আগামী সংসদ অধিবেশনে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল আনা হলে বিএনপি সংসদে যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া।
রাজধানীজুড়ে সরকারবিরোধী গণসংযোগের অংশ হিসেবে রাজধানীর বাড্ডা এলাকার ভাটারা বালুর মাঠে দেওয়া পথসভায় তিনি একথা বলেন।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘‘এখনো সময় আছে, সরকার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। আর যদি তা না আনে, সারাদেশের মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে। তখন আর সময় থাকবে না।’’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি তুলে খালেদা জিয়া বলেন, ‘‘অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে এনে নিজেদের সুবিধামতো রায় দেওয়া হয়েছে। এখন এ নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। টাকা নিয়ে রায় দেওয়া হয়েছে বলেও কথা উঠেছে। এই সরকারের মুখেই শুধু সংবিধানের কথা। সংবিধানকে তারাই গুরুত্বহীন করেছে।’’
তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে।
বিএনপির চেয়ারপার্সন এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘রং হেডেড’ বলে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘‘তার সরকার প্রধান হয়ে থাকার যোগ্যতা নেই।’’
প্রধানমন্ত্রীর মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলে তিনি বলেন, ‘‘আদালতই তাকে ‘রং হেডেড’ বলে মত দিয়েছেন। তার মাথা খারাপ। তিনি তো সরকারের দায়িত্বে থাকতে পারেন না।’’
দুপুর ২টা থেকে অপেক্ষা করছিলেন হাজার হাজার মানুষ। তাদের কাছে দেরিতে উপস্থিত হওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বক্তব্য শুরু করেন খালেদা জিয়া। তিনি দুর্নীতিবাজ, অত্যাচারী সরকারের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিযে আসার আহ্বান জানান।
খালেদা বলেন, ‘‘দেশ আজ দুর্নীতিবাজ, দখলবাজের হাতে পড়েছে। শিক্ষাঙ্গনকে অস্ত্রাগার বানানো হয়েছে। ব্যবসায়ীরা, ব্যবসা হারাচ্ছেন, চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ, শিল্প কারখানায় অস্থিরতা চলছে, কৃষিখাতে পিছিয়ে পড়ছে দেশ, প্রশাসনে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে, দেশে প্রশাসন বলতে কিছু নেই। সারবিকভাগে দেশের অথর্নীতি ধ্বংসের মুখে।’’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘‘সন্ত্রাস করলে পুরস্কৃত হয়, মানুষের জন্য কাজ করলে জেলে যেতে হয়। তার প্রমাণ, আমাদের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিশ্বজিৎ দাশ হত্যার প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, ‘‘সংবাদপত্রে ছবি ছাপা হওয়ার পরেও সরকার তার দায় এড়াতে চায়। প্রথমে বলেছে, তাদের ছাত্রলীগ জড়িত নয়। এখন প্রকাশিত হচ্ছে সরকারের হুকুমেই ওই সন্ত্রাসীরা রাস্তায় নেমে বিশ্বজিৎকে হত্যা করেছে।’’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হুকুমেই ছাত্রলীগ মাঠে নামে বলে উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘‘তিনি নয়, আসলে হুকুমের আসামি প্রধানমন্ত্রী নিজেই। তিনিই বলেছেন, প্রতিবাদ করতে প্রয়োজনে মাঠে নামতে।’’
‘‘তিনি একটা লাশের বদলে দশটা লাশ চেয়েছিলেন আর লগি বৈঠা নিযে আন্দোলনের কথা বলেছিলেন।’’
রামুর বৌদ্ধবিহারে হামলার সঙ্গে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা জড়িত উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, “আওয়ামী লীগের লোকেরা জড়িত বলে রামুতে হামলাকারীদের এখনো ধরা হয় নাই। অথচ কোনো দোষ না করেও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে আজ জেলে যেতে হয়েছে।”
তিনি বলেন, “বিশ্বজিৎ দাশকে কারা খুন করেছে, তা পত্রিকায় ছবিসহ ছাপা হয়েছে। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ছাত্রদল-শিবিরের লোকেরা বিশ্বজিতকে হত্যা করেছে। এথনো সব খুনিরা ধরা পরেনি। শুনেছি টাকার বিনিময়ে তাদের আড়াল করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এতে কি প্রমাণ হয়? প্রমাণ হয়, সরকারের হুকুমেই হত্যা করা হয়েছে বিশ্বজিতকে।”
এমন হুকুম এর আগেও অসংখ্যবার দেওয়া হয়েছে মন্তব্য করে খালেদা জিয়া বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর হুকুমেই এর আগে গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষকে মারা হয়েছে এই প্রধানমন্ত্রীর হুকুমেই।”
প্রধানমন্ত্রীকে অসুস্থ বলে খালেদা জিয়া ভাটারার সমাবেশে বলেন, “যে প্রধানমন্ত্রী সুস্থ নন, তার রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে বসে থাকা উচিত নয়। অথচ এই প্রধানমন্ত্রীই আজ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিয়ে ক্ষমতা আকড়ে ধরে রাখতে চান।”
