‘রাজনৈতিক মনোভঙ্গির কাছে অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা পরাজিত হলো’

‘রাজনৈতিক মনোভঙ্গির কাছে অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা পরাজিত হলো’

সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিকল্প উৎস থেকে পদ্মা সেতুর অর্থ সংস্থান হলে প্রকল্প ব্যয় বাড়বে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বিশ্বব্যাংকের ঋণই ছিল এ প্রকল্পের সবচেয়ে সহজ অর্থায়ন। বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত জানানোর আগে সরকারের পক্ষ থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়াকে খুব বেশি যৌক্তিক হয়নি। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেছেন, বাংলাদেশে ভবিষ্যতে কোন প্রকল্পে সহায়তার আগে তারা দুর্নীতির বিষয়টি আগে খতিয়ে দেখবে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মীর্জ্জা এবি আজিজুল ইসলাম মনে করেন সরকারের সিদ্ধান্ত খুব একটা যৌক্তিক হয়নি। অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে রাজনৈতিক মনোভঙ্গির কাছে অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা পরাজিত হলো। টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানিয়েছেন, বিকল্প উৎস থেকে অর্থ সংস্থান করে সেতু বাস্তবায়ন হলে তা সাধারণ মানুষ ও দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ ফেলতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন থেকে সরকার নিজে থেকেই সরে আসার বিষয়ে ড. আকবর আলি খান বলেন, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ছিল সবচেয়ে উত্তম পথ। আর এটা সরকার জানে বলেই প্রথমে বিশ্বব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছিল। পরে যখন দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করে তখন তাদের খুশি করার জন্য যোগাযোগমন্ত্রী বদল করা হয়। দুর্নীতির তদন্ত করা হয়। তাদের শর্ত পালন করতে গিয়ে মামলা করা হয়েছে। কিন্তু যখন সমাধান হয়নি তখনই সরকার নিজে থেকেই সরে এসেছে। এখন সরকার বিকল্প অর্থায়ন থেকে পদ্মা সেতু করার চিন্তাভাবনা করছে। বিকল্প অর্থায়ন থেকে এই সেতু করা হলে এর ব্যয় বেড়ে যাবে এবং সময় লাগবে বেশি। বিকল্প অর্থায়ন থেকে পদ্মা সেতু করা সম্ভব কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটি নির্ভর করবে কোন খাত থেকে অর্থ সংগ্রহ করবে, ঋণ চুক্তি কি হবে তার ওপর। এটি প্রকাশ করলে বোঝা যাবে পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ।  তবে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নই ছিল সবচেয়ে ভাল ব্যবস্থা। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন থেকে সরে আসায় ভবিষ্যতে বাংলাদেশে কোন প্রকল্পে সহায়তায় এর প্রভাব পড়বে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে কোন প্রকল্পে সহায়তা করার সময় তারা দুর্নীতির বিষয়টি আগে খতিয়ে দেখবে। যদিও বিশ্বব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য তারা বাংলাদেশের সহায়তা বন্ধ করবেন না।
সাবেক উপদেষ্টা এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তকে খুব বেশি যৌক্তিক বলে মনে করি না। কারণ বিশ্বব্যাংক দরজা বন্ধ করেনি। আমরা নিজেরা দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। বিশ্বব্যাংকের কিছু প্রশ্ন ছিল। যার জবাব দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। সেই জবাবের প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংকের মতামত আসার আগেই সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লাভ-লোকসান পর্যালোচনা না করে এখন নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্পে কাজ করা বাস্তব সম্মত নয়। নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন উচ্চাভিলাষী বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ইতিবাচকভাবে দেখলে পদ্মা সেতু নিয়ে যে ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল সরকারের সিদ্ধান্তে তা শেষ হলো। সর্ববৃহৎ এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার এখন ভিন্নভাবে অর্থায়নে মনোযোগী হতে পারে। আশা করি সরকার পরবর্তী পদক্ষেপ সুষ্ঠুভাবেই নিতে পারবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক মনোভঙ্গির কাছে অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা পরাজিত হলো। সহজ শর্তে ঋণ থেকে বঞ্চিত হলো বাংলাদেশ। কিন্তু যে কারণে বৃহৎ এ প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটলো সেই অপবাদ কিভাবে দূর হবে সেই দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পেলাম না, তাই নিলাম না। এমন পরিস্থিতিতেই সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর চেয়ে কয়েকজন ব্যক্তিকে প্রমোট করাই সরকারের কাছে বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই সরকার একটি বড় সুযোগ হারালো। দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে যেসব ব্যক্তির নাম এসেছিল মামলায় সেসব ব্যক্তিকে আসামি করা হলে বিশ্বব্যাংক অবশ্যই অর্থায়ন করতো। একই ইস্যুতে কারও বিরুদ্ধে মামলা হবে। আবার কারও বিরুদ্ধে মামলা হবে না তা হতে পারে না। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক বৃহস্পতিবার এক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে এ বিষয়ে যা বলেছে তা সরকার ও দেশের জন্য বিব্রতকর। এ কারণে সরকার গতকাল ঘোষণা দিয়েছে- বিশ্বব্যাংক থেকে তারা এ বিষয়ে ঋণ নেবে না। এখন দুদকের তদন্তের ফল কি দাঁড়াবে তা-ও দেখার বিষয়। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিশ্বব্যাংক-এর চ্যাপ্টার ক্লোজড হওয়ার পর সেতু নির্মাণে বিকল্প পন্থা বের করা যুক্তিযুক্ত বিষয়। এ ক্ষেত্রে সুদ কি হবে? শর্ত কি হবে? এসব বড় বিষয়। বিকল্প পন্থা থেকে বিশ্ব ব্যাংক-এর মতো কম সুদে ঋণ পাওয়া সম্ভব নয়। উচ্চ হারে ঋণ নিয়ে সেতু নির্মাণ করলে সাধারণ মানুষ এবং অর্থনীতির ওপর কি প্রভাব পড়বে তা বড় প্রশ্ন। ভবিষ্যতে সরকার কতটুকু দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থেকে সেতু বাস্তবায়ন করতে পারবে সে প্রশ্নও থেকেই যাচ্ছে।

 

অন্যান্য অর্থ বাণিজ্য বাংলাদেশ রাজনীতি শীর্ষ খবর