স্বাস্থ্য ছাড়া দেশের প্রতিটি সেবা খাতে দুর্নীতি ও হয়রানির প্রবণতা আগের বছরের তুলনায় কমে এসেছে বলে মনে করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ।
তবে চলতি বছর ঘুষ দেয়ার প্রবণতা ‘আশঙ্কাজনকভাবে’ বেড়েছে বলে দুর্নীতিবিরোধী এ সংস্থার ‘সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ-২০১২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
শুক্রবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১-১২ অর্থ বছরে সেবা খাতে ২১ হাজার ৯৫৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন হয়েছে, যা ২০১১-১২ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেটের ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ এবং জিডিপির ২ দশমিক ৪ শতাংশ।
সেবাগ্রহণকারী খানার ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ সেবা নিতে গিয়ে কোনো না কোনো দুর্নীতির অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন বলে জরিপে উঠে এসেছে।
টিআইবি কর্মকর্তারা জানান, দুই বছর পর পর এই খানা জরিপ চালানো হয়। ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ছয়টি খানা জরিপ করেছে সংস্থাটি।
এবারের জরিপে ২০১১ সালের মে মাস থেকে ২০১২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ১৩টি সেবাখাতের তথ্য নেয়া হয়েছে। জরিপ চালানো হয়েছে গত ১৫ মে থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত সময়ে।
টিআইবির গবেষণা ও পলিসি পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান বলেন, এ বছর শ্রম ও অভিবাসন খাতে সেবাগ্রহণকারীদের মধ্যে ৭৭ শতাংশই কোনো না কোনো ধরনের দুর্নীতির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন।
দুর্নীতির অভিযোগের দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ৭৫ দশমিক ৮ শতাংশ সেবাগ্রহীতা আইন শৃঙ্খলারক্ষা বাহিনীতে দুর্নীতির কথা বলেছেন।
এর পর আছে ভূমি প্রশাসন, যেখানে দুর্নীতির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন ৫৯ শতাংশ সেবাগ্রহীতা।
এছাড়া বিচারিক সেবায় ৫৭ দশমিক ১ শতাংশ, স্বাস্থ্যে ৪০ দশমিক ২ শতাংশ, শিক্ষায় ৪০ দশমিক ১ শতাংশ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ, কৃষিতে ২০ দশমিক ৪ শতাংশ, বিদ্যুতে ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ, কর ও শুল্কে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ, ব্যাংক খাতে ৭ দশমিক ১ শতাংশ, বীমায় ৬ শতাংশ, এনজিওতে ৫ শতাংশ এবং অন্যান্য সেবাখাতে ৪১ দশমিক ১ শতাংশ সেবাগ্রহণকারী বিভিন্নভাবে দুর্নীতির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন।
জরিপে অংশগ্রহণকারী সেবাগ্রহীতাদের ৫৫.৮ শতাংশ এবার এই ১৩টি খাতে কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন। ২০১০ সালের জরিপে এই হার ছিল ৮৪.২ শতাংশ।
তবে চলতি বছরের জরিপে সেবাগ্রহীতারা আগের চেয়ে বেশি হারে ‘নিয়ম-বহির্ভূত’ অর্থ লেনদেনে বাধ্য হওয়ার কথা বলেছেন।
বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি ‘কমার পেছনে’ জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি; বিচারিক, ভূমি, কর ও শুল্ক, ব্যাংকিং, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার, সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতিবিরোধী প্রশিক্ষণ, কোনো কোনো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনকে সম্ভাব্য কারণ মনে করছে টিআইবি।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দুর্নীতির সার্বিক পরিস্থিতি ২০১০ সালের ৮৪ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমে এবার ৫৫ দশমিক ৮ শতাংশে এসেছে। তবে সেবাগ্রহীতারা অধিকহারে ঘুষ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। খানাপ্রতি বার্ষিক গড় ব্যয়ের ৪ দশমিক ৮ শতাংশই যায় ঘুষ দিতে।
তবে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে দুর্নীতির প্রভাব মোট ব্যয়ের ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আর ধনীদের ক্ষেত্রে এই হার ১ দশমিক ৩ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সেবাখাতে বছরে মাথাপিছু গড়ে এক হাজার ৪৫২ টাকা নিয়ম বহির্ভূত লেনদেন হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে দুর্নীতির শিকার হয়েছে ৬৫ দশমিক ৪ শতাংশ, আর শহরে এই হার ৫৯ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা।
