্রম মন্ত্রণালয়) এবং অফিস অফ দ্য ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (বাণিজ্য মন্ত্রণালয়)-এই তিন মন্ত্রণালয় যৌথভাবে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরী পোশাক আমদানিকারক মার্কিন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে এক কনফারেন্স কলের আয়োজন করা হয়। স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র বলেন, এই তিন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিগণ তৈরী পোশাক আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তাদের আলোচনায় বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা বিধান, কর্মস্থলে শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ উন্নয়ন ও তাদের অধিকার সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ঘন ঘন দুর্ঘটনা রোধে, শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা বিধানে এবং কর্মপরিবেশ উন্নত করার মাধ্যমে তাদের অধিকার সুরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার কিভাবে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে পারে এবং পোশাক আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর মতো অন্যান্য প্রাইভেট সেক্টর কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে সে বিষয়গুলো নিয়ে সমন্বিত আলোচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রাইভেট সেক্টরের এই আলোচনায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেক এবং ইন্টারন্যাশনাল লেবার অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি বারবারা শেইলোর স্টেট ডিপার্টমেন্টের পক্ষে নেতৃত্ব দেন।
পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেক এবং ইন্টারন্যাশনাল লেবার অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি বারবারা শেইলোর এই কনফারেন্স কল বৈঠকে বলেন, সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি আবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, বাংলাদেশের কর্মজীবী মানুষের জীবনের নিরাপত্তায়, পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা বিধানে তাদের কর্মস্থলের নিরাপত্তা বৃদ্ধির কাজটি সরকার, মালিক, ক্রেতা ও শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আমাদের সকলের সম্মিলিত দায়িত্ব। সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেক আরও বলেন, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সঙ্গে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের যৌথ স্বার্থ জড়িত। আমাদেরকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধির বিষয়টি যেন কোনভাবেই শ্রমিকদের মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের কিংবা পোশাক শ্রমিকদের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ বিষয়ে কোন প্রকার ছাড় দেয়ার বিনিময়ে না হয়।
স্টেট ডিপার্টমেন্ট অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে মার্কিন ক্রেতা কোম্পানিগুলোকে এই উদ্দেশ্যে গৃহীত তাদের কর্মপরিকল্পনাগুলো নিজদের মধ্যে দ্রুত সমন্বয়ের আহ্বান জানায়। বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর নিরাপত্তা ও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্বাধীন নিরাপত্তা পরিদর্শক নিয়োগ ও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও তার নিয়মিত পরিদর্শন ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দেরও পরামর্শ দেয়া হয় আমদানিকারক কোম্পানিগুলোকে। এ সব কর্মপরিকল্পনা হাতে নেয়ার পর এগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার, বিজিএমইএ, সিভিল সোসাইটি এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে নিয়মিত সমন্বয়ের পরামর্শ দেন তারা।
সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেক এবং ইন্টারন্যাশনাল লেবার অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি বারবারা শেইলোর, পোশাক কারখানাগুলোতে কর্মরত শ্রমিকদের অবস্থার বিষয়ে বিজিএমইএ এবং বাংলাদেশ সরকারকে নিয়মিত অবহিত করতে আহ্বান জানান। এছাড়াও জাতীয় শ্রম আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে বাংলাদেশ যেন তার শ্রম আইনকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মানে খুব দ্রুত উন্নীত করে সে বিষয়ে সরকারকে আহ্বান জানাতে আমদানিকারক পোশাক কোম্পানিগুলোকে পরামর্শ দেন তারা।
উল্লেখ্য, সাভার ট্র্যাজেডির দিন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কল্যাণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুধুমাত্র বাংলাদেশী অভিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে নয়, যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সর্বস্তরে এ দুর্ঘটনাটি নিয়ে আলোচনা ও উদ্বেগ ছিল। কংগ্রেস ও সিনেটের সদস্য ও তাদের স্টাফ মেম্বার থেকে শুরু করে, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম অফিসে, জাতিসংঘ সদর দপ্তরসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমনকি হাসপাতালের ইমার্জেন্সি রুমে বাংলাদেশী রোগীদের নিকট সেবাদানকারী ডাক্তারদেরকেও দুর্ঘটনা বিষয়ে জানতে চেয়ে বাংলাদেশী রোগীদের নিকট সমবেদনা প্রকাশ করতে জানা গেছে। এরই ধারাবাহিকতায় মার্কিন কংগ্রেসম্যানরাও বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। বিগত ২রা মে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অধিকার ও কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ উন্নত করার বিষয়ে সুদৃঢ় ও সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছে চিঠি লিখেছেন ওয়েস অ্যান্ড মিনস (উপায়-উপকরণ) কমিটি র্যাংকিং সদস্য স্যান্ডার লেভিন ও এডুকেশন অ্যান্ড ওয়ার্ক ফোর্স কমিটির সিনিয়র ডেমোক্রেট সদস্য জর্জ মিলার। তারা প্রেসিডেন্ট ওবামাকে এ বিষয়ে একটি অ্যাকশন প্ল্যান নির্ধারণের জন্য সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে নিয়ে একটি প্রশাসনিক সম্মেলন ডাকার আহ্বান জানিয়েছেন। এর আগে বিগত ১লা মে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা না রাখায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়ে ওয়ালমার্ট, গ্যাপ এবং আমেরিকান অ্যাপারেল এসোসিয়েশনকে চিঠি দিয়েছেন মার্কিন কংগ্রেসে নিউ ইয়র্ক থেকে নির্বাচিত সর্বপ্রথম এশীয় কংগ্রেসম্যান গ্রেস মেং। তিনি কংগ্রেসের হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির সদস্য এবং কংগ্রেসনাল বাংলাদেশ ককাসের একজন মেম্বার।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের জিএসপি সুবিধা বহাল থাকার বিষয়ে মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিন আগামী ৩০শে জুন। সাভার ট্র্যাজেডির পর যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের (ইউএসটিআর) এ বিষয়ক সিদ্ধান্তে কোন প্রভাব পড়বে কিনা জানতে চাইলে জিএসপি সাব-কমিটির সভাপতি এবং মার্কিন উপ-সহকারী বাণিজ্যমন্ত্রী উইলিয়াম জ্যাকসন-এর অফিস থেকে বলা হয়, উভয় দেশের বাণিজ্যস্বার্থে বিষয়টির স্পর্শকাতরতার বিবেচনায় তারা নির্ধারিত দিনের আগে এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি নয়। আর বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিলের দাবিতে সোচ্চার যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম শ্রমিক এলায়েন্স এএফএল-সিআইও-এর ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অ্যান্ড পলিসি উপদেষ্টা সিলেস্ট ড্রেক এখনও মনে করেন, বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা অনতিবিলম্বে বাতিল করা উচিত। তিনি বলেন, রানা প্লাজার মতো ঘটনা অবলীলায় প্রমাণ করে বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিষয়ে আমাদের উদ্বেগ কতটা বাস্তব। আমরা আবার প্রেসিডেন্ট ওবামাকে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিলের আহ্বান জানাই। উল্লেখ্য, সিলেস্ট ড্রেক জিএসপি বিষয়ক সর্বশেষ শুনানিতে বাংলাদেশের বিপক্ষে যুক্তিতর্ক তুলে ধরেছিলেন।