যুক্তরাষ্ট্র থেকে: বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ক্রমাবনতিশীল কাজের পরিবেশ ও শ্রমিকদের মানবাধিকারের প্রতি চরম উদাসীনতায় বিশেষ করে গত মাসে তাজরিন ফ্যাশনসে সংঘটিত দেশের পোশাক শিল্পের বৃহত্তম অগ্নিকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সকল শক্তি প্রয়োগের পরামর্শ দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে চিঠি দিয়েছে মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ (সিনেট)। ‘ভয়ঙ্কর ট্র্যাজেডি’ হিসেবে উল্লেখ করে এ মাসের মাঝামাঝি ৬ জন সিনেটর ও একজন কংগ্রেসম্যান স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, আমরা জানি এ ভয়াবহ ট্র্যাজেডি থেকে এখন আর পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার কোন উপায় নেই, ইটস টু লেইট, কিন্তু ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সব রকমের ব্যবস্থা নিতে আমাদের একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
ওই চিঠিতে প্রেসিডেন্টকে জানানো হয়, তাজরিনের অগ্নিকাণ্ডের মতোই আরেকটি ভয়াবহ সংবাদ হলো মার্কিন সেনা, নৌ, বিমান, মেরিন এবং কোস্টগার্ডের সদস্যদের জন্য পোশাক সরবরাহকারী একটি কন্ট্রাক্টর প্রতিষ্ঠান হলো সোফি। সোফি তার সাব-সিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান ডেল্টা অ্যাপারেলের মাধ্যমে ওই পোশাক কারখানায় (তাজরিন ফ্যাশনস) মার্কিন মেরিন কোরের লোগো সংবলিত পোশাক তৈরির অর্ডার দিয়েছিল। পোশাক শ্রমিকদের মানবাধিকারের ন্যূনতম সুবিধা বঞ্চিত এ ধরনের কারখানা থেকে মার্কিন মেরিন কোরের সদস্যদের জন্য পোশাক তৈরি করানো, বিশ্বজুড়ে তারা যে আদর্শ ও মূল্যবোধ রক্ষায় কাজ করছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত বলে ওই চিঠিতে মন্তব্য করে পোশাক সরবরাহকারী কন্ট্রাক্টর ও সাব-কন্ট্রাক্টরদের লাইসেন্স প্রদানের বিষয়টি আরও বেশি স্বচ্ছতা ও কঠোরতার মধ্যে আনার জন্য পরামর্শ দেয়া হয় প্রেসিডেন্টকে।
মার্কিন সিনেটের পক্ষে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে লেখা ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন সিনেটর টম হার্কিন, সিনেটর আল ফ্রাঙ্কেন, সিনেটর শেরড ব্রাউন, সিনেটর প্যাটি ম্যুর্য়ে, সিনেটর জেফ বিঙ্গামেন, সিনেটর জন ডি. রকেফেলার (চতুর্থ), এবং রিপ্রেজেন্টেটিভ জর্জ মিলার।
এর পরপরই বিগত ১৮ই ডিসেম্বর কংগ্রেসে বাংলাদেশ ককাসের প্রতিষ্ঠাতা কো-চেয়ারম্যান জোসেফ ক্রাউলিসহ ১২ জন কংগ্রেসম্যান বাংলাদেশে অবনতিশীল শ্রম অধিকারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা প্রাপ্তির ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে চলমান পর্যালোচনার দ্রুত সমাপ্তির আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি রন কার্ক বরাবর চিঠি দেন। এতে তারা জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্সেস (জিএসপি)-এর আওতায় বাংলাদেশের কারখানার কমপ্লায়েন্স বিষয়ে পর্যালোচনা সম্পন্ন করার জন্যও আহ্বান জানান। চিঠিতে কংগ্রেসম্যানরা বলেছেন, বাংলাদেশে শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ এবং তাদের অধিকারের অবনতি ঘটায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শ্রমিক সংগঠন এএফএল-সিআইও বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে কাজের পরিবেশের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে ২০০৭ সাল থেকেই জিএসপি কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশের বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি রিভিউ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে চাপ দিয়ে আসছে। জিএসপি কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশের মতো গরিব দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য প্রবেশের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ভোগ করে থাকে। এ সুবিধাগুলো পেতে হলে একটি দেশের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে কাজের পরিবেশে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার ও শ্রমিক অধিকার মেনে চলতে হয়। মার্কিন কংগ্রেসম্যানরা ওই চিঠিতে বাণিজ্য প্রতিনিধি রনকে বলেন, আমরা মনে করি বাংলাদেশের কলকারখানাতে এ বিষয়টি অনুসরণ করছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখা এখন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
উল্লেখ্য, তাজরিনের অগ্নিকাণ্ডের পরপরই ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ-এর মুখপাত্র এ প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনায় ও লিখিত প্রশ্নের জবাবে জানান, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের মানবাধিকার ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ইস্যুতে আমরা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছি। এমনকি সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিন্টনের সর্বশেষ সফরেও বিষয়টি দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সকল পর্যায়ে এবং প্রকাশ্যেও আলোচিত হয়েছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজিএমইএ’র পক্ষে থেকে প্রদত্ত সামপ্রতিক প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রদত্ত জিএসপি সুবিধার আওতায় যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পায় না, সুতরাং জিএসপি সুবিধা পুনর্মূল্যায়নে বা বাতিলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পোশাক রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য কোন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়বে না। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বরাতে গতকাল ব্লুমবার্গ নিউজের এক সংবাদে বলা হয়, তাজরিনের অগ্নিকাণ্ড সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে বিদ্যমান থাকবে। এছাড়া বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর মতে তাজরিন অগ্নিকাণ্ডের পরও ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬% বৃদ্ধি পেয়েছে।
কিন্তু ওয়াকিবহাল মহল মাত্রই জানেন কোন কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধার বিষয়টি বাতিল হওয়া মানেই এর আওতায় শুল্ক মুক্ত পণ্য রপ্তানির সুবিধা দেয়ার বিবেচনার বিষয়টিও আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল হবে। এছাড়া এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশী পণ্য বিষয়ে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত পোশাক রপ্তানির সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি গত এক যুগ ধরে বাংলাদেশের ওয়াশিংটন কূটনীতির প্রাধিকার তালিকার শীর্ষে ছিল। এমনকি এ বছর মার্কিন রাষ্ট্রদূতের উপস্থিতিতে ঢাকার এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী নিজে তার বক্তৃতায় শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে আহ্বান জানান, যদিও এর এখতিয়ার কেবল মার্কিন কংগ্রেসের হাতে।
এ দিকে বড়দিনের ছুটিতে হাওয়াই যাওয়ার প্রাক্কালে বিগত ২১শে ডিসেম্বর হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ওবামা জানান, আগামী জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া নতুন কংগ্রেসে বেকার শ্রমিকদের বীমা সুবিধা বর্ধিতকরণসহ লেবার ও এমপ্লয়মেন্ট বিষয়ক বেশ কিছু ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। মার্কিন কংগ্রেসের নিয়মিত মিডিয়া পুলের একটি সূত্রমতে, এ সময় বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের মানবাধিকারের ক্রমানবতি বিষয়ে কংগ্রেসের উভয় কক্ষে (প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেট) সমপ্রতি প্রকাশিত উদ্বেগ সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত দেবেন বলেও ধারণা করা হচ্ছে।