বরেণ্য শিক্ষাবিদ, সামাজিক আন্দোলনের অগ্রদূত ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, অনেকে মনে করেন দেশের প্রধান দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে সরিয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আসলে তা কিন্তু নয়। তারা গেলে যে আসবে সে কিন্তু একনায়কতান্ত্রিকে পরিণত হবে। কারণ, প্রক্রিয়াটা তো রয়ে গেল! সুতরাং যিনি প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন তিনি সংবিধানগতভাবে একনায়কতন্ত্রী। তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান, এক্সিকিউটিভ প্রধান ও জুডিশিয়ারির প্রধান। এতোকাল তাই চলেছে, এখন যদিও বিচার বিভাগ আস্তে আস্তে আলাদা হচ্ছে, আলাদা হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। তার মানে একটু একটু রাষ্ট্রের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, রাজনীতিতে জনকল্যাণ বা জনস্বার্থ বলে কিছু নেই। আছে দু’জন একনায়কতন্ত্রীর বেঁচে থাকার ব্যাপার। যেমন করে হোক বেঁচে থাকা। তার জন্য দুই একনায়কতন্ত্রী রাষ্ট্রকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছেন, আমলাতন্ত্রকে দুই ভাগে, ছাত্রকে দুই ভাগে, উকিল, ডাক্তারকেও দুই ভাগে ভাগ করেছেন। দুই একনায়কতন্ত্রী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন।
সাপ্তাহিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এমন অভিমত ব্যক্ত করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাষ্ট্রশাসনে নৈতিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পলিটিক্সের কোন মূল্য নেই একদিক থেকে। কোন পলিটিশিয়ানকে পৃথিবী কোনদিন মনে রেখেছে এরকম দৃষ্টান্ত নেই। যদি মনে রাখে তাহলে পলিটিক্স ভিন্ন অন্য কোন কারণে মনে রেখেছে। যেমন সম্রাট অশোককে মনে রেখেছে, যেমন আব্রাহাম লিঙ্কন বা সম্রাট আকবরকে মনে রেখেছে। তারা পলিটিশিয়ান বা রাজা ছিলেন বলে মনে রাখেনি, এরকম রাজা হাজারে হাজারে চলে গেছে। তাদের মধ্যে কিছু ব্রাহ্মণের গুণ ছিল বলে, উন্নত মনুষ্যত্ববোধ তারা দেখাতে পেরেছিলেন বলে তাদের মনে রেখেছে। তারা ছিলেন রাজর্ষী। কেবল পলিটিশিয়ানকে কেউ মনে রাখেনি। নেহরুকে মনে রাখবে তিনি প্রাইম মিনিস্টার ছিলেন বলে? না। তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সিভিলাইজড মুভমেন্ট করেছিলেন বলেই তাকে মনে রেখেছে।
সেটা তো রাজনীতিরই পার্ট…। এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, রাজনীতিরই পার্ট, কিন্তু তার মধ্যে একটা উচ্চ মানবিক মূল্যবোধ ছিল। তিনি যে বইগুলো লিখেছিলেন তার মধ্যে উচ্চ মানবিক মূল্যবোধকে ধারণ করেছেন। সেসব কারণে তাকে মানুষ মনে রেখেছে। নইলে পলিটিশিয়ানকে কেউ মনে রাখে না। কারণ, তারা মনুষ্যত্বের বিবেককে তো ধারণ করে না। তারা ধারণ করে দলের, স্বার্থের, কিছু মানুষের মনুষ্যত্বকে। কিন্তু মানুষ তো অতো বোকা না। যে মানুষ কিছু মানুষের স্বার্থের জন্য তার পকেট খালি করে, তার জীবন শূন্য করে সবকিছু কেড়ে নেবে, আর সে তাকে দেবতা বলে পূজা করতে থাকবেÑ এটা কখনও ঘটেনি।
