বিচারকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি এমপিদের

বিচারকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি এমপিদের

হাইকোর্টের বিচারক মিজানুর রহমান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন এমপিরা। ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অপপ্রচারমূলক সংবাদের কপি বিতরণ করায় গতকাল সংসদে তারা এ দাবি জানান। জবাবে আইনমন্ত্রী জানান, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করে ওই বিচারকের বিরুদ্ধে সংবিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। গতকাল সংসদে রাজীবের বিরুদ্ধে ধর্মীয় উস্কানিমূলক ও সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারের ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে  পড়েন এমপিরা। ওই বিচারককে বিএনপি-জামায়াত সমর্থক উল্লেখ করে তারা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বলেন- দলীয় এজেন্ডা অনুযায়ী কাজ করে ওই বিচারক সংবিধান লঙ্ঘন ও শপথ ভঙ্গ করেছেন। তিনি যেভাবে সংবাদের কপি বিতরণ করেছেন তাতে শহীদ রাজীবের হত্যার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। এদিকে আইনমন্ত্রী খুব শিগগিরই কাউন্সিল গঠনের ব্যবস্থা না নিলে স্পিকার নিজে এ বিষয়ে রুলিং দেবেন বলে ঘোষণা দেন। এছাড়া চিফ হুইপ আবদুস শহীদ বিষয়টি সংসদে নোটিশ দিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের ওপর আইনমন্ত্রীকে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান। বিকালে সংসদের অধিবেশন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য পয়েন্ট অব অর্ডারে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরে এ বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে সিনিয়র সংসদ সদস্যরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আলোচনায় অংশ নেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সংসদ সদস্য শেখ ফজুলল করিম সেলিম, চিফ হুইপ আবদুস শহীদ এবং আবদুল মান্নান। উল্লেখ্য, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ আন্দোলনের কর্মী আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে নিয়ে সোমবার একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ‘সামপ্রদায়িক ও উস্কানিমূলক’ সংবাদের কপি করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মধ্যে বিলি করা হয়েছে। মিজানুর রহমান ভূঁইয়া নামের একজন বিচারক সুপ্রিম কোর্টের কাগজ, প্রিন্টার ও খাম ব্যবহার করে প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের শতাধিক বিচারপতির কাছে ওই সংবাদের কপি বিতরণ করেন। ওই ঘটনায় আপিল বিভাগসহ হাইকোর্ট বিভাগের কয়েকজন বিচারপতি তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি রেজিস্ট্রার একেএম শামসুল ইসলামকে অবহিত করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আলোচনার শুরুতে মুজিবুল হক চুন্নু দুটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরের বরাত দিয়ে বলেন, গণজাগরণ মঞ্চের প্রথম শহীদ আহমেদ রাজীব হায়দারকে নিয়ে ‘সংগ্রাম’সহ কিছু পত্রিকা অসত্য খবর প্রকাশ করছে। জামায়াত-শিবির আন্তর্জাতিকভাবে ষড়যন্ত্র করছে। ধর্মীয় বিষয়ে মিথ্যা পোস্ট দিচ্ছে। তিনি বলেন, এই খবরগুলো একজন বিচারক কপি করে সুপ্রিম কোর্টের সব জায়গায় বিলি করেছেন। এটা অন্যায়, ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ওই বিচারপতি জড়িত। তিনি আরও বলেন, কেউই জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নয়। ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হোক। তিনি এ সময় ’৭২-এর সংবিধানের আলোকে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনতে ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃপ্রবর্তনের দাবি জানান। আলোচনার এক পর্যায়ে স্পিকার বলেন, আমি এখনই শুনলাম বিষয়টি। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে দেশের মানুষ কোথায় যাবে? বিচারপতিদের যদি এই অবস্থা হয়? আইনমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে এ ঘটনার একটি সুরাহা আশা করি। তা না হলে আমি এ বিষয়ে একটি রুলিং অবশ্যই দেবো। শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, বিচারপতি যদি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে না জানেন, যদি রাজনৈতিক দায়ে কাজ করেন তাহলে তার বিষয়ে আর কি বলার আছে? বিচারপতি হিসেবে ওই বিচারক যখন শপথ নেন তাতে কিছু সীমারেখা দেয়া ছিল। ওই বিচারক সেইসব ভঙ্গ করেছেন। তিনি বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তিনি এমন সময়ে এই কাজটি করছেন, যেখানে গোটা জাতি শাহবাগের গণজাগরণের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছেন, সেই গণজাগরণের একজন রাজীবকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। রাজীবকে হত্যার ধরন একাত্তরে জামায়াত-শিবিরের জঘন্য কর্মকাণ্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ওই বিচারক রাজীবকে মুরতাদ বলে আখ্যায়িত করেছেন। একজন বিচারপতি হয়ে কিভাবে তিনি একথা বলেন?  