‘‘বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, প্রশাসন কোনো কিছুই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। টাকার বিনিময়েই নাকি আজ অনেক রায়ই দেওয়া হচ্ছে’’ এমন অভিযোগ করে খালেদা জিয়া বলেন, “দুদক আজ আওয়ামী লীগের দলীয় আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তাই দুর্নীতি করে পদ্মাসেতু খেয়ে ফেললেও তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না।’’
বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলন বিষয়ে সমাবেশে খালেদা জিয়া বলেন, “আমরা লড়াই করছি মানুষের অধিকার, গণতন্ত্র, আইনের শাসেনের জন্য, দ্রব্যমূল্য কমানোর জন্য, শিক্ষার জন্য, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য।”
আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় মন্তব্য করে গণসংযোগ কর্মসূচির শেষ সমাবেশে খালেদা জিয়া বলেন, “নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন করতে হবে। আওয়ামী লীগ কিংবা অন্তবর্তী কোনো সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে দেওয়া যাবে না।”
আগামীতেও এ দাবিতে বিএনপিসহ ১৮ দলের নেতাকর্মীদের রাজপথে নেমে লড়াই-সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান খালেদা জিয়া।
আগামী সংসদ অধীবেশনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল আনার আনার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে খালেদা জিয়া বলেন, “গত কয়েক বছরে আপনাদের দিয়ে একটিও ভালো কাজ হয়নি। এ বিলটি এনে অন্তত একটি ভালো কাজ করুন। জনগণ মনে রাখবে।”
মিথ্যা, ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির নেতাকর্মীদের জেলে নেওয়া হয়েছে, কাউকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে অভিযোগ করে ভাটারার সমাবেশে খালেদা জিয়া বলেন, “যারা গণতন্ত্র, অধিকার, ন্যায় এবং সত্যের জন্যে আন্দোলন করছেন মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের জেলে পোড়া হয়েছে। অন্যদিকে টাকার বিনিময়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।”
দৈনিক আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে নির্দোষ দাবি করে খালেদা জিয়া আরো বলেন, “মাহমুদুর রহমান কোনো দোষ করেননি। একজন বিচারপতির ‘কেলেঙ্কারি’ প্রকাশ করেছেন। আর এ কারণে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিযে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। আজকে রুহুল কবীর রিজভীকেও অফিস থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। ইনশাল্লাহ, এমন রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা আগামীবার আমরাও করবো। সরকারকে তার সকল দুর্নীতি, সন্ত্রাস, কেলেঙ্কারির জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রসঙ্গ টেনে সমাবেশে খালেদা জিয়া বলেন, “স্বাধীনতার পর সাড়ে ৭ কোটি মানুষ কিছুই পায়নি। লুটপাটের কারণেই তার (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) এ পরিণতি হয়েছে। লুটপাট করে করে দলেই লোকেরাই এই লোকটাকে সঠিকভাবে দেশ পরিচালনা করতে দেননি। দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছে।”
‘‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই দুর্ভিক্ষ, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, দুর্নীতিতে দেশ ছেয়ে যায়। আওয়ামী লীগ এলেই গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়। তাই দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে আর বিশ্বাস করে না।’’
জনগণের প্রতি খালেদার আহ্বান ‘‘আপনারা যদি আপনাদের ছেলে-মেয়েদের ভালো চান, ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা চান, সঠিকভাবে ধর্ম পালন করতে চান, গ্যাস-বিদ্যুত-জ্বালানি, খাদ্যের দাম কমাতে চান তবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির সঙ্গে থাকুন, বিএনপির পাশে থাকুন।”
আবার গ্যাস-বিদ্যুত-জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করলে হরতালসহ কঠোর আন্দোলন দেওয়া হবে বলেও সমাবেশ থেকে সরকারকে হুশিয়ার করে দেন খালেদা জিয়া।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বিএনপির সঙ্গেই আছেন, এমন দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, “জিয়াউর রহমানের ডাকেই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। তাই দেশ রক্ষা করার দায়িত্বও আমাদের। জনগণের দাবি মেনে না নিলে আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করে এ সরকারকে বিদায় করবো।”
“তাই আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হবে” বলে তার বক্তব্য শেষ করেন বিরোধী দলীয় নেতা, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।