একটা উদাহারণ দেই। ক্ল্যাসিকেল মিউজিক আমাদের দেশে একটা সম্মানের জায়গায় ছিল। রাজারা, বড় বড় বোদ্ধারা, সামন্ত প্রভুরা এর সমঝদার ছিল। কিন্তু যখন গণতন্ত্র এলো তখন তো রাজাও নেই, সামন্ত প্রভুও নেই। তখন ইন্ডিয়াতে জওহরলাল নেহরু একবার ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে তার বাসায় আমন্ত্রণ জানালেন। আলাউদ্দিন খাঁ এলেন, তিনি সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন, ল্যান্ডিংয়ে নেহরু তাকে রিসিভ করার জন্য নেমে এসে দাঁড়িয়েছেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ যখন ল্যান্ডিংয়ে এলেন তখন নেহরু তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেন। পরদিন পুরো ইন্ডিয়ান কাগজে এ খবর ও ছবি ছাপা হলো। তখন পুরো ইন্ডিয়ায় সাড়া পড়ে গেল। ক্ল্যাসিকেল মিউজিক তাহলে নিশ্চয়ই খুব বড় জিনিস! নইলে নেহরুর মতো, যিনি শুধু প্রধানমন্ত্রীই নন, এতো বড় একজন মানুষ আলাউদ্দিন খাঁর পা ধরে সালাম করতেন না।
তার মানে বড় কীÑ সেটা একমাত্র পলিটিশিয়ানরাই চিহ্নিত করতে পারেন সবচেয়ে বেশি। কারণ, তারা সর্বক্ষণ জনসাধারণের সঙ্গে থাকেন। খবরের কাগজে সবচেয়ে বেশি খবর রাজনীতিবিদদের নিয়ে, সব পত্রিকা বের হয় পলিটিক্সকে কেন্দ্র করে। তোমরা যে আমার কাছে ইন্টারভিউ নিতে এসেছ, এর গোড়াতেও পলিটিক্স। সুতরাং যারা রুলার তাদের ন্যায়বোধ, নীতিবোধ, তাদের উচ্চতর জীবনবোধ জাতিকে প্রভাবিত করে। একই সঙ্গে তাদের পাপ, অপরাধ, হীনতা, ক্ষুদ্রতা, লোলুপতাÑ এগুলোও একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেয়।
বৃটিশ আমলে আমরা ওই উন্নত মূল্যবোধের মধ্যে মানুষ হয়েছিলাম। এটার কারণও ছিল পলিটিক্স। বৃটিশরা বহুকালের একটা সুপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের মূল্যবোধ নিয়ে এখানে এসেছিল। তারা চলে গেল। পাকিস্তান আমলে পঞ্চাশের দশক, ষাটের দশক পর্যন্ত বৃটিশ মূল্যবোধ এ দেশে কমবেশী ছিল। তারপর দেশ স্বাধীন হলো। এই প্রথম বাঙালির রাষ্ট্র হলো। কিন্তু রাষ্ট্র কী, বাঙালি তা জানে না।
একটা গল্প আছে এরকম: এক গ্রামে একবার একটা হাতি এসেছে। এর আগে হাতি কেউ কোনদিন দেখেনি। এত বড় জিনিস, ওরে বাবা রে, এটা কী! মানুষ তো অবাক! সবাই মিলে গ্রামের মোড়লের কাছে গেল। তাকে জিজ্ঞেস করল এটা কী জিনিস। মোড়ল বলল, ওটা দেখতে কেমন বর্ণনা বলো তো শুনি। সবাই হাতির বর্ণনা দিল। মোড়ল শুনে অনেকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আরে ওটা কী জিনিস তা আমিই তো জানি না, তোদেরকে কী বলব!