গ্রামে ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ খানার বাসিন্দারা বলেছেন, তারা কোনো না কোনো কারণে ঘুষ দিয়েছেন। আর শহরে এই হার ৪৬ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি ও তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে লেনদেন হওয়ায় ঘুষের পরিমাণ বেড়েছে বলে মনে করছে টিআইবি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রম ও অভিবাসন খাতে ৭৭ শতাংশ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় ৬৬ দশমিক ৯ শতাংশ, ভূমি প্রশাসনে ৫৪ দশমিক ৮ শতাংশ, বিচারিক সেবায় ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ, শিক্ষায় ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ, স্বাস্থ্যে ২১ দশমিক ৫ শতাংশ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ, কৃষিতে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ, বিদ্যুতে ১২ শতাংশ, কর ও শুল্কে ১২ দশমিক ৪ শতাংশ, ব্যাংকিংএ- ৪ দশমিক ৯ শতাংশ, বীমায় ৩ দশমিক ২ শতাংশ, এনজিওতে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ এবং অন্যান্য সেবাখাতে ৫৩ দশমিক ৩ শতাংশ উত্তরদাতা ঘুষ দেয়ার কথা বলেছেন।
সুনির্দিষ্ট ১৩টি সেবা খাতের বাইরে বিআরটিএতে ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ, পাসপোর্টে ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ, বিটিসিএলে ৫৯ দশমিক ৭ শতাংশ, পেনশন খাতে ৩৯ শতাংশ, গ্যাসে ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদালিতে ২২ শতাংশ, ডাক বিভাগে ১৮ শতাংশ, ওয়াসায় ৭ দশমিক ১ শতাংশ উত্তরদাতা অনিয়ম/দুর্নীতির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন।
টিআইবির চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো যে প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করছে না- তা এই জরিপ থেকে স্পষ্ট হয়েছে।
“সেবা খাতের বেশ কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি কমেছে- এটা সুখবর। তবে যেগুলো কমেছে তার মাত্রা কতটুকু তা লক্ষ্য রাখতে হবে।… অনেকে ভয়ে পুলিশের কাছে যায় না, ভয়ে মিটিয়ে ফেলে। কিন্তু আমরা চাই, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হোক। তারা মানুষকে সেবা দিক।”
যেসব কারণে সেবাখাতে দুর্নীতি কমেছে সেগুলো দেশের জন্য শুভবার্তা নিয়ে এসেছে মন্তব্য করে সুলতানা কামাল বলেন, “মনে রাখতে হবে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, গ্র্যান্ড করাপশন কমেনি।”
মানুষের খরচের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় অনেকে সেবা নিতে যায় না বলেও মন্তব্য করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যেন ভালোভাবে কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করা সবার নৈতিক দায়িত্ব বলেও মনে করেন তিনি।
“হল-মার্ক, ডেসটিনি, পদ্মাসেতু, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারিগুলো উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি। এগুলো সেবা খাতের দুর্নীতি নয়। এই রির্পোটে এসব দুর্নীতির প্রতিফলন নেই,” বলেন টিআইবির নির্বাহী সম্পাদক ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক পর্যায়ে যারা বড় বড় দুর্নীতি করে তাদের যদি বিচারের কাঠগড়ায় আনা না যায় তাহলে ছোট পর্যায়ে দুর্নীতি হ্রাসের ধারা ধরে রাখা যাবে না।
সেবা খাতের দুর্নীতি কমাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি প্রতিরোধে জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রণালয়ের তদারকি বাড়ানো, জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশন বাস্তবায়ন এবং দুদককে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিতে সুপারিশ করেছে টিআইবি।
এছাড়া নাগরিক সমাজের প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের ভূমিকা বাড়ানোও তাগিদ দেয়া হয়েছে টিআইবির প্রতিবেদনে।