তিনি জামায়াত-শিবিরের পক্ষে কাজ করছেন। তাহলে কি এই হত্যার সঙ্গে তিনি জড়িত? তা না হলে তিনি এ কাজ কেন করলেন? রাজীব হত্যার ঘটনায় তাকেও ইন্টারোগেশনের আওতায় আনা হোক। তাহলে  পেছনের অনেক ঘটনা বেরিয়ে আসতে পারে। শেখ সেলিম বলেন, একটি দু’টি পত্রিকা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির জন্য রাজীব সম্পর্কে তার মৃত্যুর পর অপপ্রচার চালাচ্ছে। তারা নিজেরাই রাজীবের নামে লেখা তৈরি করে প্রচার চালাচ্ছে। তিনি বলেন, ওই বিচারপতি বিএনপি-জামায়াতের সময় বিচারপতি হন। আমরা জানি, কারা বিএনপি-জামায়াতের সময় বিচারক হয়েছিলেন। ওই সময়ে জাল সার্টিফিকেট নিয়ে অনেকে বিচারপতি হন। তারা ওইসব দলীয় লোকদের বিচারপতি বানিয়েছে। তাদের নিয়োগকৃত বিচারপতি এখন রাজাকারের পক্ষ নিয়ে শপথ ভঙ্গ করে আইন লংঘন করে কাজ করছেন। তিনি এই কাজটি করেছেন শাহবাগের গণজাগরণকে নস্যাৎ করার জন্য। বিচারক হয়ে এ কাজ তিনি করতে পারেন না। শেখ সেলিম ওই বিচারকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য যত দ্রুত সম্ভব সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি জানান। তিনি বলেন, গত বারও দেখেছি স্পিকারের একটি বক্তব্য নিয়ে একজন বিচারক অযাচিত মন্তব্য করেছিলেন। ওই সময় ওই বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য একটি প্রস্তাব রেখেছিলাম। অথচ ওই প্রস্তাবের বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। আবদুল মান্নান বলেন, স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য শাহবাগে গণজাগরণ তৈরি হয়েছে। সেই তরুণদের একজন শহীদ রাজীবের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। রাজীব নবীজীর বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক লেখা প্রকাশ করেছেন বলে অপপ্রচার করা হয়েছে।  যে ধরনের কথা প্রচার করা হচ্ছে তাতে যে কোন মুসলিম মনে আঘাত পাবেন। তিনি বলেন, রাজীবকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার মুখে সাতটি কোপ পাওয়া গেছে। এরপরও জবাই করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। একাত্তরের মতো তারা একই কায়দায় হত্যা করেছে। হত্যার ধরন দেখেই  বোঝা যায় কারা হত্যা করেছে। রাজীবের বাবা-মাও বলেছেন, এটা জামায়াত-শিবিরের কাজ। অথচ একজন বিচারক যিনি রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন, সেই দায় শোধ করার জন্য রাজীবের বিরুদ্ধে অপপ্রচারমূলক লেখা প্রচার করে এমন গর্হিত কাজ করতে পেরেছেন। খুনিদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ওই বিচারক যে কাজ করেছেন তাতে তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত শাস্তির বিধান করে বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষা করতে আইনমন্ত্রীকে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান আবদুল মান্নান। চিফ হুইপ আবদুস শহীদ বলেন, আজ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে তরুণ সমাজ উত্তাল। কয়েকদিন আগে সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম বিষয়টি সংসদে উত্থাপন করেছেন। ৩৩ জন সংসদ সদস্য এ নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেই তরুণদের একজন শহীদ রাজীবের বিরুদ্ধে এ ধরনের মনোভাব প্রকাশ করাই নগ্নতা ও ধৃষ্টতার প্রকাশ। অথচ ওই বিচারক  সেই কাজ করেছেন। চিফ হুইপ বিচারকের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংসদ সদস্যদের আলোচনা ও একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব নেয়ার সুযোগ করে দেয়ার আহ্বান জানান স্পিকারের প্রতি। তিনি বলেন, ৬৮ বিধিতে যে ব্যবস্থা আছে তাতে নোটিশ দিলে এ বিষয়টির ওপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার সুযোগ পাবেন সংসদ সদস্যরা। জাতি জানতে পারবেন। সংসদীয় পদ্ধতিতে কিভাবে বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত দেয়া যায় সেই প্রস্তাবও উঠে আসবে। আইনমন্ত্রী সেই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নিতে পারবেন। তিনি বলেন, আজ ওই বিচারক অপপ্রচারমূলক সংবাদ হকারের  মতো লিফলেট আকারে বিতরণ করে ধৃষ্টতাপূর্ণ কাজ করেছেন। জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, একজন বিচারপতি বিচারকের দায়িত্ব নিয়ে যে কাজ করেছেন তা একেবারেই জঘন্য। নিন্দনীয়। অসদাচরণমূলক। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনে প্রেসিডেন্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত। তিনি কাউন্সিল গঠনে প্রধান বিচারপতিকে বলতে পারেন। আমি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করবো। যাতে কাউন্সিল গঠন করে সংবিধানের ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। আইনমন্ত্রী বলেন, বিচারপতি হয়ে কখনও এ ধরনের কাজ করা উচিত নয়। এটা সংবিধান বহির্ভূত। ‘ইনকিলাব’ ও ‘আমার দেশ’ পত্রিকা রাজীবের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের কাজটি করেছে। এই সংবাদটি তারা মিলে তৈরি করে প্রকাশ করেছে। ছড়িয়েছে। যাতে রাজীবকে নিয়ে বিতর্ক তৈরি করা যায়। রাজীব এ ধরনের কাজ করেনি, করতে পারে না। আমি এর বিরুদ্ধে অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা নেবো।

অন্যান্য বাংলাদেশ রাজনীতি শীর্ষ খবর