তো আমাদের রাষ্ট্র এলো, কিন্তু আমরা কেউ জানি না রাষ্ট্র কী। আমরা যখন সংবিধান বানালাম তখন কামাল হোসেনের বয়স ৩৭ বছর। আমেরিকান কনস্টিটিউশন যখন বানানো হলো তখন আমেরিকার সবচেয়ে মেধাবী মানুষরা সেই কনস্টিটিউশন তৈরিতে অংশ নিয়েছিলেন। তার মধ্যে একজন সদস্য ছিলেন যিনি সব জায়গাতে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’-এর কথা খুব বেশি বলছিলেন। যেখানেই যাকে একটা পাওয়ার দেয়া হচ্ছে তাকে ব্যালেন্স করার জন্য, চেক করার জন্য আরও কিছু দিতে হবে, এটা ছাড়া চলবেই নাÑ এটা তিনি বারবার বলেছেন।
যাতে কেউ অপ্রতিরোধ্য না হতে পারে…? এই প্রশ্ন করা হলে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, হ্যাঁ। যেমন প্রেসিডেন্টকে দেয়া হয়েছে তো এদিকে কংগ্রেসকে দেয়া হয়েছে। অথবা নিম্নকক্ষ যদি থাকে তাহলে উচ্চকক্ষ দিতে হবে। প্রাইম মিনিস্টার একটা কাগজ প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠিয়ে দিলেন যে, অমুককে মৃত্যুদণ্ড থেকে ক্ষমা করে দেয়া হোক। আর প্রেসিডেন্ট সই করতে বাধ্য হলেন। এই অবস্থা, এই স্বৈরতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র থাকা যাবে না। তো সেই মানুষটি বললেন, মানুষ যদি এতোই ভালো হতো তাহলে রাষ্ট্রেরই দরকার হতো না। মানুষ যেহেতু খারাপ, তার মধ্যে যেহেতু খারাপ এলিমেন্ট আছে, সুতরাং তাকে চেক করতে হবে।
তো আমাদের এখানে যখন সংবিধান তৈরি হলো সেখানে একচ্ছত্র করে দেয়া হলো একজনকে। কয়েকদিন আগে পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এক্সিকিউটিভ হেড, জুডিশিয়াল হেড এবং সেনাবাহিনীর হেড। মানে অল ইন অল। পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্করতম স্বৈরতন্ত্রীর হাতেও এতোগুলো প্রশ্নহীন ক্ষমতা থাকে না। তাহলে তার এই ক্ষমতা কোথা থেকে এলো? এলো এভাবে যে, যখন আমাদের হাতে শাসনক্ষমতা এলো তখন দেখা গেল একটা বিরাট নৈরাজ্য। তখন প্রত্যেক এমপি স্বাধীন। যে যখন খুশি যে কোন দলে যেতে পারে। লোভ দেখিয়ে, ভুলিয়ে-ভালিয়ে, মন্ত্রী বানানোর কথা বলে এক দল নিয়ে যেত তাদেরকে। এটাকে বলে ‘হর্স ট্রেডিং’। মানে ঘোড়ার ব্যবসা। এটা ইংল্যান্ডেও ছিল। নইলে এই শব্দ কোথা থেকে এলো? ওরা সব ধাপ পার হয়ে এসেছে। আজকে যে এতো বড় বড় মূল্যবোধের কথা তারা বলে, তার কারণ প্রত্যেকটি ধাপ তাদেরকে পার হয়ে আসতে হয়েছে। আমাদেরও পার হতে হবে। কিন্তু একটু দ্রুত পার হতে হবে। কারণ, এই যুগ অনেক দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং অতীতের মানুষের অভিজ্ঞতা আমাদের চোখের সামনে আছে।
তো সেই নৈরাজ্যের কারণে সরকার থাকছে না, পড়ে যাচ্ছে কেবল। আবু হোসেন সরকার নামে একজন চিফ মিনিস্টার হলো একদিনের জন্য। তারপরের দিন আবার দেখা গেল তাকে যারা সমর্থন দিয়েছিল তারা অন্যকে সমর্থন দিয়ে বসল। শাহেদ আলী নামে একজন ডেপুটি স্পিকার ছিলেন, তাকে এসেম্বলির মধ্যে পিটিয়ে মারা হলো।
এই যখন অবস্থা, তখন সবাই চিন্তা করল এটাকে ঠেকানোর কী উপায়। চিন্তা করল যে, পার্টির বিরুদ্ধে কেউ যেতে পারবে নাÑ এই বিধান করতে হবে। তার ফলে আমাদের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ এলো। এই অনুচ্ছেদ অনুসারে পার্টির ডিসিশন ইজ ফাইনাল। এটা ভাল। কারণ, তাতে একবার পার্টির মধ্যে গেলে পার্টির বাইরে আর যেতে পারবে না। আমি পার্টি থেকে নির্বাচিত হলাম, আবার সরকার পতনের জন্য ভোট দিলাম আরেকজনকে- এটা আর চলবে না। যে পার্টি থেকে এসেছে সেই পার্টিকেই ভোট দিতে হবে।
