নির্বাচন কমিশনকে আর শক্তিশালি করার দরকার নেই বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ড. এটিএম শামসুল হুদা। গত ৫ ফেব্রুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে বিদায় নেওয়ার পর এই প্রথম নির্বাচন কমিশন নিয়ে মুখ খুললেন তিনি।
সোমবার সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত ‘নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক দিন ব্যাপী সেমিনারে শামসুল হুদা এ কথা বলেন।
ড. হুদা বলেন, “আমার মনে হয় নির্বাচন কমিশনকে (আইনগতভাবে) আর স্বাধীন করার প্রয়োজন নেই। কেবলমাত্র আইন পালনের মনোবৃত্তি তৈরি হলেই কমিশন বর্তমান আইনে অনেক স্বাধীন ও স্বাচ্ছন্দ্যভাবে কাজ করতে পারবে।”
তিনি তার সময়ে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ (আরপিও) সংশোধনসহ নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপেরও ব্যাখ্যা দেন।
সাবেক এই সিইসি বলেন, “২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে শুনতে পেলাম যে একজন মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ ডজনখানেক সরকারি কর্মকর্তা নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছেন। তখন আমরা একটি আইন করেছিলাম যে, রাজনীতিকদের কমপক্ষে তিন বছর দলের সদস্য থাকতে হবে। খোঁজ নিয়েও তাদের মাঠে প্রচারণার সত্যতা পাওয়া গেল। এদের ঠেকাতেই তখন এ আইন করা হয়। এখন প্রয়োজনে সাপেক্ষে তা পরিবর্তন হতে পারে।”
বর্তমানকে কমিশনকে সবার সঙ্গে পরামর্শ করে আরপিও সংশোধন করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “এ কমিশন কি করছে না করছে আমি জানি না। শুনেছি কমিশন আরপিও সংশোধন করবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যমসহ অন্যদের সঙ্গে সংলাপ করে তা করা উচিত। কারণ নির্বাচন করতে গেলে এদের নিয়েই করতে হবে। যদিও আরপিও সংশোধন বিষয়ে কারো সঙ্গে আলোচনা করতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। তবে আমরা এই সংলাপ ব্যবস্থা চালু করেছিলাম ক্ষমতাসীন সরকারের প্রভাব দুর্বল করার জন্য।”
নির্বাচন কমিশনের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে হুদা বলেন, “আইনে আছে সংসদের বাজেটে টাকা ছাড় হওয়ার পর কেউ নির্বাচন কমিশনের টাকা আটকাতে পারবে না। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ে এসে এ টাকা ছাড়ের বিষয়টি আটকা পড়ে থাকে। একটা অংশ আছে যারা বিশেষ উদ্দেশে এটা করে থাকে। তারা হয়তো চায়, ইসি এসে তাদের কাছে ধরণা দিক।”
পাঁচ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সাবেক এ সিইসি বলেন, “২০০৭-০৮ সালে যখন আমরা নির্বাচন কমিশনে গিয়েছিলাম, তখনকার পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি এক নয়। তখনকার সরকার আমাদের সহায়তা করেছিল। বর্তমান সরকারও দায়িত্বপালনে কোনো হস্তক্ষেপ করে নাই। তবে হয়তো অনেক সময় সহযোগিতা পাইনি। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে সংসদ সদস্যরা হস্তক্ষেপ করেন।”
“রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন বিষয়ে আমরা বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি দিয়েছি। তারা প্রায় একই ভাষায় উত্তর দিয়েছেন। এখানে বিএনপি আর আওয়ামী লীগের ভাষাও প্রায় এক। আমি জানি না, তারা আলোচনা করে উত্তর দেন কিনা। একজন নেতা আমাকে বলেছেন, সময় লাগবে। অনেক দিনের কালচার (সংস্কৃতি)। আমিও আশাবাদী। আইন যখন হয়েছে, সবাই এক সময় মানতে বাধ্য হবে। আমাদের হাতে তো পুলিশ-আর্মি নাই যে আমরা তাদের ধরে নিয়ে আসবো। তাই ভবিষ্যতের দিকেই তাকিয়ে আছি।”
