বছরের শুরুতে একটি স্থিতিশীল পুঁজিবাজারের প্রত্যাশায় ছিলেন বিনিয়োগকারী, ব্রোকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ (এসইসি) সংশ্লিষ্ট সকলে। তবে প্রত্যাশার পুরো উল্টো চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে এ সময়ে। এতে বিনিয়োগকারীসহ হতাশ হয়েছে সংশ্লিষ্ট সবাই।
সমাপ্ত বছরের পুরো সময়টা বিনিয়োগকারীদের কেটেছে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে। প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার পর গত ডিসেম্বর মাসটি অনেক আশার সঞ্চার করেছিল বাজার সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। ডিসেম্বরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের(ডিএসই) সাধারণ সূচক ৪৯০০ পয়েন্ট থেকে ৫৩০০ পয়েন্টের মধ্যে ওঠা-নামা করে। পাশাপাশি সূচকের উল্লম্ফন লক্ষ্য করা যায়নি বাজারে।
পুঁজিবাজারের দৈনন্দিন লেনদেন খুব বেশি ভালো না হলেও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নতুন বছরে বাজারে বিনিয়োগ শুরু করবে বলে ধারণা করেছিলেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু নানা গুজবে বাজারের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
উপরন্তু নতুন মুদ্রানীতি সংকোচনশীল হচ্ছে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে বাজারে। এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এমন প্রচারণাও চালায় একটি পক্ষ। এতে গত ৪ জানুয়ারি থেকে বাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়। অনেকে বাজার পর্যবেক্ষণ শুরু করে এ সময়ে। বাজারে সৃষ্টি হয় ক্রেতা শঙ্কট। যার প্রভাবে বাজারের লেনদেন ও সূচক কমতে থাকে।
এর পর গেল সপ্তাহের শুরুতে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড স্পষ্টিকরণ ব্যাখ্যা প্রদান করে। ব্যাখ্যায় বলা হয়, এখন থেকে কালো টাকার উৎস সম্পর্কে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রশ্ন উত্থাপন না করলেও সরকারের অন্য কোনো সংস্থা প্রশ্ন করতে পারবে। এতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয় হয়। ডিএসই’র সাধারণ সূচক ও লেনদেন কমে যায় সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে।
পরবর্তীতে গত সোমবার মন্ত্রীপরিষদ সভায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভায় প্রচলিত আইন কঠোরভাবে অনুসরণের জন্য আয়কর আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়। এতে বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি পুঁজিবাজারের প্রাথমিক নিয়ন্ত্রক ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পরদিন মঙ্গলবার বিক্ষোভ শুরু করে বিনিয়োগকারীরা। ফলে ওইদিন লেনদেন শুরু হওয়ার মাত্র ৪ মিনিট আগে লেনদেন বন্ধ করে দেয় ডিএসই। একইদিন লেনদেন শুরুর মাত্র ২ মিনিটের মধ্যে সিএসইও লেনদেন বন্ধ করে দেয়।
মঙ্গলবার ডিএসই ও সিএসই’র প্রতিনিধিরা সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জে কমিশনের (এসইসি) কাছে। এসময় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য পূর্বের আইন পুর্নবহাল করার দাবি জানান তারা।
বুধবার সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের পরে এসইসি চেয়ারম্যান জানান, সরকারি কর্মকর্তারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে না-এমন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি মন্ত্রীসভা।
এসইসি চেয়ারম্যান ব্যাখ্যা দেয়ার পর বুধবারও আধাঘন্টা দেরিতে লেনদেন শুরু হয় ডিএসইতে। কিন্তু এসইসি’র ব্যাখ্যার পরেও সূচকের বড় পতন লক্ষ্য করা যায়। এদিন ডিএসই সাধারণ সূচক কমে যায় ১৭০ পয়েন্ট। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে বিনিয়োগকরীরা। বিনিয়োগকারীরা ভাঙ্গচুর ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানায়।
কিন্তু ১৬ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে পুঁজিবাজার গতিশীল করার লক্ষ্যে আয়কর আইনের সংশোধনীটি পরিপত্র আকারে জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এতে বাজার সংশ্লিষ্টরা আবারো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। শেষে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এর পরিপত্রে প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করেন। এর প্রেক্ষিতে জারি করা পরিপত্রটি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
এর আগে গত ৪ থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ডিএসইর সাধারণ সূচক কমে ৭৮৮ পয়েন্ট। যা কয়েকটি গুজব ও সরকারি সিদ্ধানের কারণে ঘটেছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
এ সিদ্ধান্তের পর সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে দেখা যায় বাজারের পুরো উল্টো চিত্র। সূচক বাড়ে ৫.৩৪ শতাংশ বা ২৫০ পয়েন্ট। দর বাড়ে পুঁজিবাজারে লেনদেনকৃত অধিকাংশ শেয়ারের।
তবে বাজারের এ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যেও স্থিতিশীল পুঁজিবাজারের দাবিতে বৃহস্পতিবার ডিএসই মূল ভবনের সামনে বিক্ষোভ করেছেন একদল বিনিয়োগকারী। তাদের দাবি সূচকের হঠাৎ অস্বাভাবিক উত্থান কিংবা পতন দেখতে চান না তারা।