এই অনুচ্ছেদটা করে তারা তখন খুশি হয়েছিল। যাক, সরকারের পতন আমরা রক্ষা করতে পারব এতে। কিন্তু এর মধ্যে যে কী ভয়াবহ একটা একনায়কতন্ত্রের বীজ রোপিত হয়েছিল, সেটা আর কেউ তখন খেয়াল করেনি। কারণ, সংসদে পার্টির কর্তৃত্ব মানে পার্টি প্রধানের কর্তৃত্ব। অর্থাৎ পার্টি প্রধান অটোমেটিক্যালি একনায়কতন্ত্রীতে পরিণত হয়ে গেলেন।
এখন আমরা যদি বলি খালেদা-হাসিনাকে সরালে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তা কিন্তু নয়। তারা গেলে যে আসবে সে-ই কিন্তু একনায়কতন্ত্রীতে পরিণত হবে। কারণ, প্রক্রিয়াটা তো রয়ে গেল! সুতরাং যিনি প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন তিনি সাংবিধানগতভাবে একনায়কতন্ত্রী। তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান, এক্সিকিউটিভ প্রধান ও জুডিশিয়ারির প্রধান। এতোকাল তাই চলেছে, এখন যদিও বিচার বিভাগ আস্তে আস্তে আলাদা হচ্ছে, আলাদা হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। তার মানে একটু একটু রাষ্ট্রের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে।
আবার দুর্নীতি দমন কমিশন একটু স্বাধীন হয়েছিল, কিন্তু আবার তাকে পরাধীন করে ফেলা হয়েছে। রাষ্ট্রের যে অঙ্গগুলোর জন্য স্বাধীনতা একেবারে অনিবার্য, সেগুলোকে স্বাধীনতা দিতে হবে। কোন অপরাধ করে কি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাঁচতে পারবেন? কখনও না। হয়তো যতদিন তিনি প্রেসিডেন্ট থাকবেন ততদিন তাকে কিছু বলা হবে না। তবু যদি জানা যায় যে তিনি অপরাধ করেছেন, তাহলেও তিনি বাঁচতে পারবেন না। কিন্তু আমাদের এখানে দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীন না। নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রাণ, আর নির্বাচনের প্রাণ হচ্ছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু এটাও তো স্বাধীন নয়। তার ফলে এখন দুটি একনায়কতন্ত্র সাংবিধানিকভাবে আমাদের এখানে এসেছে। এটাকে কেউ বানায়নি যে, আমি একনায়কতন্ত্র। এটা রাষ্ট্রীয়ভাবে তৈরি হয়েছে।
আইয়ুব খানও একনায়কতন্ত্রী ছিলেন। তখন একনায়কতন্ত্রী ছিল একরকম। একনায়কতন্ত্রী যখন দেশে থাকে তখন একজনই থাকে। ইয়াহিয়া থাকলে ইয়াহিয়া, এরশাদ থাকলে এরশাদ। কিন্তু আমাদের একনায়কতন্ত্র হয়ে গেল দুটি। কারণ প্রধানমন্ত্রীর প্রসেসটা হচ্ছে ডেমোক্র্যাটিক। জনগণের ভোটে প্রধানমন্ত্রী হতে হয়। কিন্তু তার ক্ষমতাটা হচ্ছে স্বৈরতান্ত্রিক। সুতরাং জনগণ তো একজনকে ভোট দিচ্ছে না। জনগণ পাঁচ বছর পর হয়ত আরেকজনকে ভোট দিচ্ছে। এই করতে গিয়ে আমাদের স্বৈরতন্ত্র হয়ে গেল দুটি।
একটার চেয়ে দুটি ভাল না? এক ধরনের ব্যালেন্স থাকবে না এতে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, এতে ব্যালেন্স হয় না। এটা খারাপ এজন্য হয়ে যায় যে, গণতন্ত্র কী বলে? গণতন্ত্র বলে, আমি একা বাঁচতে পারি না; সবাইকে নিয়ে আমার বাড়ি। সুতরাং গণতন্ত্রে যারা ক্ষমতায় আছেন তারাও যেমন গুরুত্বপূর্ণ, বাইরে যারা আছেন তারা অতটা না হলেও গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের সবকিছুতে তাদের রোল আছে এবং তারা পাওয়ার এক্সারসাইজ করে। কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের মূল কথা তা নয়। স্বৈরতন্ত্র বলে যে, আমি একাই পারি। এরশাদ কখনও বলেনি আমার সঙ্গে আপনারা সবাই আসুন, আইয়ুবও কখনও বলেনি। তারা বলেছে আমি একাই পারব। অর্থাৎ আমিই পারি, অন্যদের প্রয়োজন নেই। যদি কেউ থাকে তাকে নির্মূল, নিশ্চিহ্ন করা হবে। সেজন্য আমাদের এখানে যারাই ক্ষমতায় আসছে তারা অপজিশনকে বাঁচিয়ে রাখবেন কী, আরও শক্তিশালী করবেন কী, অপজিশনকে তারা নিশ্চিহ্ন করে দিতে চান।