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের একভাগ ভোটারের স্বাক্ষর সংগ্রহের নিয়ম সম্পর্কে তিনি বলেন, “এ নিয়ম যুক্তরাষ্ট্রেও আছে। এটা না হলে ডামি প্রার্থী নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে প্রভাবশালীদের কাছে এজেন্ট বিক্রি করে।”
বর্তমান কমিশনকে আরপিও সংশোধন না করারও পরামর্শ দেন তিনি।
সেমিনারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে হলে সর্ব প্রথম ভাবতে হবে কোন লোকগুলোকে সেখানে পাঠানো হচ্ছে। দায়িত্বপ্রাপ্তরা কমিশনে গিয়ে আইনের প্রয়োগ করতে পারবে কিনা।”
তিনি বলেন, “বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় সমস্যা তারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। তারা এখনো টিম তৈরি করতে পারেনি। তারা আস্থাহীনতায় ভুগছেন। এ কমিশন নিজের কাজ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দায় এড়াতে চান।”
তিনি আরো বলেন, “ঋণ খেলাপির দায়ে আমরা প্রার্থিতা বাতিল করার পর আদালত ৭/৮ জনকে ফিরিয়ে এনেছেন। এ জন্য কমিশনকে নতুন করে ব্যালট ছাপানোর পাশাপাশি ২৮ লাখ ব্যালট পোড়াতে হয়েছিল।”
তিনি বলেন, “ভারতের নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় সুবিধা, তাদের পেছনে রয়েছে জুডিসিয়ারি। আরপিও খেলাপ করলে জুডিসিয়ারি নিজে থেকে সুয়োমোটো রুল জারি করে দেয়।”
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, “নির্বাচন করতে হাজার হাজার আইন শৃঙ্খলাবাহিনীসহ প্রশাসন জড়িত থাকে। এ জায়গাগুলোতে যেভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে সেখানে শুধু নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। সুতরাং এ জায়গাগুলো নিরপেক্ষ করতে হবে।”
তিনি বলেন, “সরকার না চাইলে আইন দ্বারা সবকিছু করা সম্ভব নয়। যেমন দুদক শক্ত আইন দ্বারা স্বাধীন হলেও তারা কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।”
সাবেক কেবিনেট সচিব ও সাবেক সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান সাদাত হোসাইন বলেন, “সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে একটাতেও সরকার হারেনি। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে সরকারি দল জেতে নাই।”
তিনি বলেন, “সরকারের অধীনে এক দল আরেকদলকে বুঝিয়ে নির্বাচনে নিয়ে আসবে এটা হয় না। সবদলই জানে সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জারিঝুরি। কারণ বড় দলগুলোতো এ খেলা খেলে এসেছেন। আসলে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে সরকার ছাড়া কোনো কিছুই স্বাধীন নয়।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোস্তাফা চৌধুরী বলেন, যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা ক্ষমতায় থাকার জন্য নির্বাচনকে প্রভাবিত করাসহ অনেক কিছু করতে পারে।
তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশনকে আস্থা ও নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনতে হবে। যারা পদে যাবেন তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। অন্যায়কারীদের বিচার করতে হবে।”
আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, “বর্তমান নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে নাগরিকদের ভাবনা ভালো না। তারা কয়েকটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে বাজে পরিস্থিতি তৈরি করেছে।”
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন, সাবেক মন্ত্রী সরদার আমজাদ হোসেন, প্ল্যানিং কমিশনের সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক, আবুল হাসনাত প্রমুখ। সেমিনারের সভাপতিত্ব করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন।
এতে আরো উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি কাজী ওবায়দুল হক।
সেমিনারের সঞ্চালনা করেন সুজনের নির্বাহী পরিচালক বদিউল আলম মজুমদার।