অনেকে বলে, সংসদ থেকে অপজিশন গোসসা করে চলে যায়। আসলে গোসসা করে যায় না, তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। তাদেরকে পার্লামেন্ট থেকে তাড়ানো হয়, রাজপথ থেকে তাড়ানো হয়, এমনকি বাড়িঘর থেকেও তাড়ানো হয়। আবার এই অপজিশন যখন ক্ষমতায় আসে তারাও একই কাজ করে।
মানুষ হিসেবে তো তারা শক্তিশালী। না হলে দু-ভাগে ভাগ করছেন কীভাবে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, মানুষ হিসেবে তো শক্তিশালীই। কারণ সে তো একনায়কতন্ত্রী। সে যখন ক্ষমতায় থাকছে তার ক্ষমতা তো তখন সর্বময়। তো এটা করতে গিয়ে একটা রাষ্ট্রের যত রকম ন্যায়-নীতি, যত রকম মূল্যবোধ, যত রকম জনস্বার্থÑ সবকিছুকে ভেঙে দিয়েছে। যেমন আমলাতন্ত্র। আমলাতন্ত্র একটা যন্ত্র বা গাড়ি, আর পলিটিশিয়ান বা মন্ত্রী হচ্ছেন ড্রাইভার। তিনি আসবেন, দিকনির্দেশনা দেবেন, তাতে গাড়ি চলবে। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে যে, দুই দল তার নিজের লোককে যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে দিচ্ছে। সুতরাং সেটা আর যন্ত্র থাকছে না, ওটা পলিটিক্স হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আমলাতন্ত্র পলিটিক্যাল হয়ে গেছে। সারা দেশ পলিটিক্যাল হয়ে গেছে। অন্য দেশে পলিটিক্স কিছু লোকে করে। দেশের দেখভাল, জনকল্যাণ কিছু মানুষ করে। বাকি মানুষ যে যার কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে, ন্যায়ের সঙ্গে করে থাকে। মাস্টার মাস্টারের কাজ করে, কৃষক কৃষকের কাজ করে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে হেডমাস্টারের আর শক্তি নাই। কারণ, ওই স্কুলের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের একজন শিক্ষক আছেন, তিনি যা খুশি তাই করেন। একটা বাড়তি ক্ষমতা পেয়ে তিনি উন্মাদ হয়ে যান, তিনি ভবিষ্যতে হেডমাস্টার হওয়ার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। ফলে দেখা যায়, পুরো স্কুলের ডিসিপ্লিন শেষ হয়ে যায়।
মানুষ যদি রাজনীতি সচেতন না হয় তাহলে তার অধিকার সে আদায় করবে কীভাবে? সাপ্তাহিকের এ প্রশ্নে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, রাজনীতি সচেতন হওয়া আর রাজনীতিবিদ হওয়া তো এক কথা নয়। আমি মাস্টার, আমি কেন রাজনীতিবিদ হবো? আমি ডাক্তার, আমি কেন রাজনীতিবিদ হবো? আমাকে কেন রাজনীতিবিদ হতে বাধ্য করা হচ্ছে? উপাচার্য হতে হলে আমাকে রাজনীতিবিদ হতে হবে কেন? আমি তো মাস্টার হয়েই উপাচার্য হবো। সেরা শিক্ষকই তো উপাচার্য হবেন।
সুতরাং এর ফলে রাজনীতির নামে দুটি দল দেশের সব দুর্বৃত্তকে সব রকমের লুণ্ঠন, অপরাধ, নৈরাজ্য করে আর্থিকভাবে সুবিধার সুযোগ দিয়ে দিয়েছে। কোন বাধা নেই। সম্পূর্ণ জনগণকে লুণ্ঠন করার জন্য লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। তোমরা যা পার করে খাও, বিনিময়ে আমাকে রক্ষা করো। তাই এরা লুণ্ঠনের বিনিময়ে তাকে রক্ষা করছে। দেয়া-নেয়ার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। তাতে সারা দেশ একটা কমপ্লিট নৈরাজ্যের মধ্যে আছে।
স্বৈরতন্ত্রের যেহেতু নিয়ম হচ্ছে বিরুদ্ধ পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করা, তাই দু’দলই সেটা চেষ্টা করে যাচ্ছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ক্রমাগতভাবে রক্তাক্ত রূপ নিতে যাচ্ছে। এর আগেরবার গৃহযুদ্ধ প্রায় বেধে গিয়েছিল, সেই পর্বটা পার হয়েছি আমরা। কিন্তু আবারও সেই আলামত দেখা যাচ্ছে।
ইন্ডিয়াতে কিন্তু আমাদের মতো এই সমস্যাটা হয়নি। কারণ, সেখানে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ দিয়ে সংবিধান করা হয়েছে। কেউ অপরাধ করলে সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে যায়, সারা দেশে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। অপরাধ সেখানেও যে নেই তা নয়। আছে। কিন্তু কেউ অপরাধ করে একদম বীরদর্পে হেঁটে যাচ্ছে এমন তো নেই।
আমাদের এই অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় কীÑ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, মুক্তির প্রথম শর্ত হচ্ছে গণতন্ত্র। নব্বই সালে আমরা আন্দোলন করেছি স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক বলে। আসলে গণতন্ত্র আসেনি, এসেছে গণতন্ত্রের নামটা। প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্য আমাদের সংগ্রাম করতে হবে। একনায়কতন্ত্রের হাত থেকে যদি গণতন্ত্রকে মুক্ত করা যায়, তাহলেই কেবল পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে, মুক্তি আসতে পারে। সেটা খুব কঠিন কিছু না। দুই একটা ছোট্ট পরিবর্তন করতে হবে মাত্র।
যেমন কিছুদিন আগে কামাল হোসেন বলেছেন ‘বোবাদের সংসদ’। সাংসদরা কোন কথা বলতে পারে না, পার্টি প্রধান বা পার্টি যা বলে তা-ই তাদের কথা। অথচ সাংসদরা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। তারা তাদের এলাকার জনগণের প্রতিনিধি। তাদের দুঃখ-দুর্দশা বা জাতির দুঃখ-দুর্দশার সব কথা তারা আলোচনা করবেন, বলবেন সংসদে। সেই অনুযায়ী নিয়ম-নীতি তৈরি হবে। ইংল্যান্ডের গণতন্ত্রকেই তো আমরা এখানে ফলো করি। ইংল্যান্ডে কী হয়? আমার পক্ষ ছেড়ে অন্য পক্ষকেও আমি অনেক ইস্যুতে ভোট দিতে পারি, আমার পক্ষকে সমালোচনাও করতে পারি।
আমাদের এখানে যদি এটা হয়, ৭০ অনুচ্ছেদে যদি সামান্য পরিবর্তন আনা যায় তাহলেই কেবল সম্ভব এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া। তাতে পার্লামেন্টে সাংসদরা হবেন পুরো স্বাধীন। ঠিক ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে একজন সাংসদ যেমন পুরোপুরি স্বাধীন। তবে যেহেতু আমাদের মূল্যবোধ এবং অন্যান্য জিনিস ইংল্যান্ডের মাপের নয়, তাই দুই একটা ছোট্ট জায়গায় তাদের আটকানো থাকবে। তার মধ্যে একটা হলো, যদি তার পার্টির বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আসে, তাহলে তিনি পার্টির বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না। যেমন আমার পার্টি সরকারে আছে, অপজিশন আমার পার্টির বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনল, আমি তখন আমার পার্টির বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারব না। তাহলে সরকার তো টিকে থাকল! আবার স্বৈরতান্ত্রিক পরিস্থিতিও সৃষ্টি হলো না। আরেকটা হতে পারে যে, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় পার্টির প্রধানকে ভোট দিতে হবে। এর বাইরে তিনি মুক্ত থাকবেন। তিনি তার বিবেক অনুযায়ী কাজ করতে পারবেন, কথা বলতে পারবেন। অপজিশন যদি দেশের কল্যাণের জন্য ভাল প্রস্তাব আনে, তার পক্ষে ভোট দিতে পারবেন।